সম্প্রতি যশোরের বেনাপোলে জমি সংক্রান্ত বিরোধে ভাতিজা ও ভাতিজার ছেলের ছুরির আঘাতে চাচা খুন হয়েছে। এ ঘটনায় আরও দু’জন আহত হয়েছেন। এর কিছুদিন আগে এই বেনাপোলেই দু’দল শ্রমিকের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেখানে একপক্ষ হাতবোমা ব্যবহার করে অপর পক্ষের ওপর চড়াও হয়। বোমায় অপর পক্ষের বহু শ্রমিক আহত হয়। দু’পক্ষের দ্বন্দ্বের কারণ বন্দরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা।
অন্য আরেক ঘটনায় ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় দু’দল গ্রামবাসীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হন। উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের আগুলদিয়া ও জয়ঝাপ গ্রামবাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রেই বিরোধ সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে এবং অস্ত্র ব্যবহার করে একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের সংঘর্ষ ব্যক্তিপর্যায়ে, মহল্লা বা গ্রাম পর্যায়ে এবং সংঘটিত দলগুলোর মধ্যে প্রায়ই ঘটে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ধারালো অস্ত্র অতি ব্যবহৃত একটি হাতিয়ার এবং প্রায়ই আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমাও ব্যবহৃত হয়। এসব বোমা প্রায়ই সবক্ষেত্রেই হাতবোমা আর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো হাল্কা অস্ত্র হয়ে থাকে।
ওপরের প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই মামলা হয়েছে, অর্থাৎ সেখানে প্রত্যেকটি ঘটনায় দেশের প্রচলতি আইনের প্রেক্ষিতে বেআইনি কিছু ঘটেছে।
আবার আমাদের পাশের দেশ ভারত বা মিয়ানমারে বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা আছে। সেখানে সংঘর্ষের ঘটনাগুলো আরও প্রাণঘাতী এবং প্রধানত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। এসব আগ্নেয়াস্ত্র হাল্কা থেকে ভারী হয়ে থাকে। একে-৪৭ রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার- এসব ক্ষেত্রে এ ধরনের অস্ত্রই প্রধানত ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা যে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য কিছু লোক অস্ত্র তুলে নেয় তাদের শক্তিমত্তা বা প্রস্তুতি প্রায়ই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তুলনায় দুর্বল হয়। প্রায়ই ভূমির অধিকার বা অন্যান্য অধিকার নিয়ে স্থানীয়দের মরিয়া চেষ্টার শেষ পর্যায়ে এরকম অস্ত্র তুলে নিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগগুলো শুরু হয়। সবক্ষেত্রেই রাষ্ট্র এদের অপরাধী বলে গণ্য করে।
ভূমির অধিকার নিয়ে বিরোধ যে শুধু এইসব পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। আরও বড় আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এ ধরনের বহু বিরোধ বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে বর্তমান বিশ্বে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ভূমিবিরোধ একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। কিছুদিন বাদেবাদেই দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়াচ্ছে, রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। প্রতিবেশী সিরিয়ার সঙ্গেও ইসরায়েলের ভূমিবিরোধ বিদ্যমান। কোনো এক যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান হাইটস দখল করে নেয় ইসরায়েল। তারপর থেকে ওই মালভূমিটি ইসরায়েলের দখলেই আছে। তারা সেখানে বসতি গড়ে তুলে চাষাবাদও করছে আর চারদিকে ট্যাংক-কামান বসিয়ে অস্ত্র হাতে সেনা পাহারায় নিরাপত্তার তোড়জোর করে চলছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তাদের স্বাধীনতার পর থেকেই বিরোধ চলে আসছে। এই ভূখণ্ড নিয়ে তিন তিনবার লড়াইয়ে জড়িয়েছে প্রতিবেশী দেশ দু’টি। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীরেও বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই জারি আছে।
ভারতের সঙ্গে আরেক প্রতিবেশী চীনেরও সীমান্ত বিরোধ আছে। এই বিরোধও মূলত ভূখণ্ডগত বিরোধ। কোন ভূমি কার ভূখ-ের অন্তর্ভুক্ত, রাষ্ট্রীয় সীমানা কোথায়- এসব নিয়ে মতপার্থক্যই এই বিরোধের কারণ। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বড় একটি যুদ্ধসহ বহু সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আর বহু প্রাণহানি হয়েছে। ভারতের অপর প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভুখ-গত সমস্য বিদ্যমান ছিল, এখনো হয়ত কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। তবে দু’দেশের মধ্যে তথাকথিত ছিটমহল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে, যার সুফল ভোগ করছে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মানুষ।
উপমহাদেশের আরেক দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিবেশী আফগানিস্তানের ভূমিবিরোধ বহু পুরনো সমস্যা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জাতিগত পশতুরা দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত মানে না, এক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কাও তারা করতে চায় না। কারণ ব্রিটিশরা গায়ের জোরে তাদের এলাকাকে বিভক্ত করে দু’টি দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে, যা তারা মেনে নিতে পারে নি।
এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশ। আর চীন এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ। এই চীন প্রায় পুরো দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর নিজের মালিকানা দাবি করছে। এই নিয়ে প্রতিবেশী ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স ও ব্রুনাইয়ের সঙ্গে তার বিরোধ চলছে। আবার পূর্ব চীন সাগরের কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে চীনের সঙ্গে জাপানের বিরোধ আছে। মাঝে মাঝে এই নিয়ে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনাও দেখা দেয়। আর প্রায় স্বাধীনভাবে চলা তাইওয়ানকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ মনে করে চীন। তাইওয়ান স্বাধীনতার ঘোষণার চেষ্টা করলে চীন শক্তি প্রয়োগ করে দ্বীপটিকে নিজেদের ভূখ-ভুক্ত করে নেবে তা প্রকাশ্যেই জানিয়ে রেখেছে। চীনের ওই পাশে জাপানের সঙ্গে অপর বৃহৎ প্রতিবেশী রাশিয়ার ভূমিবিরোধ রয়েছে। কুড়িল দ্বীপপুঞ্জ মানের কয়েকটি দ্বীপ, যা এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে আছে, তার ওপর মালিকানার দাবি ছাড়ে নি জাপান।
বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেইনের ভূখ-গত বিরোধ এখন যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। কয়েকশ’ বছর ধরে রুশ সাম্রাজের অন্তর্গত ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মধ্যে দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ভূখ-গত অনেক স্বার্থ অমীমাংসিত রয়ে যায়। যার জেরে ২০১৪ সালে রাশিয়া কথিত এক গণভোটের রায় নিজেদের পক্ষে দেখিয়ে ইউক্রেইনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপকে নিজেদের ভূখণ্ডভুক্ত করে নেয়। তারপরও যেসব বিষয় অমীমাংসিত রয়ে যায় সেগুলো মীমাংসা করতে যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে মস্কো।
ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের মালিকাধীন দ্বীপ রয়েছে কয়েক হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে। ব্রিটেনের মালিকানাধীন দ্বীপ আছে কয়েক হাজার মাইল দূরে আর্জেন্টিনার উপকূলে। এই ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ বা ইসলাস মালভিনাস নিয়ে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ব্রিটেনের যুদ্ধও হয়েছে। যুদ্ধে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার সেখানে ব্রিটেনের মালিকানা জারি আছে।
তো জমি নিয়ে বিরোধী শুধু চাচা-ভাতিজা বা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বাড়ি, গ্রাম, মহল্লা থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এই বিরোধ বর্তমান। স্থানীয়ভাবে যে সমস্যা আইনকানুন ও পুলিশ দিয়ে চাপ দেওয়া বা মিটিয়ে ফেলা যায়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টা বেশিরভাগ সময়ই আর আওতার মধ্যে থাকে না।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে বিরোধের জেরে ছুরি, চাকু ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, চরিত্রে সেই একই ধরনের বিরোধের জেরে আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। এক একটা ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে শত শত মানুষের, ধ্বংস করছে বহু শ্রমে গড়ে তোলা নগর, বন্দর। শত শত বা হাজার হাজার সাধারণ নিরপরাধী মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করার মধ্যে দিয়ে ঘটছে অনেক অনেক বড় ও বিশাল অপরাধ।
কিন্তু সেই অপরাধ সামাল দেওয়ার মতো কোনো পুলিশ নেই, সেই অন্যায়ের বিচার করার মতো কোনো আদালত নেই।
বলা হয়, সভ্যতার ধারবাহিকতায় প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ, লৌহযুগ পার হয়ে এখন আমরা শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তি বিপ্লব ইত্যাদি হয়ে এখন তথ্য যুগে প্রবেশ করেছি; কিন্তু যুগের পর যুগ পার হয়েও আমরা আমাদের প্রাথমিক বিরোধগুলো মেটানোর মতো মানসিক পরিপক্কতা এখনও অর্জন করতে পারি নি।
লেখক: সাংবাদিক, পরিবেশ ও সমাজকর্মী।