আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধের পর আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা দেশটি ছেড়েছে। বিশ বছর আগে কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের নামে মিত্র দেশের সেনা ও ন্যাটো বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে দুই দশকে কখনও শান্তির দেখা মেলে নি। বরং বছরের পর বছর তাড়া খেয়ে বেড়ানো তালেবানই আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
২০২১ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক ঘোষণায় বলেছিলেন, মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তান ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। ব্রিটেনও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০ বছর আগে ১১ সেপ্টেম্বরেই আল কায়েদা আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা চালায় যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল আফগানিস্তানেই। হামলার নেতৃত্বও দেওয়া হয় সেখান থেকে। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক কোয়ালিশন আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আল কায়েদাকেও সাময়িকভাবে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করে। কিন্তু গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতার জন্যে আমেরিকাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
বিশ বছরের এ যুদ্ধে আফগানিস্তানে ২ হাজার ৩শ’ মার্কিন সেনা মারা গেছে। আহত হয়েছে ২০ বিশ হাজার সেনা। অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনা মারা গেছে ৪৫০ জন। এর বাইরে আরও কয়েকটি দেশের কয়েকশ’ সেনাও প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে এই যুদ্ধে বহুগুণ বেশি হতাহত হয়েছে আফগানরা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য মারা গেছে। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তারও দ্বিগুণ। আফগান যুদ্ধের জন্য মার্কিন করদাতাদের প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার জোগান দিতে হয়েছে।
ফলে এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে এই প্রাণহানি আর বিপুল অর্থ খরচের আদৌ কি কোনও দরকার ছিল? পশ্চিমা দেশগুলো কেন আফগানিস্তানে গিয়েছিল? কি ছিল তাদের লক্ষ্য? তারা আসলে কি অর্জন করতে চেয়েছিল? সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর শুরু হওয়া রক্তাক্ত এক গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, তাদের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল।
১৯৯৬ থেকে পরের পাঁচ বছর ধরে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল কায়েদা আফগানিস্তানে স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসেছিল। সেখানে তারা সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলে। কুকুরের ওপর বিষাক্ত গ্যাসের পরীক্ষা শুরু করে। বিভিন্ন দেশ থেকে কমবেশি বিশ হাজার জিহাদি স্বেচ্ছাসেবী জোগাড় করে আফগানিস্তানে এনে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। ১৯৯৮ সালে আল কায়েদা কেনিয়া এবং তানজেনিয়ার মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। সে হামলায় মারা পড়ে ২২৪ জন মানুষ। আল কায়েদা সে সময় আফগানিস্তানে কোনও বাধা ছাড়াই তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পেরেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র সৌদি আরবের মাধ্যমে তালেবানকে রাজি করানোর চেষ্টা করে তারা যেন আল কায়েদাকে আফগানিস্তান থেকে তাড়ায়। কিন্তু তালেবান তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্দেহভাজনদের ধরে তাদের হাতে তুলে দিতে আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলো তালেবানকে চাপ দেয়। তখনও তালেবান সেটা মানতে অস্বীকার করে। তখন আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নরদার্ন আ্যালায়ান্স নামে তালেবানবিরোধী একটি আফগান মিলিশিয়া গোষ্ঠী অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তারপর আল কায়েদা পালিয়ে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আশ্রয় নেয়। বিশ্ব গণমাধ্যমগুলো থেকে জানা যায়, তারপর থেকে বিশ্বের কোথাও একটিও সফল কোনও সন্ত্রাসী হামলা হয় নি যার পরিকল্পনা হয়েছে আফগানিস্তানে। ফলে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতার বিবেচনায় আফগানিস্তানে পশ্চিমা সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতা কাজে দিয়েছে।
কিন্তু গেল বিশ বছরে যে করুণ পরিণতি আফগান জনগণকে সামরিক এবং বেসামরিকভাবে ভোগ করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, সে বিবেচনায় ওই নিরাপত্তা সাফল্য ম্লান হতে বাধ্য।
অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স নামে একটি গবেষণা সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালেও বিশ্বের যে কোনও দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে বিভিন্ন বিস্ফোরকের আঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আল কায়েদা, আইএস এবং আরও বহু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সে দেশ থেকে নির্মূল হয় নি। উল্টো তাদের শক্তি ধীর গতিতে হলেও বেড়েছে। তালেবান এখন আবারও পুরো আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের প্রধান নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে।
এখন সামনের দিনগুলোতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত, অস্বচ্ছ। তবে এটাও ঠিক ২০০১ সালের পর কে ভেবেছিল এই যুদ্ধ ২০ বছরেও শেষ হবে না?
তথ্য সূত্র: ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি ও এবিসি নিউজ।
লেখক: সাংবাদিক