মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পর সেচের পানির জন্য বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বরেন্দ্র এলাকায় দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকা- হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা আছে, তর্ক-বিতর্কও চলছে। কিন্তু ঘটনার বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। বিষয়টি বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির মূল ধারাকে কতটুকু আলোড়িত করেছে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও স্থানীয় পর্যায়ের আলোড়ন ভালোই আঁচ করা যায়। তবে প্রান্তিক পর্যায়ের হাজারো সমস্যার মত এমন সব আলোড়ন বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে কতটা প্রভাবিত করবে সে প্রশ্ন ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
২৫ মার্চ ছিল বাংলাদেশের জাতীয় গণহত্যা দিবস। ইদানিং দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি নিধনের বর্বরোচিত ঘটনা স্মরণ করা হয়। দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও দাবি করা হয়। এবার তার ঠিক আগেই ২২ মার্চ সন্ধ্যায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রামের দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) আর রবি মারান্ডি (২৭) পরস্পর চাচাতো ভাই। চৈত্রের খরা থেকে বাঁচাতে বোরো ধানের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে তারা কীটনাশতক পানে আত্মহত্যা করে। দিনের পর দিন গভীর নলকূপ অপারেটরের কাছে ঘুরে পানির বদলে অপমানিত/বঞ্চিত হয়ে রাগে-দুঃখে তাদের এই আত্মহনন এলাকার নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা হলেও আলোড়ন তুলেছে।
অভিনাথ দেড় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। আর নিজের দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করে না রবি। চৈত্রের খরা কবলিত জমিতে ধান বাঁচাতে সেচের পানিই একমাত্র উপায়। সে পানি না পেয়ে নিরুপায় অভিনাথ ও রবি গভীর নলকূপের কাছেই কীটনাশতক পান করেন। এর আগে ১০-১২ দিন ঘুরেও অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন, যিনি কৃষক লীগের স্থানীয় নেতা, পানি দিচ্ছিলেন না। পানি না পেয়ে অভিনাথ দু’দিন আগেই আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন বলে স্থানীয়রা সাংবাদিককে জানান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির ঘটনাও ঘটে গেছে। সাখাওয়াত তুই পানি দিচ্ছিস না, আমি কিন্তুক বিষ খাব’Ñ জীবন ছাড়া প্রতিবাদের আর কোনো জায়গা খুঁজে পাননি তারা। জবাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় অভিনাথ ও রবিকে। কিন্তু তারা যে সত্যি সত্যিই বিষ খেতে পারে সেটা কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন নি। কীটনাশক পানের পর বাপ্পি মার্ডি নামের একজন গুরুতর অসুস্থ অভিনাথকে নিজের ভ্যান গাড়িতে করে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন। সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অভিনাথ। রবি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন মারা যান। স্থানীয় ইউএনও, ওসি ও ইউপি চেয়ারম্যানের সামনেই ভ্যানচালক বাপ্পি বলেছেন, কীটনাশক পানের পরও অভিনাথ অপারেটরকে বলছিলেন, ‘সাখাওয়াত, তুই পানি দিলি না, আমি কিন্তুক বিষ খাইছি!’ তখন সাখাওয়াত বাপ্পিকে বলেছিলেন, ‘এই, তুই একে দূরে নিয়ে যা তো!’ তখন অভিনাথের মুখ দিয়ে সাদা ফেনাযুক্ত লালা পড়ছিল, অনবরত কাশি হচ্ছিল। স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এসব খবরে আরও জানা যায়, থানা পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও গভীর নলকূপ অপারেটরের সামনেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কৃষকরা অভিযোগ করেন, আওযামী লীগ কর্মী সাখাওয়াত পানি দিতে স্বজনপ্রীতি করেন। পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হন। তবে অভিনাথ ও রবি কীটনাশক পানের পর রাতে তাদের জমিতে নিজেই পানি দিয়েছেন সাখাওয়াত। বরেন্দ্র এলাকার সেচ সঙ্কট মোটেই নতুন নয়। পানি নিয়ে বাণিজ্য, রাজনীতিও বহুদিনের পানির জন্য কৃষক জনতার এমন ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছেই।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের উচ্চ ভূমির রুক্ষ্ম প্রকৃতির বরেন্দ্র এলাকা দেশের অন্যতম শস্য ভা-ার হিসেবে পরিচিত। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ জুড়ে বিস্তৃত বরেন্দ্র ভূমিতে প্রধানত ধান উৎপাদন হয়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে প্রকৃতি নির্ভর চাষবাসে বৃষ্টির পানিতে বছরে একবারই ফসল উৎপাদিত হতো। তখন বরেন্দ্র ছিল দেশের পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের অন্যতম। দারিদ্রপীড়িত এ অঞ্চলে বছরের বেশির ভাগ সময় লাল এঁটেল মাটির ধু ধু প্রান্তরে গরু-ছাগল চড়ে বেড়াত, ছিল না সবুজের সমারোহ। এই অবস্থার চিত্রই উঠে এসেছে এ অঞ্চলের জমিদারিতে আসা রবি ঠাকুরের গানে— ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙা মাটির পথ…..’।
স্বাধীনতার পর কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচিতে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ থেকেই এখানে সেচ নির্ভর চাষবাস গুরুত্ব পেয়েছে। এক্ষেত্রে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পরিবর্তে ভূ-গর্ভস্থ পানিই যে প্রাধান্য পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদেশি সাহায্যনির্ভর প্রকল্পে তেলচালিত সেচযন্ত্র এবং পরবর্তীতে পল্লি বিদ্যুতে গভীর নলকূপের ব্যবহারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সরকারি উদ্যোগ কাজ করেছে। এক সময়ের কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের গভীর নলকূপ প্রকল্পকে ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধানে ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে বিএমডিএ পরিকল্পিতভাবেই গভীর নলকূপ বসাতে শুরু করে। এ অঞ্চলের ১৬ হাজার গভীর নলকূপের অর্ধেকেরও বেশি রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায়। এই নলকূপ প্রকল্প থেকে বিএমডিএ বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে থাকে। অবশ্য বিএমডিএ ছাড়াও এই তিন জেলায় উপজেলা সেচ কমিটি অনুমোদিত প্রায় ৫৬ হাজার ব্যক্তিগত নলকূপও সেচ চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে চলেছে দিনে-রাতে। ফলে এক সময়ের রুক্ষ্ম প্রকৃতিতে এখন সবুজের সমারোহ চারদিকেই।
তবে দিন রাত পানি তোলার পরিণতিতে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে ভূ-গর্ভ। এখন কৃষক আর চাহিদা মত পানি পায় না। এলাকাভেদে বোরো ধানের জমিতে সেচের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে সাত থেকে পনের দিন পর্যন্ত। নলকূপ অপারেটররাও জানাচ্ছেন, আগের মত গভীর নলকূপে পানি না পাওয়ার কথা। ফলে তাদের পক্ষে কৃষকের চাহিদা মত পানি দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এখন শুধু গভীর নলকূপেই নয়, অনেক স্থানে হস্তচালিত নলকূপেও পানি ওঠে না। এমন অবস্থায় কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে, তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে তা আর পুনর্ভবন না হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার সমালোচনার মুখে ২০১২ সালের জুন মাস থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র এলাকায় নতুন করে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করে দিয়েছে। তবে রাজশাহী বিভাগেই এখনও আট হাজার ৮২৬টি গভীর নলকূপ চালু থাকার কথা জানা গেছে। এসব নলকূপ প্রতিনিয়তই বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভ পানিশূন্য করে চলেছে।
গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইড্রোলজিক্যাল মডেলিংয়ের মাধ্যমে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ৫০টি স্থানে প্রায় দেড় হাজার ফুট গভীর পর্যন্ত বোরিং করে এক জরিপ চালিয়েছে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)। সেখানে পাঁচটি ইউনিয়নে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে পানির অস্থিত্বই পাওয়া যায় নি। সাধারণত ১৫০ থেকে ২০০ ফুট মাটির গভীরেই পানির ধারক স্তর (অ্যাকুইফার) পাওয়া যায়। ওয়ারপোর জরিপে রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়ন, মুন্ডুমালা পৌর এলাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশা উপজেলার ছাওড় ইউনিয়ন এবং সাপাহার উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশেষ কয়েকটি জায়গায় অ্যাকুইফার খুঁজে না পাওয়া বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সঙ্কটের গভীরতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌর ভবনের পাশে ২০১৬ সালে একটি পানি মাপার কূপ খনন করে। সে সময় সেখানে পানির স্তর ছিল প্রায় ১০০ ফুট নিচে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাটির ১৫০ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যায় নি বলে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে। এ বছরে এই দূরত্ব আরও বেড়েছে। ডাসকো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ৩৯ ফুট নিচে ছিল। ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট বা তার নিচেও পানি পাওয়া যায় নি। অবশ্য ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা পানি স্তরের দেখা মিলেছে।
উল্লেখিত এলাকাগুলোর আশপাশে ছোট ছোট পকেট অ্যাকুইফার থেকে অবশ্য এখনও সেচের ও খাবার পানি তোলা যাচ্ছে। তবে এই পানির জন্য মানুষকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হচ্ছে। সেচের পানির অভাবে অনেক জায়গায় ধানের জমি ফাঁকা পড়ে থাকছে। অনাবাদি জমিতে ফলমূল, শাক-সবজির চাষ বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত না হয়ে পারা যায় না। অন্যদিকে খাবার ও গৃহস্থালী কাজের পানির জন্য সক্ষম পরিবারে সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে নিজদের চাহিদা মিটাবার পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে পানি বিক্রি বেশ দ্রুতই বিস্তার লাভ করছে। নদী মাতৃক পানির দেশ, যা বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চলও সেখানে এমন পানি সঙ্কটের সৃষ্টি কি খুব স্বাভাবিক বলা যায়?
প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এর ৮০ শতাংশই আসে ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে। এতেই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। এমনিতে তো আর ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনকারী দেশের শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসে নি?
এদিকে গত প্রায় চার মাস ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টি হয়নি। এমন অবস্থা আগে কমই দেখা গেছে। এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতি তুলনামূলক রুক্ষ্ম হলেও এখন এর তীব্রতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। দেশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দুই হাজার পাঁচশ মিলিমিটার হলেও বরেন্দ্রর অঞ্চলে এই পরিমাণ মাত্র এক হাজার দুইশ’ থেকে এক হাজার তিনশ’ মিলিমিটার। একই ভাবে দেশে বৃষ্টিপাতে ভূ-গর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরনের হার ২৫ শতাংশ হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে তা মাত্র ৮ শতাংশ। ফলে এখানকার পানি সঙ্কট অনিবার্যভাবে অন্য এলাকার তুলনায় বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এর পেছনে অন্য কারণ ছাড়াও প্রচলিত উন্নয়ন ধারা ও মানুষের গৃহীত পদক্ষেপের ভূমিকা বলাই বাহুল্য।
বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চল লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে আক্রান্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে। আর উত্তরাঞ্চল পানি সঙ্কটে পড়েছে সেচের পানির জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে।
এমন অবস্থায় গত ২২ মার্চ পালিত বিশ্ব পানি দিবসের মূল বিষয় ছিল ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার নিয়ে। পানি দিবসের পর পরই পানির জন্য দুই কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেছেন, শুধু পানি দিবস নয়, স্বাধীনতার মাসেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। এই ঘটনাকে তিনি দীর্ঘ অনিয়মের বহির্প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। সামরিক সরকারের আমলে অনিয়মের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, দেশে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পরও তার ধারাবাহিকতা রয়ে গেছেই শুধু নয়, দিন দিন অনিয়ম, দুর্নীতি, দলবাজি আরও বেড়েছে বলেই যে আজকের অবস্থা সেটা তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার।
জীবনের বিনিময়ে সেচের পানি পেলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে সাঁওতালিদের বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে নি। উল্টো স্থানীয় থানার ওসি প্রশ্ন তুলেছেন এই মৃত্যু নিয়ে। বলেছেন, এখন চৈত্র মাস। পানির সঙ্কট। তার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে? দায়িত্বশীলদের মুখে এমন প্রশ্ন অনেক কিছুই পরিষ্কার করে দেয়। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই অভিনাথের বোন সুমিতা টুডুর বিলাপে ভেসে উঠেছে হৃদয়ের আর্তনাদ- ‘আমরা কুথায়ও বিচার পাই না রে….!’ পুলিশ অভিনাথের বাড়ি থেকে তার লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য পাঠালেও থানায় দায়ের করা হয় অপমৃত্যুর মামলা। মামলার বাদি করা হয় অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রমকে। এজন্য পুলিশ তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষরও নিয়েছে। পরদিন নলকূপ অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে না জানতে পেরে রোজিনা থানায় গিয়ে প্রতিবাদ জানান। পুলিশ তাকে দীর্ঘসময় থানার বারান্দায় বসিয়ে রাখে। ‘পরে থানায় যান আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তার হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচণায় মামলা নিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। মামলা নিয়ে পুলিশের এই টালবাহানা আরও পরিষ্কার হয় ঘটনার সাত দিন পরও আসামী গ্রেপ্তার না হওয়ার ঘটনা থেকে। এ নিয়ে সভা-সমাবেশ করতে হয়েছে। দাবি জানাতে হয়েছে খুনীকে গ্রেপ্তারের। অভিযুক্ত গ্রেপ্তারের পরও তদন্ত নিয়ে তাদের আশঙ্কার কথাও বলতে হয়েছে, খুনের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা চলছে। তারা জোরের সাথে বলেছেন, এটি শুধু আত্মহত্যা নয়, কাঠামোগত হত্যাকা-। তাই শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না, ঘটনার তদন্তে ও বিচার কাজে কেউ যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিবারগুলো যেন সঠিক বিচার পায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এভাবে বিচার পাবার জন্য দাবি তোলার ঘটনা কি বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথাই বড় করে তোলে না? একই সাথে জবাবদিহিবিহীন শাসন ও বিদেশ নির্ভর ভ্রান্তি উন্নয়নের কথাটাও সামনে এসে দাঁড়ায়।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘— অথচ স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অন্যদের মতোই আদিবাসী জনগোষ্ঠীও আত্মদান-আত্মত্যাগে কারও চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। তার পরও স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অপ্রাপ্তির পাল্লাই ভারী রয়ে গেছে। তাদের অস্তিত্বের দাবিগুলিও কোনো সরকারই বিবেচনায় নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে পৈত্রিক ভিটেবাড়ি, কৃষি জমি বেদখল হওয়া যেমন ঠেকানো যায়নি তেমনি সেচের পানি থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাদের। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এ কেমন স্বাধীনতা? যেখানে মানুষের বঞ্চনার পাশাপাশি জবাবদিহিবিহীন শাসন আর বিদেশনির্ভর উন্নয়নে বেঁচে থাকার স্বপ্ন চাপা পড়ে যায়! এর দায় স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকারই কি অস্বীকার করতে পারে? লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই রাষ্ট্র কেন এমন হলো তার জবাব কে দেবে?
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক।