সেগুন বাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুস্বর প্রতিনিধি ড. নাজমুন খাতুন বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে
বিশ্বজিত সাহা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। থাকেন নিউ ইয়র্কে। থাকছেন তিরিশ বছর ধরে। পরিচয়টি তাঁর- ‘বইয়ের মানুষ’। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে বইকেই করে নিয়েছেন জীবিকার উৎস। জীবন শুরুও করেছেন বইয়ের সঙ্গেই। তারপর সাংবাদিকতা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
নিউ ইয়র্কে পৌঁছে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হলেন একটি বাংলা ভাষার পত্রিকায়। এরই ফাঁকে গড়ে তুললেন বইয়ের দোকান ‘নিউ ইয়র্ক মুক্তধারা’। চলতে থাকল বই বিক্রি আর সাংবাদিকতা। কিন্তু শুধু এই-ই নয় বিশ্বজিত সাহার পরিচয়। নিজের পেশাগত পরিচয়টিকে ছাপিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কের মাটিতে হয়ে উঠেছেন প্রতিনিধিত্বশীল এক বাংলদেশি নাগরিক।
এবারের একুশে বইমেলায় বিশ্বজিত সাহা এসেছিলেন বাংলাদেশে। এক দুপুরে সেগুন বাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুস্বর প্রতিনিধি ড. নাজমুন খাতুন বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হয়েছিলেন। জানতে চেয়েছেন বিশ্বজিত সাহার কাজ স¤পর্কে। জানতে চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রতিনিধিত্বশীলতার জায়গাটি সম্পর্কে। এখানে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির শেষ কিস্তিটি প্রকাশিত হলো।
অনুস্বর: ওখানকার বাঙালী অভিবাসী যারা তাদের সহযোগিতা কেমন পেয়েছিলেন?
বিশ্বজিত সাহা: ২০১২ সালে আমরা কাজটা করলাম। এরপর থেকে আমাদের জন্য কাজগুলো সহজ হয়ে গেছে। আপনি শুনেছেন, নিউ ইয়র্কে সপ্তাহ দুয়েক আগে একটা স্ট্রিটের নাম হয়ে গেছে লিটল বাংলাদেশ। বাংলা ভাষাভাষী আমাদের এক মেয়ে নিউ ইয়র্কে কাউন্সিল মেম্বার হয়েছে। সে শাড়ি পড়ে কোরান শরীফ নিয়ে শপথ নিয়েছে। এটা হলো, আমেরিকার মূল্যবোধ। আপনি যে কোনো ধর্মেরই হোন, যে কোনো বর্ণের হোন, আপনি শাড়ি পড়েন বা আরেকজন মানুষ কামিজ পড়ে। আপনি হিজাব পড়েন ডাজেন্ট ম্যাটার। এই বহুমুখী সংস্কৃতিটাকে তারা শ্রদ্ধার সাথে দেখে। এ কারণই আজকে আমরা এই অর্জনগুলো করতে পেরেছি।
অনুস্বর: বাংলাদেশ সে জায়গাটা থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
বিশ্বজিত সাহা: প্রত্যেকটা জিনিসের কিন্তু একটা সময় লাগে। আপনি যদি আমেরিকার শাসনতন্ত্র দেখেন, আমেরিকার শাসনতন্ত্র এতবার এত কিছু ডেভেলপ হয়েছে, এত কিছু মানে আপনার স্বয়ংবর হয়েছে যেটা পৃথিবীর অন্য কোথাও নাই। আমি বলি আমরা এক সময় সমাজতন্ত্র করতাম, ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তখন আমরা ¯ে¬াগান দিতাম- ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, সমাজতন্ত্র মুক্তি পাক’। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, খেলাঘর করতাম এগুলো করতাম। যখন আমি আমেরিকায় গেলাম, দেখলাম যে কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নরা যা চায় আমেরিকা সেটা ৫০ বছর আগে করে রেখে দিয়েছে। আমি যাওয়ার পরে আমার হাসপাতালের চিকিৎসা, আমার ছেলেমেয়ের টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত বিনা পয়সায় পড়া, আমার খাওয়া দাওয়ার জন্য, এগুলো আমেরিকা ৫০ বছর আগে ডান করে রেখেছে। আমরা জানতাম না। আমরা লাল বই পড়তাম। লাল বই পড়ে আমরা আমাদের এই জীবনের চেতনা আমি নিজ চোখে দেখি নি। আপনি দেখবেন, নিজ চোখে দেখা আর পড়ে জানা- এটার মধ্যে বিরাট পার্থক্য।
অনুস্বর: আরেকটি বিষয় জানতে চাই। এই যে আপনি প্রতিষ্ঠিত পুস্তক ব্যবসায়ী, এটাই কি আসলে হতে চেয়েছিলেন?
বিশ্বজিত সাহা: না। আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দ ছিল সাংবাদিকতা। আপনাকে বলি। আমার লেখালেখি ছিল আমার সবচেয়ে আনন্দের, গৌরবের। আর প্রকাশক বা পুস্তক বিক্রেতা, এটি আমার কাছে মনে হয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য তো কিছু প্রয়োজন। যদি এ কাজটি আমি না করতাম বা আমি যদি সাকসেস না হতাম তাহলে বাকি কাজগুলো আজকে হতো না। কারণ আমার আগে অনেকগুলো মানুষ, ধরেন আলী রিয়াজ, হাসান ফেরদৌস, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, শহীদ কাদরী, বা সেলিম জাহান বহু মানুষ আমেরিকায় গেছেন, তাই না? ওরা তো মেধার দিক থেকে আমার থেকে কম না, বেশিই, অনেক বেশি। তারা কি কখনো কোনোদিন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা শুধু বলব না, আমি বলব বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো কাজ করেছেন? তারা কাজ করেছেন তার নিজের জন্য।
অনুস্বর: এইখানে আমার আরেকটা প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। সেটা হলো, এই যে আপনি বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করলেন। শহীদ মিনার নিয়ে কাজ করলেন, তারপরে যে রেজ্যুলেশনগুলো আপনি করলেন…
বিশ্বজিত সাহা: শুধু এটুকুই না আপনি দেখেন ছয় বছর, বেয়াদবি নিবেন না, আপনি ২০২১-এ স্বাধীনতার কত ৫০ বছর উপলক্ষে ২০১৬ সাল থেকে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন প্যারেড করা শুরু করে ছ’ বছর ব্যাপী; বাংলাদেশের ৫০ বছর পালন করেছে আমেরিকায়।
অনুস্বর: এটা বাংলাদেশে হয় নি।
বিশ্বজিত সাহা: বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করতে পারে নি। আপনি শুনুন কথাটা। ছ’ বছর আগে আপনি প্যারেড দেখলে দেখবেন, আপনি গুগলে গিয়ে দেখবেন ছ’বছর আগে সি আর দত্তকে দিয়ে আমি উদ্বোধন করে দিয়েছি ২০১৬ সালে।
অনুস্বর: হ্যাঁ, সি আর দত্ত গিয়েছিলেন।
বিশ্বজিত সাহা: হ্যাঁ, স্টার্ট ডু ইট, করব আমরা। এটা আপনাকে কেউ পয়সা দিয়ে করাতে পারবে না। এটা এই জায়গা (বুকে হাতে রেখে) থেকে আসতে হবে। আমি একশ’ বছর দেখব না। আমার ভাগ্য পঞ্চাশ বছর আমি দেখছি। এই পঞ্চাশ বছর আমি রাঙিয়ে দেব। কিভাবে রাঙাব? আপনি আমি সমমনা লোকদেরকে নিয়ে। সমমনা হতে গেলে কি প্রয়োজন? যে যে পয়েন্টে ভালো করে সে জায়গাটা তাকে দিয়ে দিতে হবে।
অনুস্বর: যেটা বলতে চাইছিলাম, আপনি যে এই কাজগুলো করলেন, যদি জানতে চাই কেন করলেন?
বিশ্বজিত সাহা: এটা একদম সহজ। মা যখন একটা সন্তানকে জন্ম দেয় সে কি রিটার্ন পাওয়ার জন্য জন্ম দেয়? মার কি সন্তানের কাছে কোনো রিটার্ন থাকে? মা নিজের জন্যে জীবনে কিছু না চেয়ে সন্তানের জন্য করে। একজন সন্তানের তার মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে আমি মনে করেছি এ কাজটি করা উচিত।
অনুস্বর: শেষ প্রশ্নে যাব, এ প্রশ্নের উত্তরটা আমি চাই-ই। এটা আমাদের জন্য খুব গর্বের একটা ব্যাপার, আশার একটি জায়গা আপনি নিউ ইয়র্কে বসে যে কাজগুলো করেছেন সেটি খুব অহংকারের একটি ব্যাপার। কিন্তু ঠিক এর বিপরীতে আপনি যখন বাংলাদেশের চিত্রটা দেখেন বাংলা নিয়ে সেভাবে কাজ তেমন হচ্ছে না। যেমন আমাদের বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা শিক্ষা, শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমের যে অবনতি- এই যে ব্যাপারগুলো যখন আপনি দেখেন এই ব্যাপারগুলোকে আপনি কিভাবে দেখেন?
বিশ্বজিত সাহা: আপনাকে বলি, এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ভাষার নির্দিষ্ট বলয়ে থাকে যেমন এক সময় আমি খুব হতাশ ছিলাম। ভাষার ক্ষেত্রেও যেমন ধরেন আমাকে পড়াবে কোনটা? কথিত ভাষা, বাংলা ভাষা নামে যে একটি ভাষা, যে এখন নতুন করে কাজ করছে এটি আমাকে খুব ব্যথিত করে। আমি আপনাকে বলি, একটি ভাষার কথিত ভাষা বা কথ্য ভাষা আরেকটি ভাষা হচ্ছে পড়ার জন্য যেটি পুস্তকের ভাষা। পুস্তকের ভাষা দু’রকম হতে পারে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বড় বড় লেখকরা তাদের উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করেছেন।
অনুস্বর: সেটা তো সংলাপে আসছে।
বিশ্বজিত সাহা: আমি সে জায়গার মধ্যেই আসলাম। কিন্তু এখন যে ঘটনাগুলো ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের লেখকরা বা বাংলাদেশের যারা নিজেদেরকে বড় লেখক বা কাজ করেন তারা বাংলাদেশের একটা আলাদা লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। সেটি আমাদের জন্য যেমন গৌরবের তেমনি করে বাংলা ভাষার লেখকরা না বলে বাংলাদেশের লেখক বলাটা আমার কাছে মনে হয়, এটি বাংলাদেশটাকে ছোট করে ফেলছে।
অনুস্বর: আসলে বিষয়টা হলো যে দুই বাংলাতেই…
বিশ্বজিত সাহা: আমি দুই বাংলা বলব না। আমি বলব বাংলা ভাষার লেখক পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন…
অনুস্বর: না না, এ জায়গাটাতে না বলি। আমার প্রশ্নটা ছিল অন্য। আমার প্রশ্নটা ছিল, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রটি, যেমন একজন বাবা-মা চাইছেন বাচ্চাকে তিনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবেন। বাংলার প্রতি এটি কি অবহেলা নয়? আপনি এটাকে কিভাবে দেখছেন?
বিশ্বজিত সাহা: এটা খুব ভালো প্রশ্ন। বাংলাদেশ এখন যে পরবর্তী প্রজন্ম পড়াশোনা করছে, একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি অভিভাবকরা যে নজর দিচ্ছে, কিন্তু এটা বাংলাদেশকে খুব বিপদে ফেলবে। যেমন আমাদের সময় আমরা চিকা মারতে জানতাম, আমাদের সময় আমরা খেলাঘর করতাম, আমরা নাটক করতাম। বাংলাদেশ খুব ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে এসেছে। সেটি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কখনো লক্ষ্য করে নি।
১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশে যেদিন স্কুলগুলো থেকে শরীর গঠন বা কুচকাওয়াজ যেদিন তুলে দিয়েছে, লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, লাইব্রেরি বন্ধ করে সেখানে নামাজের স্থান করেছে। কথাটা মনে রাখবেন। আমাদের ভাইবোনদের ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত। অত্যন্ত পড়াশোনা, অনেক। আমাদের পরিবারে এখন চার পাঁচটা ডাক্তার হয়ে গেছে, ছয় সাতটা বুয়েট থেকে পাস করে বেরিয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় তারা কেউ খেলাঘর করে না। তারা কেউ বই পড়ে না। তাদের রুচিবোধের এত অবক্ষয় হয়েছে যে তারা কি করে জানেন? তারা মসজিদ কমিটি করে, তারা হচ্ছে শ্মশান কমিটি করে। তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনাটি, যে জায়গাটি, মানে খারাপ জায়গায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে বাংলাদেশ যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক যারা কাজ করে সেই মানুষগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত এই উপলব্ধি না করবে শুধুমাত্র তোষামোদ করে যাবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ খুব খারাপের দিকে যাবে।
অনুস্বর: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বিশ্বজিত সাহা: আপনাকে ও অনুস্বর পরিবারকেও ধন্যবাদ।