পরিবার থেকে বেশিরভাগ দিনই আমার দূরে থাকতে হয়। আর পরিবার মানে তো এই ও আর আমি। ও আমি মিশ্রণে দিনগুলো ভালো যায়, মন্দ যায়, রঙিন যায়, সাদাকালো যায়। তবে বেশিরভাগ সময়ই যায় পানসে। আর একটু কি রঙিন হতে পারত না! কতকিছু ভাবনা যে যাত্রা প্রস্ততিতে যে আসে। এদিকে ঘড়ির কাটা পাঁচটায় ধ্বনি দিয়ে গেল। এখনই বের হতে হবে নয়ত প্রহরের প্রথম বাসটা মিস করব। যেতে হবে অনেকটা পথ, ধরতে হবে অফিস। তার ওপরে সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য যাওয়া। অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। গত দু’বছর ধরে এভাবেই চলছি। ওকে কি ডেকে তুলব? নাকি দরজা লাগিয়ে চাবিটা নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব? নানা প্রশ্ন মুহূর্তেই খেলে যায় মনে। নাহহ…
‘এই ওঠ, দরজাটা লাগিয়ে দাও।’
‘হমম। ওওও রেডি? আচ্ছা সাবধানে যেও।’
এই তো ব্যাস। হয়ে গেল। বের হয়ে দ্রুত পায়ে স্টেশনে এসে দিনের প্রথম বাসটায় উঠে পড়লাম। বাসের ভেতরের গুমোট গন্ধটায় গা গুলিয়ে ওঠাকে অগ্রাহ্য করে পছন্দসই সিটটায় গিয়ে বসলাম। খুব বেশি যাত্রী থাকে না এসময়। তাই ভালো লাগে এই যাত্রাটা। জানালা দিয়ে ঠিকড়ে পড়া আলোয় সূর্য ম্লান একেবারে পরশ দিয়ে যায়। মাঠের পর মাঠ সবুজ ফসলের সোনালী দোল তৃপ্তি এনে দেয় মনে। বাসা থেকে একটা অতৃপ্তি নিয়ে বের হলেও আপন মনে একা ভাবতে ভাবতে পথ চলার এই অনুভূতিটা খুব আবেগাচ্ছন্ন করে ফেলে আমাকে। বের হওয়ার সময়ের ওর মুখখানা, ওর কথার আবেশ, কেন এমন করল, আমি কি কিছু বলতে পারতাম কিনা, আমার কি আরেকটু নিজেকে প্রকাশ করার ছিল কিনা, এগুলো খুব বেশিই উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে ভাবনায়।
ধুউর মনের যে কি সমস্যা! আমার জগতটাতো শুধু ‘ও’ ময় না তাহলে কেন ওইই শুধু আসবে! ধুর বাদ দেই।
পথে কোথাও যদি সমস্যা হয় তাহলে তো ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে! অন্য কোনো শিক্ষকও তো নেই যে এ ব্যাপারে একটু সাহায্য করবে। বিভাগটাও এলোমেলো। বাংলা বিভাগ এমন হলে চলে! পিয়নটাকেও দিয়ে কাজ করানো কঠিন হয়ে গেছে। বছরের পর বছর একই কর্মস্থলে থাকতে থাকতে বেশি সাহস। ভীষণ বিরক্ত লাগে। প্রিন্সিপালকে বলে একটু গুছিয়ে নিতে হবে। বাহ্ ভালো তো। এই তো পারছি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে। ‘আপা নামেন। যাত্রা শ্যাষ’। হেল্পারের ডাকে সময়ে ফিরে আসলাম। রিকশা ধরতে হবে। আর আধঘন্টা সময় হাতে আছে। নাশতা করা দরকার। পাকস্থলী বিদ্রোহ করছে। ঢুকে পড়লাম আধা কাঁচা একটা হোটেলে। এর আগেও এসেছি।
‘ওই আপারে টেবিল পরিষ্কার করে দে।’
ম্যানেজারের কাছে খুব সমাদর আমার। রান্না নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। খুব যত্ন করে ছেলেটা নাশতা দিল। শুরু করতেই একজনের সাথে চোখাচোখি হলো। তিনি গণিতের শিক্ষক। বেশ কিছুদিন হলো এই কলেজে এসেছেন। হাসি বিনিময় করলাম আমরা। বলে উঠলেন, আরে আপনি! পৌঁছে গেছেন!
‘হমম। পাক্কা সময় অনুসারি। আপনি?’
‘বেশিক্ষণ না। নাশতা করতে যতক্ষণ।’
‘ঠিক আছে আপনি এগুতে থাকেন। আমি শেষ করে আসি।’
‘সমস্যা নেই। আপনার আপত্তি না থাকলে একসাথে যাওয়া যায়।’
‘আমি সায় দিলাম।’
শীতের শুরু। হিম শীতল ভাবটা শহরে খুব একটা টের পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছিল হালকা চাদর হলে ভালো হতো। রিকশায় চড়ে বসলাম দু’জন। মেঠো পথ, পাশাপাশি দু’জনার মাঝে খুব একটা দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবুও চেষ্টা করছি দু’জনেই। মাঝে মাঝে দু’চারটা খেজুর গাছ পেছনে ফেলে দূরে কুয়াশার ভিতরে রিকশা ঢুকে যাচ্ছিল। ফসলের মাঠে সর্ষে ফুলের উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা, ঝুরঝুরে মাটি ভেদ করে রসুন পেঁয়াজের আত্মপ্রকাশ।
নীরবতা ভেঙে তিনিই শুরু করলেন, এত ফিট থাকেন কি করে! এতদূরে যাতায়াত, অফিস মেইনটেইন, তারপরও!
‘হেসে ফেললাম। ফিট আর থাকছি কই। ওষুধের বক্স সাথে থাকে।’
‘ওটা সময়ের দাবি। ভালো হলো আপনার সাথে দেখা হয়ে।’
‘হমম। আমারও ভরসা বাড়ল। দেরি হওয়ার সঙ্গী পেলে ভরসা বাড়ে। এরকম অপরাধ আমি একাই করি না। আরো লোকজন আছে।’
‘একদম ঠিক সময়েই পৌঁছাব দু’জন। রয়ে যাবে শুধু যাত্রার এই পরশটুকু। জানেন আপনি থাকাতে কতটা কর্মচঞ্চলতা অনুভব করি এখানে!’
‘কেন?’
‘জানা নেই। তবে সত্যিই এরকম জায়গায়, অ্যাতো ব্যাকওয়ার্ডে পোস্টিং হওয়ায় ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম। আসার পর কাজ শুরু করব কি একটু একা থাকলেই শূন্যতা ঘিরে বসে। তখন আপনিই ভরসা। ’
‘হাহাহা।’ হাসি দেয়া ছাড়া একথার আর কোনো প্রতিকথা এমুহুর্তে আমার নেই।
‘এত সুন্দর করে কেউ হাসতে পারেন! এত প্রাণখুলে! প্রভাতফেরীটা আমার এত মিষ্টতা দিয়ে শুরু হবে ভাবি নি। তবে আশা করছিলাম।’
‘থাক থাক আর বলবেন না। গণিতের লোকের এত সাহিত্য কোত্থেকে আসে! এ যাত্রায় কদিন আছেন?’
‘সপ্তাহ দুয়েক। আপনি?’
‘আমিও। ওওওও আমার সাথে মিলিয়ে!’
নানা কথাবার্তায় পথটা শেষ হয়ে আসলো। নিজেদের কথোপকথনের সাথে রিকশা চালককেও থামাতে হলো। সামনে ডানে রাখেন, কলেজের গেটে। ভাড়া মিটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখনই ক্লাস?’
‘না। এর পরের পিরিয়ডে।’
‘তাহলে আমার ডিপার্টমেন্টে চলে আসেন। চা খাব। আমার এ ক্লাসটাও স্থগিত করা হয়েছে।’
‘আসছি।’
নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। সাথের ব্যাগ ছেলেটাকে দিয়ে হোস্টেলে পাঠালাম। অপেক্ষা করছিলাম ছোট্ট চা আড্ডার। এই অপেক্ষাটায় কেমন একটা অধীরতা আছে, উষ্ণতা আছে। রাস্তার তাড়াটা নেই। একটু পর রুটিনমাফিক কাজের ব্যস্ততা শুরু হওয়ার আগে ঠিক এ সময়টায়… কিছুদিন হলো ভীষণ ভালো লাগে। কি যেন একটা বাসন্তিক দোল লাগছে। সব কিছুতেই আবেশ জড়ানো ভালো লাগা।
‘আসবো?’
‘আরে কেন নয় ! আপনার জন্যই তো বসে আছি।’ সহকারিকে চা দিতে বললাম।
‘সাথে আর কিছু চলবে?’
‘না। শুধু এক কাপ চা। দেরি করে ফেললাম। শুধু চা খাওয়াই হবে, আড্ডা হবে না। দুপুরে আমাদের সাথে খাবেন?’
‘হমম। বিকেলে একটু বের হবো। এখানে খেলে কাজ কমে যায়। আপনি যাবেন?’
‘কোথায়?’
‘ওই তো সেবারের মতো এলাকা দর্শন।’
‘কল দিয়েন। সময়মতো হাজির হয়ে যাব।’
‘ওহহহ বাসায় কল দিতে হবে। একটু প্লিজ। ফোনের মিনিট ওঠা শুরু হতেই বললাম আমি পৌঁছেছি একটু আগেই। ‘ওও, হমম, রাখো’। ফোনটা রাখলাম।
‘আপনার বর? এত তাড়াতাড়ি কথা শেষ! নাকি আমি থাকায়… ’
‘কথা থামিয়ে বললাম আরে না না। ও এখন কাজে। আমিও কাজ শুরু করব।’
‘ওহ্ তাইত! সময় হয়ে গেছে।’
এক দমে দুপুরের খাবারের সময় পর্যন্ত কাজ করলাম। ডাইনিং এ যেতেই, ‘এত দেরি! এর আগেও দেখেছি কাজে ঢুকলে আপনার মাথা প্যাকেট হয়ে যায়।’
‘আপনি আমার জন্য বসে থাকবেন না প্লিজ।’
‘থাক ভদ্রতা দেখাতে হবে না।’
খেতে খেতে কিছু সিনেমা দেখা আর গান শেষ করলাম আলোচনায়। তাঁর সাথে যে সব মিলল এমন না। তিনি সবসময় আর্ট ফিল্ম তো আমার আর্ট ফিল্ম সাথে অ্যাকশনও চলে। আমার লালনগীতি প্রাধান্য পেলেও তাঁর নজরুল। কিন্তু তর্কের ঝড় শুরু হলো ইয়াং জেনারেশন কে কটাক্ষ করা নিয়ে। তাঁর এ বিষয়টা আমার অসহ্য বোধ হলো। অন্য এক সহকর্মীর আগমন দু’জনকে থামাল। নীরবতায় খাওয়া শেষ হলো। আমি হোস্টেলে ফিরে আসলাম। আমার এই এক সমস্যা মাথায় কিছু ঢুকলে বের হতে চায় না। বিকেলে আর বের হওয়া হলো না। কিন্তু হোস্টেলে আর কেউ না আসায় দুপুরের পর থেকে ওষ্ঠদ্বয়ের আর কোনো কাজ থাকল না। বাসা থেকেও কোনো ফোন আসলো না। কিন্তু এই নীরবতায় আমার ইচ্ছে করে ও আমার সাথে কথা বলুক, এলোমেলো ভালোবাসায় উষ্ণ হোক হৃদয়, রোমান্সে ভরে উঠুক দু’জনার আলাপন। আমরা আমাদের আত্মাকে দ্বিখন্ডিত করতে পারি নি তাই বলে কি আবেগে জড়ানো মুহুর্তগুলোও শেষ! সেই তো- সাবধানে থেকো, সাবধানে যেও- ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে সাবধানে থাকতে থাকতে তো রেললাইনের মতো হয়ে যাচ্ছি দু’জন!
নিশ্চুপ রাত গড়িয়ে সকাল হলো জানালায় ঠিকড়ে পড়া রোদে। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় আসলাম। গ্রামের সকালটাই সুন্দর। হোস্টেলটার এদিকটা খোলা। যতদূরে চোখ যায় শস্যের ক্ষেত। সবুজ শস্যে সোনালী রোদের আলিঙ্গনে মনের সতেজতা ফিরে এল। ধীরে ধীরে তৈরি হলাম। হালকা কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
হালকা কাজে আরো ক’টা দিন কাটল। আজকে অনেক ব্যস্ততা থাকবে। বিভাগটাকে সুন্দর করে সাজাতে হবে। দেখলেই যেন মনে হয় বাংলা বিভাগ। নিজেদের কৃষ্টি কালচারের ছোঁয়া থাকবে সব জায়গায়। একক শিক্ষক হওয়ায় নিজেকেই সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ‘ম্যাডাম সব বই চলে আসছে।’
‘দারুণ। কাজে লেগে পড়। যে বই যে তাকের সেখানেই রেখ। আর পেইন্টিংগুলো আমাকে জিজ্ঞেস করে লাগিও।’
সকাল থেকে কাজ করছিই তো করেই যাচ্ছি। ধ্যাত্। যন্ত্র হলে চলবে!! আবার মিটিং আছে। মনের অজান্তেই সোজা গণিত বিভাগে এসে পড়লাম।
‘আপনি! বসেন। মনে পড়ল আমার কথা!’
‘কি যে বলেন।’
‘চা দিতে বলি। সাথে আর কিছু?’
‘না।’
‘একটা প্রশ্ন করব?’
‘হমম ।’
‘এ কদিন আমাকে মনে পড়ে নি একটুও?’
সতর্কভাবে এড়িয়ে গেলাম ‘প্রিন্সিপাল স্যার মিটিং ডেকেছেন হঠাৎ। চলেন ওদিকে এগোই।’
‘কি নিয়ে তর্ক করে বিকেলের বেড়ানোটাই মিস করলাম সেদিন। আজ বলছিলেন ব্যস্ত থাকবেন। কাল ছাড়ব না।’
‘আচ্ছা যাব।’
পরদিন বিকেলে বের হলাম। এর আগেও এ পথে বেড়িয়েছি তবে দু’জনা না সঙ্গে আরো অনেকে ছিল। বেগুনী শাড়ি, চাদর আর মিলিয়ে টিপ। মিলে গেল পোশাকের রং। বিকেলের শুরু। ¤¬ান সূর্যের তেজ। ছায়াঘেরা শান্ত নীরব গাঁয়ের পথ। পশ্চিমমুখি পথ চলা। লালচে রোদের আলোয় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দু’জনার পায়ের শব্দ। পথিমধ্যে হঠাৎ দু একজন পরিচিত জনের সাথে দেখা, কুশল বিনিময় হলো। কথা হচ্ছে না শুধু আমাদের। হাঁটছি দু’জন কথাহীন। মনে হচ্ছিল
শুধু এজন্যই বুঝি বের হওয়া। হঠাৎ তিনিই বললেন, ‘প্রেমে পড়েছেন কখনও?’
‘হমম।’
‘কেমন অনুভূতি হয়েছিল?’
‘চোর চোর। অসময়ে, অবয়সে প্রেমে পড়লে যা হয়। আপনার কি হয়েছে?’
‘মিল হয়েছে। শুধু মিলে গেছে সাধারণ সবকিছু। পোশাক, পছন্দ, রুচি।’
‘ওও। আমি লজ্জিত অনুভব করলাম। নিজের উপর রাগও হচ্ছিল। কেন যে বেগুনী শাড়িটা বেছে নিলাম! আর শাড়িই বা পড়ার কি দরকার ছিল!’
‘অসময়ের কথা তো বললেন। সময়ে প্রেমে পড়েন নি কখনও?’
‘সময়ে সময় হয়ে ওঠে নি। এখানেই একটু অবসর পাই। নতুবা পুরোটাই কর্মময় ছকে বাঁধা জীবন। এখনও বিয়ে করেন নি যে?’
‘ঠিক হয়ে ওঠে নি। প্রেমে বাঁধা পড়লেও ঠিক মিলল না। কোথায় যেন একটা টানহীন সূতা ছিল। ঠিক সুর বাজে নি শেষ পর্যন্ত। এখন মন হয় কি জানেন! মনের তো আর নিজস্ব আলয় নেই যে তার গেট কেউ ডিঙোতে পারবে না। আর তাই নতুন সুর বাজতে চাইছে।’
‘সুর বাজতে চাইছে বাজাবেন। বাধা কোথায়।’
‘অসময়। এবার যে আপনার মতো অসময়ে হাজারো কথার মালা হয়ে তাল লয় সুর সব একসাথে ভেঙে পড়তে চাইছে।’
‘বলেন কি! কে সে!’
‘সাহস দিলে বলব।’
‘এত্ত এত্ত সাহস দিচ্ছি বলে ফেলেন, বলে ফেলেন।’
‘আপনি।’
‘মানে! কি বলতে চান! বজ্রপাতের মতো শোনাচ্ছিল কথাটা।
ভালোলাগা শুধু ভালোলাগার বশেই তাঁর সাথে বেড়িয়েছি। অন্য কোনো সুর বাজাতে নয়। তাহলে কি আমার ব্যক্তিগত জীবনের ছিদ্রটুকু তিনি দেখে ফেললেন! তাঁর তো আমার প্রেমে পড়ার কথা না। নাকি আমিই এগিয়ে দিয়েছি এ পথের খোঁজ। আমার শূন্যতায়, আমার কল্পনায় বারবার তিনি এসেছেন। কিন্তু এত কাছে না, এত কাছে চাই না আমি। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। রিকশা নিয়ে ফিরে আসলাম।’
একরাশ অস্থিরতা কাজ করছে। বাসায় ফোন করলাম।’
‘কি করছ?’
‘কাজে আছি। কিছু বলবা?’
‘না, কিছু না।’
‘রাখো। পরে ফোন দিও।’
না আমার অনেক কিছু বলার ছিল তোমাকে। বলতে পারলাম না। এ সমস্যা কিভাবে বলব। আমাকে উদ্ধার করো। আমার পাশে এসে হাতটা ধরো। আমার মন কোথাও বাঁধা পড়তে চাইছে, আমি না। পরে আবার ফোন দিলাম ওকে। কিন্তু কন্ঠে কোনো উত্তাপ পেলাম না আমার জন্য। তাই আর বলা হয়ে ওঠে নি, ‘আমার তোমাকে প্রয়োজন। তোমার হাতে হাত রাখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে তোমার বুকে মাথাটা রেখে নির্ভাবনায় রাতটা কাটিয়ে দিই। পরেরদিন কলেজে যেতে ইচ্ছে করল না। হোস্টেলেই থাকলাম। গান শুনে, বই পড়ে, এলোমেলো ভাবনায় দিন কাটালাম। স্টেশন লিভ করা যাচ্ছিল না। ওর ওপর আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। যাবটা কই বলো তো। এক ছাদের নিচে থাকলেই কি জীবনসঙ্গী হওয়া যায়! কেন বুঝতে পারছ না আমার মনের অস্থিরতা! কেন বুঝতে পারছ না আমার মন নিয়ন্ত্রনহীন হবার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে! আরো দু’দিন এভাবেই কাটল।
কলেজে গেলাম অন্য সহকর্মীদের সাথে একটা নিশ্চুপ বলয়ে থাকলাম যেন তাঁর মুখোমুখি হতে না হয়। বারবার ক্ষুদে বার্তা আসছে ‘দুঃখিত এভাবে বলার জন্য, কিন্তু এভাবে চলে যাবেন না।’ অথবা ‘ক্ষমা করবেন তবে ভালোবাসা প্রকাশে অপরাধ দেখছি না’ অথবা ‘সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি’। আমি যত না বেশি এড়িয়ে চলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তারচেয়ে যত্নশীল হয়ে উঠছিলাম তাঁর কাছে যাওয়ার। মনটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে তাঁর হাত ধরার জন্য, পাশে বসার জন্য। আর একদিন পরেই বাসায় ফিরব। কি বলব ওকে- আমি তোমার নেই! আমার মন অন্য কোথাও বাঁধা পড়েছে!
নিজ সত্ত্বার বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁর হাতটা ধরার। হলুদ শাড়ি, মেরুন চাদর আর টিপে সাজ শেষ করলাম। ফুলের দোকান থেকে মেরুন ফুল গুঁজে নিলাম চুলে। কলেজে ঢুকলাম। সোজা গণিত বিভাগে। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ভালোলাগাকে ভালোবাসায় পরিণত করতে। ভাবছি চোখে চোখ রেখে বলব আমারও একই দশা, ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। কাছে আসতে ইচ্ছে করে, পাশাপাশি থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার ভাবনাটাকে কে যেন বারবার কালো চাদরে ঢেকে দিচ্ছে। দিক, ও কিছু না। আমার মন যা চায় তাই করব। সমাজ সংসার কিচ্ছু চাই না। তাঁর হাত ধরে আজ বিকেলে দূরে কোথাও যাব। মন চাইলে বাসায় কাল ফিরব, নয়ত না। ওফফ বারবার বাঁধা দিচ্ছে কে!
রুমে ঢোকা মাত্রই, ‘এত দেরি করলে কেন!’
নীরব আমি। কে যেন পিছনে টানছে আমাকে।
‘কত কষ্ট পাচ্ছিলাম! তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ তাই সামনে আসতে সময় নিয়েছো।’
আমার চোখ সরে যাচ্ছিল। সকাল থেকে যে অস্থিরতাটা কমতে শুরু করেছে। আস্তে করে চুলের ফুলটা নামালাম।
‘থাক না। ফুলটা তোমাকে আরো বেশি, আরো বেশি ¯িœগ্ধ করে তুলেছে।’
‘হমম। আমার যেন কথা সরছে না। আমার আমিটা বিদ্রোহ করে উঠছে। এই রুম থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করছে।
‘কখন যে এতটা নির্ভর করে ফেলেছি তোমার ওপর টেরই পাই নি। কি হয় ভালোবাসলে! এ তো তোমার অজানা নয় ভালোবাসা স্থান, কাল, পাত্র কিচ্ছু বোঝে না। এ তো অন্যায় কিছু না। বিধিনিষেধ দিয়ে একে আটকে রেখো না। অস্বীকার করতে পারবে তুমি আমাকে যে প্রচণ্ড পছন্দ করো। বিশ্বাস করো তোমার সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করব না। তোমার ওই অতৃপ্তি ভরা গভীর চোখ দু’টো আমাকে দাও। হাতটা ধরব।’
না। মোটেও না। শুনতে শুনতে কখন যে নিজ সত্ত্বাটা আমাকে টেনে ধরল। কেন সে আমার হাত ধরবে! মুহুর্তেই মনে হলো এই লোক এমন তুমি করে বলছে কেন! আমার তাকে ভালো লাগে তাই বলে বুকে আছড়ে পড়তে হবে এমন তো না। এমন অসময়ে ভুল প্রেমে পড়ার কি দরকার তাঁর! শক্ত করে আবার বললাম, ‘না। আপনি আমার হাত ধরতে পারেন না, পাশে চলতে পারেন না, আমাকে নিয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন আঁকতে পারেন না। আশা করছি এই অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি। ভালো থাকবেন।’ চলে এলাম। এক দমে চলে এসেছি।
নিয়ন্ত্রণহীন মনের বিপরীতে অবস্থান আমার। ভীষণ মুক্ত লাগছিল। চাই না এমন ভালোলাগা। আমি ভালো আছি। ওই জিতে গেল। উহুহহ মনে হয় ভুল হলো, ও জেতে নি। জিতেছে ও আর আমি মিলে যে আলয়, যে অদৃশ্য বৃত্ত সেটাই। তাই এখনও সেই অনুভবের কল আসে না, সময়ে অসময়ে মনের ক্রস হয় না। শুধু দেখা হয়, এক ছাদের নিচে থাকা হয়। তবুও পাশাপাশি থাকার দৃঢ় সংকল্প আমার।
সপ্তাহ দুয়েক ছুটি কাটিয়ে কলেজে গেলাম। এর ভেতরে বদলি হয়েছেন কয়েকজন সহকর্মী। চলে গেছেন তিনিও। বিভাগে ঢুকতেই ছেলেটা একটা খাম দিয়ে বললো, ‘ম্যাডাম আপনার।’
ভেতরে একটা মুক্ত দায় নিয়ে খামটা খুললাম। কয়েক পাতা বড় টিপ আর একটা চিঠি-
ও মেয়ে,
ভালোবাসা নিও। এখন আমি তোমার থেকে দূরে। চাইলে খুঁজে নিতে পারবে। কিন্তু জানি তুমি তা করবে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন তোমার চোখমুখ সব ছুটে গিয়েছে আমাকে ছেড়ে। আমি বুঝি কিন্তু মানতে ইচ্ছে করে না। কেন হও নি আমার! বিধাতা তোমাকে আমার পাশে কেন দেয় নি। কত মধুর হতো বল তো! দু’জনায় পাশাপাশি অনুভূতিতে, অভিমানে কাটিয়ে দিতাম। একই কাপে থেমে থেমে চা খেয়ে রচনা করতাম ভালোবাসার কাব্য। বিরামহীন ওষ্ঠের বলাবলিতে তৈরি করতাম উষ্ণতা। হাতে হাত রেখে খেলে যেতাম শিহরণের খেলা। কিছুটা কি দিতে পারতে না! সবটা ফেরালে কেন! আমি তো তোমার অশান্তি চাই নি, কষ্ট চাই নি। তোমার ভালো থাকা আমার নিরন্তর কামনা। ভালো থেকো। ভালোবাসি।
ইতি
তোমার বিপরীতে আমি।
1 Comment
ফারজিনা
বাহ! বাহ!