বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৪.২৩ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখার প্রায় ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবন জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা। কৃষি এ দেশের জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস। এখনও কৃষিকে ঘিরেই এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে।
এ দেশের কৃষকের ইতিহাস মানে অত্যাচার অনাচার আর শোষণের ইতিহাস। কি পাল, কি সেন, কি সুলতানি মোঘল সব আমলেই কৃষকের শোষণ আর বঞ্চনা ইতিহাস হয়ে আছে। ইংরেজদের আমলেও এর নড়চড় হয় নি। কৃষিখাত থেকে গেছে অবহেলিত, শোষিত। উপমহাদেশের কবি সাহিত্যিকের লেখায় ফুটে উঠেছে কৃষকদের দুঃখ বঞ্চনার কথা। কখনো জমিদার কখনো মহাজন কখনো মধ্যস্বত্তভোগী তাদের শোষণ করে চলেছে। কৃষক ও জমিদারের স¤পর্ক ছিল কৃষি আন্দোলনের মূলভিত্তি। জমিদারের অবর্তমানে সেই স¤পর্ক রূপ নিয়েছে কৃষক এবং বাজার এর মধ্যে। এ দু’টি প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও একটি সাধারণ মিল হলো শোষণ। আগে জমিদার জোতদারের মাধ্যমে কৃষককে শোষণ করেছে আর আজ মধ্যস্বত্তভোগী এবং একটি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীমহল বাজারকে ব্যবহার করে কৃষকদের শোষণ করছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের একটি মূলনীতি হলো কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি। মেহনতী মানুষকেই- কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করা রাষ্ট্রের অন্যতম একটি মৌলিক দায়িত্ব৷ দেশ স্বাধীনের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষকের প্রতি রাষ্ট্রের এই দায়িত্বের কথা ভেবে, তাদের এই দুর্দশার কথা ভেবে বলেছিলেন, আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। তিনি কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে দেখেছেন কৃষক কিভাবে শোষিত হয়। তার মতে চাষিরা হলো আমাদের সমাজে সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী। তিনি কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। তিনি কৃষকদের সহযোগিতার জন্য সুদ মুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ন্যূনতম ন্যায্য মূল্য বেঁধে দিয়েছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও কৃষি ও কৃষকের সেই শোষণ, বঞ্চনা দূর হয় নি। কৃষকরা আমাদের অন্নদাতা কিন্তু সেই কৃষকের দুঃখের শেষ নেই। সারাবছর খেটে মরে পেটের ক্ষুধা নিবৃত হয় না। কৃষক মানেই গরিব মানুষ, অভাবি মানুষ। কিছুদিন পূর্বে গবেষণার কাজে রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে কৃষকদের সাথে মতবিনিময় শেষে কৃষি ও কৃষকদের দুর্দশা স¤পর্কে যা জানতে পারলাম তার মূল কথা হলো আমাদের কৃষক ভালো নেই। তাদের প্রধান দু’টি সমস্যা হচ্ছে কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা আর অপরটি হচ্ছে কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য।
এ দু’টির মধ্যে সমন্বয় করে জীবন নির্বাহ করতে তাদের রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। কেউ কেউ ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছেন। এ সমস্যাগুলো ছাপিয়েও ক’জন প্রান্তিক চাষি যা জানালেন তা আরও ভয়াবহ। এই অঞ্চলে কৃষিতে অতি মুনাফালোভী একটি দুর্বৃত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হয়েছে যারা রাতারাতি কৃষি জমি
কেটে জলাশয় খনন করে মাছ চাষ করছে। ফলে আশে পাশের ক্ষুদ্র কৃষকেরা তাদের জমিতে ঠিকমত সেচ নিতে পারছে না। আবার জমি থেকে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে রবি মৌসুমে রবি ফসল করতে পারছে না। শুধু তাই নয়, কৃষকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাতের আঁধারে কৃষকের জমিতে জলাশয় খনন করে দিচ্ছে।
গত বছর একই গবেষণার কাজে রংপুরের গঙ্গাচরায় তিস্তা নদীর পাড়ের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম একই চিত্র। কৃষকরা কৃষি কাজে আর লাভ করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হচ্ছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অর্থের অভাবে কৃষক তার সোনাফলা জমির ওপরের স্তরের মাটি ইটভাটা মালিকের কাছে বিক্রি করছে। কিছুদিন পূর্বে একজন শিক্ষার্থী এসেছিল হাতে ব্যাংক ঋণের গ্যারান্টর ফরম নিয়ে। আমাকে অনুরোধ জানালো তার ৬০ হাজার টাকার ল্যাপটপ কেনার লোনের গ্যারান্টর হতে। ল্যাপটপ কি প্রয়োজন জিজ্ঞেস করলে জানাল, সে আসলে ল্যাপটপ কিনবে না, তার ঋণগ্রস্ত কৃষক বাবার ঋণ পরিশোধ করবে। কৃষিতে আয় উপার্জন কমে গেছে। সংসার চালাতে, সন্তানের লেখাপড়া শেখাতে তার বাবা এনজিও থেকে উচ্চ সুদের হারে টাকা ধার নিয়েছে। কুষ্টিয়ার এক কৃষকের সাথে কথা বলে জানলাম, প্রথমবারের মতো সে এবার তার জমিতে তামাক চাষ করছে কারণ কৃষি কাজে লাভ করতে পারছে না।
কয়েক বছর কৃষি পণ্যের দাম পাচ্ছে না। অন্যদিকে টোব্যাকো কো¤পানির লোক আগে থেকেই তার উৎপাদিত তামাকের দাম ঠিক করে কেনার অঙ্গীকার করেছে। ফলে তার আর বাজার কিংবা দাম নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, ঝামেলা নেই।
রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়ার কৃষকের এই চিত্র মোটামুটিভাবে সারাদেশের কৃষকের ক্ষেত্রেই কমবেশি প্রযোজ্য। গ্রামীণ বাংলার আকাশে কান পাতলে শোনা যায় অসংখ্য কৃষকের নিরুপায় আহাজারি। কৃষিতে আজ চলছে নীরব হাহাকার, তীব্র অসন্তোষ, চরম হতাশা। এ দেশে কৃষক তার পেশা নিয়ে স্বস্তিতে নেই। কৃষক তার সন্তানকে আর কৃষিকাজে লাগাতে চান না। এ দেশের কৃষক যেন কেঁচির উভয় ধারে রক্তাক্ত হচ্ছে। একদিকে ভরা মৌসুমে কমদামে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে অন্যদিকে কৃষি উপকরণের বাড়তি দাম তার পকেট কাটছে। এ দেশের কৃষক আজ জমি থেকে পথে বসতে চলেছে। উন্নয়নের সব সূচক উজ্জীবিত হলেও কৃষক হয়ে যাচ্ছেন দিনে দিনে নির্জীব। তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন তো দূরের কথা দিনে দিনে কপাল পুড়ছে।
দেশের কৃষি বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং তার ভয়াবহতা সকলের জানা। একজন কৃষক কী পরিস্থিতিতে আর কতটা ক্ষোভে দুঃখে হতাশায় তার রক্ত পানি করা কষ্টে উৎপাদিত নিজের সন্তানতুল্য ফসল ক্ষেতেই পুড়িয়ে ফেলতে পারে সেটা অনুমেয়। যে কৃষকরা বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য ফলিয়ে মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়, আমাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে, তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পেতে আন্দোলন করতে দেখাটা চরম হতাশাজনক। যে ধান কৃষকের প্রাণ সেই ধানের দাম না পেয়ে কৃষক রাস্তায় ধান ছিটায়, ক্ষেতে পুড়িয়ে দেয়, দুধের দাম না পেয়ে কৃষক রাস্তায় দুধ ঢেলে দেয়, খামারি গরুর দাম না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। দাম না পেয়ে এক বুক হতাশা নিয়ে মাথায় হাত আর অশ্রু বিসর্জনে কৃষকের সব আশা শেষ হয়ে যায়। কৃষি পণ্যের বেলায় বাজারের দোহায় দিয়ে সরকার অনেকটাই হাত গুটিয়ে রাখে। প্রশ্ন জাগে, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে কি কৃষি সব সময় বাজারের কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে থাকে?
এ প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করেছিলাম নেদারল্যান্ডসের একজন কৃষকের কাছে। ২০১০ সালে উন্নত দেশের কৃষি এবং গ্রামীণ জীবন স¤পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য নেদারল্যান্ডসের একটি গ্রাম পরিদর্শনে যাই। সে দেশে থাকা প্রায় দুই বছর বসবাস করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সেখানে বাজারে কৃষি পণ্যের মুল্য ভীষণ স্থিতিশীল। দীর্ঘ এই সময়ে বাজারে কখনো দেখে নি চালের দাম, আলুর দাম, ডাল দুধ কোনটির মুল্যই কখনো বেড়েছে বা কমেছে তবে বরং মাঝে মাঝে ডিসকাউন্টে কিছু কমে পাওয়া যেত। সেই অভিজ্ঞতা থেকে একজন কৃষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে দাম নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয় কিনা। তিনি জানালেন না কখনো সেটি ঘটে না কারণ তাদের এলাকার কৃষকরা মিলে আগে থেকেই বিভিন্ন সাপ্লায়ার কো¤পানির সাথে চুক্তি করে কি দামে কতটুকু পণ্য সরবরাহ করা হবে। ফলে পণ্যের বাজার নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তাছাড়া কৃষি উপকরণের দামও স্থিতিশীল থাকে ফলে উৎপাদন খরচ মোটামুটি স্থির থাকে। একটি পুঁজিবাদী দেশে একজন কৃষককে পণ্যের দাম নিয়ে মোটেও ভাবতে হয় না, দুশ্চিন্তা তো দূরে থাক।
কৃষকরা অনেকটায় নিরুপায়। তারা সংগঠিত নয়। তারা চালের আড়তদারদের মতো সরকারের চালের দাম বেঁধে দেবার প্রতিবাদে চাল বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে না, রোগীর আতœীয়ের দ্বারা লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ডাক্তারের মতো রোগী দেখা বন্ধ করে দিতে পারে না। দুঃখজনক হলো, কৃষি প্রধান দেশ হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃষকের প্রতিনিধিত্ব নেই। আমাদের পার্লামেন্টে কৃষকের জন্য কোনো সংরক্ষিত আসন নেই। যে দেশের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি কৃষি সে দেশের পার্লামেন্টে কৃষক থাকবে না সেটা মানায় না। এ বিষয়ে আমাদের কৃষকদের সরব হতে হবে। দাবি তুলতে হবে। নানাসময় কৃষক যখন সঙ্কটে পড়ে তাদের কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ চোখে পড়ে কিন্তু সুসংগঠিত কোনো দাবি কৃষকের পক্ষ থেকে আসে না যেমনটি সম্প্রতি ভারতের কৃষকেরা তাদের স্বার্থ আদায়ে সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে নেমেছে।
পরিশেষে, কৃষি না বাঁচিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়, এসডিজি অর্জন হবে না। আমাদের টেবিলে তিনবেলা খাবার জুটবে না- খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক, এমএস স্বামীনাথন বলেছেন কৃষি যদি ঠিকঠাক না চলে তবে অন্য কোনো কিছুই ঠিকমত চলবে না। সুতরাং এখন সময় এসেছে সরকারকে প্রকৃত অর্থে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা। কেননা কৃষি বাঁচলে দেশের মানুষ বেঁচে থাকবে। কৃষি পথ হারালে জাতি দিশেহারা হয়ে পড়বে।
লেখক: অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।