নহরা খান নিয়ন্তা
১২ জুন, মাধ্যমিক ২০২২ ব্যাচের আনুষ্ঠানিক বিদায় অনুষ্ঠান শেষে আবেগতারিত হয়ে বাসায় ফিরে মনে হলো, ‘যাক! অবশেষে পরীক্ষা হচ্ছে।’
বাংলায় একটু দুর্বল বলে তড়িঘড়ি বাংলা পড়া শুরু। ১৭ তারিখ সকালে উঠে মনে হলো ১৯ তারিখে পরীক্ষা দিতে কোনও সমস্যা হবে না। প্রস্তুতি যা আছে, ভালো করতে পারবই। খুব যত্ন করে রুটিন অনুযায়ী টেবিল গোছালাম। হঠাৎ দুপুর ঠিক একটার দিকে এক বন্ধু ফোন দিল। আমার তো মন খুবই ভালো, প্রস্তুতি ভালো, সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছি, আত্মবিশ্বাসের কোনও ঘাটতি নেই। ফোনটা ধরেই উৎফুল্ল কণ্ঠে কথা শুরু। কিন্তু বন্ধুর কন্ঠে উৎফুল্লতার চিহ্ন নেই। বলল, তাড়াতাড়ি টেলিভিশন খুলতে। টেলিভিশন খুলে তো হতভম্ব! ১৯ জুনে নির্ধারিত মাধ্যমিক পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে!
স্থগিত করার কারণ হলো সিলেটে বন্যার বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সিলেট বোর্ডের হাজার হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারবে না। তারপরেও কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের কষ্টটাই সবচেয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়াল। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বারবারই মনে হতে লাগল, ‘আর কত?!’
২০২০ সালের ১৬ মার্চ থেকে শুরু করে প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত লকডাউন। শুরুর দিকে মনে হতো এই বুঝি স্কুল খুলে যাবে! তাহলে আরেকটু মজা করতে বাধা কোথায়? কিন্তু দু মাস যাওয়ার পরে বোঝা গেল বাস্তবতা আরও বেশি কঠিন। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা শুরু করতে হয়েছিল। স্কুলে এবং কোচিংয়ে তখন অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করে মোবাইল-ল্যাপটপ-ইন্টারনেট সবকিছু সারাদিনের জন্য হাতে পেয়ে লেখাপড়াকে কোনও পাত্তাই দিতে ইচ্ছা করত না। ক্লাস করতাম কিন্তু ক্লাসের থেকে দুষ্টামিটাই বেশি চলত যেন।
বাবা-মা, শিক্ষক, প্রত্যেকটা মানুষ আমার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। শুধুমাত্র ভালো সম্পর্ক রয়ে গিয়েছিল বন্ধুদের সাথে কেননা সারাদিন ওদের সাথেই কথা বলা হতো। কিন্তু যতই সারাদিন কথা হোক না কেন অনলাইনকে অনলাইন ছাড়া বাস্তব কিছু ভাবা যায় না। যে কথাটা বাস্তবে বললে হয়ত বা মজা করে বলা যেত সেটা অনলাইনে চ্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে শোনাতে লাগল জঘন্য। সেইরকম জঘন্য সব কথার হাত ধরেই বন্ধুত্বে আসতে লাগল বিভিন্ন ভুল বোঝাবুঝি। ভেঙে গেল কিছু বন্ধুত্বও। যে বন্ধুদের সঙ্গে কখনই কোনও দূরত্ব হবে আশা করি নি, তাদের সঙ্গেও বিপুল সব কথার কাটাকাটি।
২০২১-এর শুরুর দিকে এসে বুঝতে পারছিলাম ভালো বন্ধুদের সাথেও আস্তে আস্তে সম্পর্ক কেটে যাচ্ছে। ২০২০-টা কোনও ভাবে ভালোয় ভালোয় কাটিয়ে দিতে পারলেও ২০২১-টা গেল খুবই বাজে। মার্চে এক মাসের জন্য কোচিং খুলেছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই আবার বন্ধ হয়ে গেল। আমরা হঠাৎ করে বিভ্রান্তের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করেছিলাম। কিছুই ভালো লাগত না। বই পড়া তো দূর, বইগুলো যে ধরে ছিঁড়ে ফেলতাম না, সেটাকেই একরকমের অর্জন বলে মনে হতো। গান ছাড়া একটা বেলাও যেখানে কাটত না, সেখানে গান শোনাও বন্ধ। বাসার মধ্যে থেকেও হাঁপিয়ে উঠছিলাম। যখনই টেলিভিশনে কেউ বলতেন খুব শীঘ্রই স্কুল খুলে দেওয়া হবে, আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তাম। কেননা ততদিনে কথাটার আবেদন আমাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছিল।
২০২১-এর মাঝের দিকে এসে স্কুল এবং কোচিং দুটোই খুলে দিয়েছিল। তারপরেও ২০২২-এর এপ্রিলের আগ পর্যন্ত মনে হয় নি লেখাপড়া আমার করা দরকার। এপ্রিলের শুরুতে এসে মনে হলো একটু বইটা ধরে দেখি কি আছে তার মধ্যে! বই ধরে যেটা আবিষ্কার করলাম, সবই পারি, কিন্তু কিছুই পারি না। মানে হলো, প্রত্যেকটা বিষয়ই আমার জানা কিন্তু পরীক্ষার খাতায় লেখার মতো দক্ষতা আমার নেই। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বসে বসে সে দক্ষতা অর্জন করা গেল। মনে হলো, মাত্র দুই মাসে পুরো সিলেবাসটাই নতুন করে আবার শিখলাম। ভাবতে ভালো লাগত, পূর্ণ প্রস্তুতি আমার আছে। পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে নিয়ে কোনও ভয় মনে কাজ করবে না।
কিন্তু এবারে যখন টেলিভিশনে জানালো পরীক্ষা আবার পেছানো হয়েছে, তখন আর বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞানটুকু আর থাকলো না। পুরো চারটা দিন মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত এক মানুষের মতো কাটাল। ইচ্ছে হলো বই-খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলে বইখাতা থেকে সাধ্যমতো দূরে থাকলাম। গেল দু বছরে গল্পের বই পড়ার অভ্যাসটা মোটামুটি হারিয়েই গিয়েছিল কিন্তু তারপরেও গোটা আটখানা উপন্যাস চার দিনে পড়ে শেষ করে ফেললাম। বাবা-মাকে বললাম, ‘আমি অনেক পড়েছি। আমার আর পড়তে ভালো লাগছে না। পড়তে বসলেও আমি পড়তে পারব না। তোমরা প্লিজ আমাকে কিছু বলো না।’ বাবা-মা আসলেই কিছু বললেন না।
তারপর হঠাৎ একদিন সিলেটের বন্যার পরিস্থিতির কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ জেলাই অতিবৃষ্টির কারণে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনাসহ আরও অনেক এলাকা এখন বন্যার সবচেয়ে নিষ্ঠুর দিকটির ভুক্তভোগি। সবমিলিয়ে ৪০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি এলাকাগুলোর সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আর আমাদের সমবয়সী একজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মারা গেছে।
তখন মনে হলো, বন্যা থেকে এত দূরে থেকেও পরীক্ষা পেছানোর জন্য মন খারাপ করে আছি কিন্তু ওরা যারা এই দু বছর কষ্ট করেছে, তারাও তো পরীক্ষা দিতে পারছে না। আর এখন এই বন্যায় তাদের নিশ্চয়ই আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। সত্যি বলতে কি, ওদের কষ্টে খুব দুঃখ লাগছে, এইটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে পরীক্ষা পেছানোর ফলে আমার কষ্টটা তো এক ফোঁটাও কমে নি।
দুঃখে, কষ্টে, অভিমানে গত দু মাসে যা পড়েছিলাম, যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছিলাম সব ধীরে ধীরে যেন ধূলোয় মিশে যাচ্ছে। হতাশা ঘিরে ধরেছে আমাকে। আদৌ কি এই জীবনে মাধ্যমিকটা দেয়া হবে? অনেকে আমাদেরকে ঠাট্টা মেশানো কটাক্ষে ডাকছে ‘মাধ্যমিক থার্ড ইয়ারস্’।
না, সিলেট বোর্ডের জন্যই আমাদের পরীক্ষা দেওয়া হলো না- এমনটি ভেবে তাঁদেরকে আমরা দায়ী করছি না। দায় আসলে কিছুটা নিয়তিকেই দিচ্ছি। দিয়ে আমরা নিজেরাই এখন খুব হতাশ হয়ে গেছি। এখন মাথায় হাত দিয়ে কপাল চাপড়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও গতি আমাদের নেই। আশা করছি যেন সিলেটসহ পুরো দেশের সমস্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুব শীঘ্রই আমরা সব বাধা ও বাজে নিয়তিকে উপেক্ষা করে যেন সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে মাধ্যমিক দিয়ে কলেজের দরজায় দাঁড়াতে পারি।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কি আমাদেরকে জানাবেন আমরা ‘মাধ্যমিক থার্ড ইয়ারস্’ কিনা?
লেখক: ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী, শ্যামলী, ঢাকা থেকে।
1 Comment
Farjina
অসাধারণ একটা লেখা। বাচ্চাদের জায়গা থেকে এই বিষয়গুলা ভাবি না আমরা।