আজ ৪ জুলাই। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। এ বছর আমেরিকা ২৪৬তম স্বাধীনতা দিবস পালন করবে। গেল দু বছর ছিল করোনা ভাইরাস মহামারির নিষেধাজ্ঞা। সে ভয় এখনও সবটা কাটে নি। নিত্যই খবর আসছে করোনা তার প্রকোপ নিয়ে আবার নতুন করে থাবা বসাচ্ছে। তার সঙ্গে এবছর যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উৎকণ্ঠা আর ভয়। সেকারণে ২৪৬তম স্বাধীনতা দিবসটি এবারে কেমন উদযাপিত হবে সেটি দিনশেষে ছাড়া বলবার উপায় নেই আসলে।
তার সঙ্গে সাম্প্রতিক অস্ত্রবাজদের হামলার কথা যদি আসে তবে মুখে তো রা-টি জুটবে না। বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকতে হবে। কেননা যে কোনও দেশের স্বাধীনতা দিবসটি যখন আসে, তখন সঙ্গে করে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আসে। প্রধান প্রশ্নটি যার রক্তক্ষয় করে নিয়ে আসা স্বাধীনতা কতটা সার্থক হয়ে উঠতে পেরেছে আসলে?
যেমন আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ যে লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, গেল পঞ্চাশ বছরে সে লক্ষ্যে কতটা পৌঁছুতে পেরেছে? এর প্রত্যুত্তর যদি ইতিবাচক হয় তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্থক। কিন্তু যদি নেতিবাচক হয় তাহলে কি ব্যর্থ? না, তাও নয়। সেক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছুতে নিজেকে তৈরি করতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে লক্ষ্যাভিমুখে। লক্ষ্যটি হলো মুক্তিযুদ্ধের চার স্তম্ভ- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর প্রতি বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ এসে সকল বাঙালীকে সে তাগাদটি দিয়ে যায়। হয়ত আমরা শুনতে পাই না। কিংবা শুনতে পেলেও বুঝতে পারি না। অথবা বুঝতে পারলেও দেশপ্রেমের অভাবটা প্রকট বলে পাত্তা দিই না। তারমানে তো এই নয় সকলেই আমার আপনার মতো। তা নয় তো। একদিন কেউ না কেউ ঠিকই কাজটি করতে এগিয়ে আসবেন। হয়ত আমরা দেখে যেতে পারব না, কিন্তু আসবেন। নিশ্চয়ই আসবেন। এটি স্বপ্ন, এটিই স্বাধীনতা। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার মতো স্বাধীনতা মানে আরও আরও অনেক কিছু। কিন্তু বর্ণবাদ কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা নয় কখনও।
ভারতবর্ষের মতো আমেরিকাও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। সেসময় তো বাংলা থাকলেও বাংলাদেশ নামে আলাদা কোনও দেশ ছিল না। ব্রিটিশ মুক্ত হওয়ার পর পঁচিশ বছর পরাধীনতা অস্বীকার করতে করতে, নিজের অধিকার দাবি করতে করতে যুদ্ধ করতে নেমেছিল বাঙালী। না নেমে উপায় ছিল না। যুদ্ধটা অবধারিত ছিল। যুদ্ধে সে জিতেছেও বটে। কিন্তু লক্ষ্যটা এখনও অর্জিত হয় নি। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে, মুক্তিযুদ্ধের চার স্তম্ভ এখনও কাগজেই রয়ে গেল।
আমেরিকার স্বাধীন হয়েছে ২৪৫ বছর হয়ে গেল, ১৭৭৬ সালে। জুলাইয়ের ২ তারিখে ব্রিটিশদের থেকে আলাদা হতে চেয়ে আমেরিকার দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস ভোট দিল। তারপর দুটা দিন কাটল। ৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে পেনসিলভেনিয়া প্রাদেশিক আইনসভায় স্বীকার করে নেওয়া হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া গেল। তবে ব্রিটিশরা চূড়ান্ত স্বাক্ষর করেছিল আগস্টের ২ তারিখে। কিন্তু চূড়ান্ত অনুমোদন ৪ জুলাই এসেছিল বলে এদিনটিতেই আমেরিকা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় ১৭৭৫ সালে। ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত চলে।
১৭৭৫ সালে ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশ স্বাধীনকামী মানুষেরা মিলে ঠিক করল তারা সশস্ত্র সংগ্রাম করবে। স্বাধীনতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। এই উপনিবেশগুলো হলো নিউ হ্যামশায়ার, ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলেয়ার, ম্যারিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, সাউথ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়া। ১৭৭৬ সালের ২ জুলাই তারা সম্মিলিতভাবে ‘ইউনাইটেড অফ স্টেটস’ নামের দেশটির ঘোষণা দিল। ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হলো ৪ জুলাই। এর মাধ্যমে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধরত ১৩ টি মার্কিন উপনিবেশ নিজেদের ব্রিটিশ শাসনের বাইরে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র নামে নামে নতুন রাষ্ট্র গঠন করল।
সেই ১৩টি রাষ্ট্র থেকে এখন আমেরিকার স্টেট ৫০টি। যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। বর্তমানে আমেরিকার জনসংখ্যা ৩২ কোটি ৫০ লাখের বেশি। বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র সাংস্কৃতিকভাবে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশগুলোর একটি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতির প্রভাব আমেরিকার সংস্কৃতিতে রয়েছে। এদেশের সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ইংরেজরা। কেননা ব্রিটিশরা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই এদেশে উপনিবেশ গড়ে তুলতে শুরু করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন উপনিবেশবাসীদের জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ বলেছিলেন, স্বাধীনতা বৃক্ষের জন্য গণতন্ত্রের মতাে ওষুধ দরকার। কিন্তু আজ বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদেশে এখন বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে রাজপথে নামে মানুষ। যে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, ২৪৫ বছর পর এদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ নতুন করে দানা বেঁধে উঠছে। সংখ্যালঘুদের নানাভাবে বিরুদ্ধাচারণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শোনা যায়। গেল বছরে ক্যাপিটাল হিলে হামলা ছিল গণতন্ত্রের ওপর বিশাল এক আঘাত। আরও চমকে ওঠার মতো খবর হলো, এর কলকাঠি নেড়েছিলেন সেসময়ের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি- ডোনাল্ড ট্রাম্প। মানে তাঁরা বিশ্বাস করেন কৌশল-ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের আস্থা নেই।
সাম্প্রতিক সময়ের বন্দুক হামলা আমেরিকায় একটি ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এইত, আজই স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে গুলি চালিয়ে ৬ জন মানুষকে মেরে ফেলা হলো। ২৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কদিন আগে একটি স্কুলে এক তরুণ গুলি করে ১৯ জন শিশু আর দুজন নারী শিক্ষককে মেরে ফেলল। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেল, এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ২৭টি স্কুলে বন্দুক হামলা হয়েছে। এদেশে বন্দুক হামলা এখন গণ-আতংকে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যেই বন্দুক বিক্রির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, বন্দুক আইন করে নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি বটে। কিন্তু মূল সমস্যা তো আসলে বন্দুকে নয়, মূল সমস্যা মানুষেই। কেননা স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করতে পারা নয়। স্বাধীনতা একটি শর্ত। এই শর্ত জাতির কাছে, দেশের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে ও মানুষের কাছে। শর্তটি হলো রাষ্ট্র চলবে একটি নিজস্ব শাসনব্যবস্থায়। আর সকলে সেটি মেনে চলবে। নির্মাণ করবে সার্বভৌমত্ব। লালন করবে পরস্পরের প্রতি সন্মান আর মমত্ববোধ। বন্দুক হলো অবিশ্বাস, হিংসা, আস্থার অভাব, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’। আমেরিকার মুহুর্মুহু বন্দুক হামলা আমাদেরকে জানাচ্ছে, এদেশেটির বেশ উল্লেখযোগ্য একটি অংশ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতায় বস্তুত আস্থা রাখে না, বিশ্বাস করে না।
কিন্তু আমরা হতাশ নই। ২৪৬ বছরের অর্জন এত ঠুনকো নয়, হতে পারে না। আমরা বিশ্বাস করি নতুন যে প্রজন্ম উঠে দাঁড়াচ্ছে তারা এই হিংসাকে আস্থায় বদলে দেবে। এই আমাদের সন্তানেরাই করবে বদলে দেবার কাজটি। ওই তো, দেখুন, কেমন প্ল্যাকার্ড হাতে রাজপথে দাঁড়িয়ে বন্দুকের বিরুদ্ধে বলছে! সকলকে ২৪৬তম ফোর্থ অব জুলাইয়ের শুভেচ্ছা।
সাংবাদিক ও লেখক শাহ্ জে. চৌধুরী আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। নিউ ইয়র্কের রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রধান ব্যক্তি। এছাড়া তিনি অধীনে রয়েছে নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলার সম্পাদক এবং নিউ ইয়র্কের অন্যতম বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা চ্যানেল’-এর চেয়ারম্যান।