মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদা খাদ্য। কিন্তু মানুষের এই চাহিদা কারা পূরণ করছে? কিভাবে পূরণ করছে? কৃষক নিজের অথবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কিংবা শ্রম দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত থাকেন। তিনি উৎপাদক শ্রেণীভুক্ত জন। তারাই ভোক্তা, যারা কোনো পণ্যের শেষ ব্যবহার নিশ্চিত করে থাকেন। মধ্যস্বত্বভোগী হলো সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা উৎপাদকের পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখে। এরা উৎপাদক থেকে সরাসরি কৃষিপণ্য কিনে বাজারে ভোক্তার কাছে বিক্রি করে।
উৎপাদক শ্রেণীর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, ভোক্তা শ্রেণীর অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য ক্রয় এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কিংবা কারসাজি নতুন খবর নয়। বহুল আলোচিত এই বিষয়টির মধ্যে অভিযোগের তীরটি সর্বদা মধ্যস্বত্বভোগীদের দিকেই থাকে। বলা হয়, বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কিংবা কারসাজির কারণে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ে পণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। বাজারে সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই অথচ কৃষকের লাভ পাওয়া দূরের কথা উৎপাদন খরচ ওঠানোই তাদের পক্ষে কঠিন হয়। নানা অজানা কারণে ভোক্তাকে অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। ফলে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয় শ্রেণীর মধ্যেই নানামুখী বিরূপ প্রভাব ও হতাশা দেখা দেয়।
চাল, সবজি, ফল-ফসলাদী এসব পণ্য বাজারে চড়া দামে বিক্রি হলে স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে এতে উৎপাদক কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তার হাতে পৌঁছায়। এতে চড়া মূল্যে বিক্রি হওয়া পণ্যের বাড়তি অর্থ যায় মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে। বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে কৃষকরা হন ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণত ধারণা করা হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিক মুনাফা অর্জনের প্রবণতা এবং সরকারি অব্যবস্থাপনা কারণে উৎপাদক, বিক্রেতা ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা না থাকা এই অবস্থার জন্য দায়ী। বাজার বিশ্লেষকদের মতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিভিন্ন অন্যায় যুক্তি দাঁড় করিয়ে উৎপাদক আর ভোক্তার পকেট কাটে। ভালো ফলন সত্ত্বেও ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে কৃষকের জীবিকা সংকট কাটে না। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চড়া দাম গোনেন ভোক্তা আর ঠকেন কৃষক। এমতাবস্থায় দু’পক্ষই আছে উভয় সংকটে।
কৃষক ও ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় কথা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় নি; বিদ্যমান বাস্তবতা এরও সাক্ষ্যবহন করে। কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যে ন্যায্য দাম পায় না। ভোক্তা উচ্চ মূল্য দিয়ে পণ্য ক্রয় করে। মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে মুনাফার অধিকাংশ অর্থ চলে যায় ইত্যাদি অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও লেখালেখি, সভা- সেমিনার অনেক হয়েছে। কোনো পক্ষ যাতে ক্ষতির মুখোমুখি না হয়, সেজন্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। সরকার বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন মুনাফার হার ধরে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে আসছে। কোনো কিছুতেই খুব একটা ফল হয় নি। মূল সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। কারণ কি? সদিচ্ছার অভাব নাকি ভুল বিশ্লেষণ? সময় উপযোগী সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা? নাকি দুর্নীতি এবং একে অপরের উপর ‘ব্লেইম গেম’ খেলা। ঘটনা যাহোক দিন শেষে ফলাফল উৎপাদক-ভোক্তা উভয়ই বঞ্চনার স্বীকার।
কৃষকের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। হতাশ কৃষকরা পেশা বদল করার ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় মারাত্মক সংকট তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরণের এইটাই উপায়, কৃষকের সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করা। কৃষকের পণ্য যাতে সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারে সেজন্য দেশের বিভিন্ন শহর-বন্দরে সরকারি উদ্যোগে আধুনিক বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা। কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয় কিনা সেদিকেও সরকারকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। অসৎ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অবসানে কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকেও নজর বাড়াতে হবে। খাদ্যপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে উন্নত বিপণন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। কৃষিনির্ভর আদর্শ বাজার ব্যবস্থা কিংবা বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগই বিদ্যমান বৈপরীত্য ঘোচাতে পারে।
কৃষকরা যেন তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় সে ভাবনা থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষ্যে ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের তাগিদ দিয়েছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন পূরণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতির মাঝেও কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং উৎপাদক, বিক্রেতা ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সর্বোচ্চ স্বার্থরক্ষা এবং মধ্যস্বত্বভোাগীদের অনৈতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার মুনাফার সর্বোচ্চ হার বেঁধে দিয়েছে। মুনাফার সর্বোচ্চ হার হবে উৎপাদক পর্যায়ে ৩০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৩০ শতাংশ। কোনো পর্যায়ে নির্ধারিত হারের বেশি মুনাফা নিলে সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
আইনে বলা হয়েছে, কৃষি উপকরণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি বা নির্ধারিত হারের বেশি মুনাফা গ্রহণ করলে এক বছরের কারাদন্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে শাস্তি হবে দ্বিগুণ। আইন অনুযায়ী বিধিমালায় জাতীয় কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি, জেলা কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি, উপজেলা কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি এবং বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন এবং কার্যাবলি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মনে করা হচ্ছে এই বিধিমালা যথাযথ কার্যকর হলে প্রতিটি পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরা বিপণন পর্যন্ত মনিটরিং কার্যক্রমের আওতায় আসতে পারে। কিন্তু এত কিছুর পরেও সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। তাহলে মূল সমস্যাটা কোথায়?
বাজারে উত্তাপ ছড়ায় বাজার মূল্য। সেই মূল্য যৌক্তিক কিনা তা নিয়ে থাকে সংশয়। এর পেছনে একটি মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট আছে বলে অভিযোগ থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মধ্যস্বত্বভোগী আসলে কারা? ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা স্তরেই আছেন এই মধ্যস্বত্বভোগী। এরা যেন সব কিছুর নিয়ন্তা। বলা হয় এদের কারণেই উৎপাদক ও ভোক্তা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয়, লাভবান হয় শুধু মধ্যস্বত্বভোগীরা। ব্যবসার প্রতিস্তরেই রয়েছে ক্রয় ও বিক্রয়। একপক্ষ বেচেন অন্য পক্ষ কেনেন। এভাবেই কয়েক স্তর অতিক্রম করে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য পৌছায়। সাধারণত ধারণা করা হয় একজন বিক্রেতাই সমস্ত বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, প্রকৃতপক্ষে এটা কি সর্বাংশে সঠিক? বিক্রেতা একাই কিভাবে সমস্ত বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে? বিক্রেতাকে সচেতন থাকতে হয় পণ্যের মূল্য যেন এত বেশি না হয় যাতে তার নতুন প্রতিযোগী তৈরি হয়। কারণ যে কোনো ব্যবসা নতুন নতুন প্রতিযোগীর জন্ম দেয়। আসলে বাজারকে না বুঝে বাজার সংকটের সমাধান করা যাবে না। যদি না বুঝলে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেটা অকার্যকরই থেকে যাবে। বাস্তবতা বহির্ভূত সমাধানগুলো না নিয়ে সংকট সমাধানে বাজারকে আগে বুঝতে হবে। উৎপাদক থেকে ভোক্তা প্রতিটি স্তর বিশ্লেষণ করে বাস্তবসম্মত সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
কৃষিসহ যে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে ছোট-বড় অনেকগুলো স্তর রয়েছে। উৎপাদক হতে শুরু করে পাইকার, আড়তদার, মজুদদার, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকারী ও রফতানিকারক সারা দেশে বিস্তৃত। যিনি পণ্য উৎপাদন করবেন তিনি জমি তৈরির সময় যেমন বীজ, সার, পানি ইত্যাদি বিভিন্ন স্তর থেকে সংগ্রহ করেন তেমনি উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করার সময় তাকে বিভিন্ন স্তর ব্যবহার করতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাধ্যম বা মধ্যস্বত্তভোগীদের সাহায্য ছাড়া এককভাবে অসম্ভব। অর্থনীতিতে কৃষি সবচেয়ে বড় ব্যক্তি খাত। কৃষির ক্ষেত্রে দেশব্যাপী প্রভাব পড়বে এমন সিন্ডিকেট বানানো অসম্ভব। কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থা পুরো অনুধাবন না করেই সব সংকটের দায়ভার সরাসরি মধ্যস্বত্তভোগী ব্যবসায়ী ও সরকারের ওপর আরোপ করা হয় যা স¤পূর্ণ ভুল বিশ্লেষণের ফল। যখনই কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয় সাথে সাথে সংকটের কারণ হিসাবে ‘বাজার তদারকির অভাব’, ‘ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার প্রবণতা’, ‘সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব’, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পরিকল্পনা নেই’, ‘মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়ায়’, ‘কৃত্রিম সংকটে মূল্যবৃদ্ধি’ ইত্যাদি বলে মূল সমস্যার সমাধান না করে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বাজার অস্থিতিশীল’ এই শিরোনামে মিডিয়া থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই সংকটের মূল খলনায়ক রূপে মধ্যস্বত্বভোগীদের টার্গেট করা হয়। ব্যবসায়ী শ্রেণীভুক্ত হলেও ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ শব্দটি আমাদের দেশে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যা অবশ্যই বাজারবান্ধব শব্দ নয়। ‘উৎপাদন’, ‘ঘাটতি’, ‘চাহিদা’, ‘সরবরাহ’ ও ‘ভোক্তা’ এইসব নিয়ে তৈরি হয় বাজার। বাজারে যদি কোনো পণ্য ঘাটতি হয় বা পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় তখন বুঝতে হবে উৎপাদন চাহিদা বা সরবরাহের কোনো এক স্তরে সংকট তৈরি হয়েছে। সেটা কৃত্রিম হোক বা প্রাকৃতিক হোক। শুধুমাত্র মধ্যস্বত্বভোগীদের দোষ দিয়ে একপেশে মন্তব্য করা বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ নয়। মনে রাখতে হবে বাজারের প্রধান তিন শ্রেণি- উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। কারণ কৃষক পর্যায়ে খাদ্য শস্য সংরক্ষণ করা হয় হয় না। কৃষিপণ্যের মজুদদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাজার কার্যক্রম। মজুদদারির কারণেই অমৌসুমে ভোক্তারা কৃষিপণ্য পেয়ে থাকেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্যই ভোক্তারা দূর অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য নিজের এলাকায় পেয়ে থাকেন। ব্যবসায়ী মধ্যস্বত্ব ভোগীরাই যারা সারা বছর পণ্য সরবরাহের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন দূর্যোগ ও কয়েক স্তরের অর্থ ঝুঁকি নিয়ে মৌসুমের ফসল যেন অমৌসুমেও পাওয়া যায় সে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সংরক্ষণের সময় কিছু খাদ্য শস্য নষ্ট হয়। বিশাল ইনভেস্ট করার জন্য তাকেও প্রয়োজনে ঋণ গ্রহন করতে হয়। সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহণ, বাজারজাতকরণ এই পরিক্রমায় অমৌসুমে দাম বাড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয়। দোষারোপ না করে চড়া মূল্যে বিক্রি হওয়া পণ্যের বাড়তি অর্থ, মধ্যস্বত্বভোগীর একক পকেটে না গিয়ে যা আসলে চাঁদাবাজী, উচ্চ পরিবহণ মূল্য, ব্যাংক ঋনের উচ্চ হারের সুদ, কর্মচারিদের বেতন ইত্যাদি বিভিন্ন খাতেও যায় এটা বিবেচনা করে দেখা উচিত।
চাহিদা ও জোগান বিশ্লেষণ করলে বোঝ যায় বাংলাদেশ অর্থনীতি বিশেষভাবে কৃষির সঙ্গে স¤পৃক্ত। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের অবস্থা এখন সঙ্গীন। অপার সম্ভাবনার এ খাতটি অবহেলার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। যারা দিন-রাত ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পরিশ্রম করে জমিতে ফসল ফলায়; তারাই প্রতি বছরই কষ্টে অর্জিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না এবং সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হন।
প্রান্তিক কৃষকেরা যাতে ন্যায্যমূল্য পেতে পারে এবং সেই সাথে ভোক্তারা যাতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী সহজে ও স্বল্প সময়ে এবং সঠিক মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য পেতে পারে সে লক্ষ্যে একটি সহজ ও উন্মুক্ত বাজার তৈরি করতে হবে। যা মডেল হিসাবে প্রতিটি লোকালয়ে স্থাপন করা যেতে পারে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। উৎপাদক তার পণ্য নিয়ে সরাসরি বাজারে উপস্থিত হবেন ভোক্তা নিজেই বাজার থেকে পণ্য কিনে আনবেন। এটা থিওরি হিসাবে খুবই সুন্দর কিন্তু বাস্তবতা হলো ভোক্তা কি একটি বাজারে তার সব প্রয়োজনীয় পণ্য পাবেন? সব এলাকাতে কি সব পণ্য উৎপাদন হয়? এক্ষেত্রে এক জায়গার পণ্য কিনে অন্য জায়গাতে নিয়ে বিক্রয় করতে হলে অবশই একটি মাধ্যম প্রয়োজন। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য যথাসময়ে বাজারজাত করতে পারেন না। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীই বাজার সরবরাহের গুরুদায়িত্ব পালনের ঝুঁকি বহন করে।
মধ্যস্বত্বভোগীদের সহায়তা ছাড়া কৃষকদের পক্ষে উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতের প্রতিটি পর্যায়ের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কঠিন। কৃষক ও উৎপাদক উভয়কেই তাদের পণ্য বাজকারজাতকরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে মধ্যস্বত্বভোগীদের অনুপস্থিতিতে আমাদের বাজার ব্যবস্থা পরিচালনা করা অসম্ভব, যদি না তাদের বিকল্প কোনো মাধ্যম বা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। কারণ যিনি বা যারা এই মাধ্যম হবেন সেটা ব্যক্তি, সমবায়, কর্পোরেট বা সরকার যারাই হোন না কেন তারাই আবার মধ্যস্বত্বভোগী হিসাবে চিহ্নিত হবেন। সমস্ত দিক বিবেচনা করে এমন একটি সমাধান করতে হবে যাতে উৎপাদক, মধ্যস্বত্বভোগী ও ভোক্তা সমস্ত স্তরেই সমতা রক্ষা করা যায়। আমাদের দেশের বেশিরভাগই লোকের আয়ের অনেক বড় একটা অংশ চলে যায় খাদ্যের খরচে। তাদের কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের সময় এসেছে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করার।
একটি সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে, যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে কৃষক ও ভোক্তার হাতের নাগালে রাখবে। একই সময়ে প্রাথমিক উৎপাদনকারী যে, সেও যেন দাম পায়। এটা যদি কোনোভাবে করা যায়, তবে অনেক ভালো হবে। সহজ মনে হলেও বিষয়টা কিন্তু খুবই জটিল। সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যেমন উৎপাদক পর্যায়ে বড় ধরনের বাজারজাতকরণ কো-অপারেটিভ করা যেতে পারে। জাতীয় কমিশন লভ্যাংশের বণ্টন ছাড়াও কৃষকদের পণ্যমূল্য পরিশোধ, স্থানীয় বাজারের চাপ, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজী, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ে অস্থিতিশীলতা ও কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে যেসব বাধা, ভোক্তাদের দুর্ভোগ সেসব দিকে বিশেষ নজরদারীর ব্যবস্থা করবেন। আর এক্ষেত্রে সমস্ত দোষারোপ মধ্যস্বত্বভোগীদের করার মানসিকতা ত্যাগ করে সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা তাদের পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের মাধমে সারা দেশে সরবরাহ তথা বিক্রির সুযোগ গ্রহণ করবেন। অসাধু ব্যবসায়ীদেরও অতিরিক্ত মুনাফা লাভের লোভ পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে না পারে কমিশন সরকারের সহযোগীতায় সেদিকে কড়া নজর রাখবেন।
কৃষিপণ্য সহজে প্রাপ্তি ও বাজারজাতের সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় হিসেবে যে বিষয়গুলোর ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বীজ, সার ইত্যাদি সংগ্রহ, অপচয়রোধ ও মানস¤পন্ন পণ্য সরবরাহ করা। দেশের প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্তসংখ্যক কৃষিপণ্য সংগ্রহাগার ও আধুনিক হিমাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া। প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন কৌশলের ওপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দক্ষ করা। সরাসরি বাজারজাতের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের অপ্রয়োজনীয় প্রভাব কমিয়ে উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের এমন ব্যবস্থা করবেন, যাতে উভয় পক্ষই লাভবান হতে পারে। এছাড়াও উৎপাদক পর্যায়ের মূল সমস্যাগুলো: ক্ষেতমজুরদের মজুরির হার সব জায়গায় অভিন্ন না থাকা, কৃষি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহার, গ্রামে কর্পোরেট পুঁজির প্রবেশ, নিরক্ষরতার কারণে কৃষকদের সংগঠিত হতে না পারা, কৃষক উপযোগী বাজারজাতকরণ পলিসি না থাকা, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সততার অভাব, জবাবদিহিতার অভাব ও দুর্নীতি, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, কৃষকদের প্রযুক্তি গ্রহণ করার নেতিবাচক মানসিকতা ইত্যাদি চিহ্নিত করে সময়পোযোগী সমাধান বের করা। আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধ ও সহযোগীতামূলক ভাতৃত্ববোধ। একে অপরের ওপর সহনশীলতা ও নির্ভরশীলতা।
লেখক: গবেষক