মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ অথবা ‘মনের নাম মধুমতি, চোখেরই নাম আয়না’ এখানে দু’টোই কিন্তু মনের ব্যাপার। এই যে মনের ব্যাপার, ‘মন’ তাহলে কি? যার উত্তর খুঁজতে মুনি ঋষি থেকে শুরু করে কবি, সাহিত্যিক, প্রেমিক, দার্শনিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী সবারই রয়েছে অন্তহীন প্রচেষ্টা। দেহ ও মন দু’টোই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বলা হয়ে থাকে সুস্থ দেহ সুস্থ মন অথবা সুস্থ মন সুস্থ দেহ অর্থাৎ দেহ ও মন একে অন্যের পরিপূরক। তবে মনোচিকিৎসকরা সুস্থ মনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকেন। তাদের ধারণা মতে মন সুস্থ না থাকলে এর প্রভাব শরীরের ওপর পড়ে বিধায় শরীর কখনো ভালো থাকে না, অর্থাৎ দেয়ার ইজ নো হেলথ্ উইথআউট মেন্টাল হেলথ্; ‘মন’ দর্শনশাস্ত্রের একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা। মন বলতে সাধারণত বোঝায় বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের একটি সমষ্টিগত রূপ যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মানুষের যা কিছু সৃষ্টি সবই কিন্তু মনের বিষয়। মন কী এবং কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে এবং এসব তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে প্লেটো, অ্যারিস্টটলসহ অন্যান্য প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের সময় থেকেই। মনের প্রকৃত সংজ্ঞা নিরূপণ করা দুরূহ ব্যাপার। মন কেমন তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে মনস্তত্ত্বে, দর্শনে, ধর্মে, ধ্যান বিজ্ঞানে।
মনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নিউরো সায়েন্টিস্ট রজার স্পেরি মনকে পঞ্চাশ কোটি বছরের সর্বোচ্চ অর্জন বলে উল্লেখ করেছেন। আরেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার জন একলস মনকে তুলে ধরেছেন আত্মসচেতন, সক্রিয়, অনুসন্ধিৎসু, স্বতন্ত্র এক প্রক্রিয়ারূপে। প্লেটোর ধারণা মতে দেহ বস্তুজগৎ থেকে উঠে আসে, আত্মা আসে ভাবজগৎ থেকে।
মন-মগজ, মন-মস্তিষ্ক বলে একটা কথা আছে। তাহলে মন কি মস্তিষ্ক না কি হৃৎপি- এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। মনের আবাস যদি মস্তিষ্কই হয় তাহলে কেমন সেই মস্তিষ্ক। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে গড়ে ২৪০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত মগজ থাকে। যার মধ্যে গড়ে ১০০ কোটি নিউরন বিদ্যমান।
আনন্দ, সুখ, আতংক, লজ্জা, এমনকি ভালোবাসার মতো অনুভূতির জন্ম মস্তিষ্কে। মনের ক্রিয়া সবসময়ই নিঃশর্তভাগের মস্তিষ্কের কার্যেরই একটি পরিণাম। মস্তিষ্কের ক্রিয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে মনের ক্রিয়ারও পরিবর্তন ঘটে থাকে। মন আর মস্তিষ্ক একটি অপরটির স¤পূরক বা পরিপূরক। ভালোবাসা, ঘৃণা, ভয়, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, সুখ, স্মৃতি, হাসি-কান্না, সবই কিন্তু মনের ব্যাপার। মন ও চিন্তাকে একত্রিত করলে তৈরি হয় দৃষ্টিভঙ্গি। আর দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে জীবনও বদলে যায়, মানুষও বদলে যায়। মনের রয়েছে চিত্ত, অন্তর, প্রাণ, আত্মা, হৃদয়, হিয়া, দিল, পরাণ, অন্তঃকরণ, অন্তরাত্মা, চিত্তপট, হৃদয়তন্ত্রী, মানসলোক, মনোজগৎ ইত্যাদির মতো বহুবিধ সমার্থক শব্দ। সমার্থক শব্দ থাকলেও মূলত একটি অস্তিত্বকে ঘিরে অর্থাৎ মানবাত্মাকে কেন্দ্র করে এ শব্দগুলোর অবতারণা হয়েছে। তবে মন শুধু নিছক কোনো শব্দ বা কল্পনার বস্তু নয়। এর অস্তিত্ব, স্বরূপ, পরিচিতি, প্রকাশ, বিকাশ, অবস্থান সবই বিদ্যমান। সুতরাং তত্ত্ব ও যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায়, মানবাত্মাই হলো মন বা মনই হলো মানবাত্মা। মন ও মানবাত্মা একই জিনিস, একই বস্তু যার কোনো বিকল্প নেই।
শরীরে যেমন রোগব্যাধি বাসা বাঁধে ঠিক তেমনি মনেরও রোগ হয়। আর মনের রোগকে বলা হয় মানসিক রোগ। মানসিক রোগের জন্য রয়েছেন আলাদা ডাক্তার-সাইকোপ্যাথিস্ট। টেনশন, বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, শূচীবায়ু, ফোবিয়া, ম্যানিয়া, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার, ক্লিপটোম্যানিয়া ইত্যাদির মতো ভয়াবহ মানসিক রোগ অনেক সময় রোগীর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
দেহের পরিসর ছোট কিন্তু মন সে তো সীমাহীন, অসীম। এর বিশালতার সীমা পরিসীমা নেই। এর গতি প্রকৃতিও ঠিক যেমনি ভিন্ন, তেমনি বিচিত্র- বোঝা মুশকিল। মনের গতি বিদ্যুতের চেয়েও ত্বরিত। মন বাঁধনহারা, মনকে কখনো বেঁধে রাখা যায় না। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ হয়ে ঘুরে বেড়ায় যথা তথা, উড়ে বেড়ায় ইতিউতি। মন উড়ে প্রজাপতির ডানায়, মন উড়ে যায় চিলের ডানায়, মন উড়ে ঘুড়ির সুতোয়, উড়ে বেড়ায় পবনের নায়, মন উড়ে যায় শিশির কণায়, মন উড়ে স্বপ্ন ডানায়।
মনের রয়েছে প্রকারভেদ, ভালো-মন্দ, শক্ত-নরম, দুর্বল-সবল, সাহসী-ভীরু ইত্যাদি। একজন ভালো মনের মানুষ যেমন সমাজের কল্যাণ বয়ে আনতে পারেন ঠিক তেমনি মন্দ বা কুভাবাপন্ন মানুষের দ্বারা সমাজে ঘটে যেতে পারে মহাবিপর্যয়। লিঙ্গভেদেও মনের গতিবিধি ভিন্ন। যেমন পুরুষের বিপরীত নারীমন। নারীর মন নিয়েও রয়েছে ভাবের কথা। নারীর মন নাকি রহস্যাবৃত- বুঝা যায় না। স্বয়ং দেবতাও নাকি নারীর মন বুঝে উঠতে পারেন না। মন সর্বদা দুই অবস্থায় বিরাজমান চেতন ও অবচেতন। অবচেতন মন বিপজ্জনক। কারণ অবচেতন মনে কোনো কিছু বাসা বাঁধলে বহুলাংশে ক্ষতির আশংকা থেকে যায়। অবচেতন মনে কখন কে কি করে সেটা তার নিজেরই বোধগম্য নয়। আর টেলিপ্যাথি? সেটাও মনের ব্যাপার।
ষড়ঋতুতে মন দোলায়িত হয়। গ্রীষ্ম আসে গ্রীষ্ম যায়। বর্ষা আসে বর্ষা যায়- আসে শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। পহেলা বৈশাখ দিয়ে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ। উৎসবে মুখরিত হয় বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। শহরে গ্রামে-গঞ্জে চলে মেলা। বাবার আঙুল ধরে সেই ছোট্টবেলার মেলায় ঘুরতে ঘুরতে মন হারিয়ে যায় নাগরদোলায় আর সার্কাসের তাঁবুতে। পাতার বাঁশীর আওয়াজ হৃদয়ে তোলে ঝংকার। বর্ষায় মন খুঁজে সেই টিনের চালের মিষ্টি মধুর বৃষ্টির অবিরাম ধারাপাত। মন খুঁজে শিমের বীচি ভাজা, মায়ের হাতের রান্না করা ডাল-ভাত, শুঁটকি ও পোড়া আলুর ভর্তা। মন খুঁজে অফিস ফেরত বাবার আধভেজা শরীরের গন্ধ, ভাইয়ের কাদাজলে চুপসে যাওয়া ফুটবল খেলার মাঠ। মন খুঁজে ঝুম বৃষ্টিতে পাশের ডোবানালায় ব্যাঙের কোরাস।
শিশির ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে শিউলি কুড়ানো ভোর, হেমন্তে নবান্ন উৎসব আর শীতের কুয়াশা ঢাকা ভোরের সবুজ হিমেল প্রান্তরের হাতছানি মনের আঙিনায় চুপিসারে ছায়া ফেলে প্রতিনিয়ত। তারপর ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’। কোকিলের কুহুতান, পলাশ-শিমুলের রঙিন আভা আবীর ছড়ায় বনে এবং মনে। তাইত কবি গেয়ে ওঠেন, ‘মনের রঙ লেগেছে, বনের পলাশ, জবা, অশোকে’….।
মনের আবাসভূমির বিস্তৃত পরিম-লে রয়েছে সুন্দর স্বচ্ছ একখ- নিঃসীম নীলাকাশ। সেখানে ভোর হয়, সূর্য ওঠে। পাখিদের কলগুঞ্জনে চারপাশ মুখরিত হওয়ার সাথে সুবর্ণরেখার স্বর্ণালী আভায় উদ্ভাসিত হয় মনোভুবন। সন্ধ্যা হয় নেমে আসে গাঢ় আঁধার। অন্ধকারকে দূরীভূত করে ফর্সা আলোয় আলোকিত করে ভেসে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদ। জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে হাজার তারার ঝিকিমিকি বাতি। রূপালি জোছনায় ডুব সাঁতার দিয়ে নেমে আসে তন্দ্রালুতা।
আকাশে উড়ে ঘুড়ি। নানান রঙের ঘুড়ি। বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল-সাতরঙা ঘুড়ি বেনীআসহকলা। শূন্যে উড়ে উড়ে ঘুড়িগুলো আকাশ ছুঁতে চায়। সূতোয় সূতোয় চলে কাটাকুটি খেলা। তারপর এক সময় ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে হারিয়ে যায় সুদূরের অতলান্তে।
কখনো কখনো ঈশান কোণে জমে ওঠে মেঘ। শুরু হয় কালো মেঘের আনাগোনা। নেমে আসে ঝড়। অন্তরে বাইরে দিগি¦দিক কাঁপানো প্রচণ্ড ঝড়। প্রলয়ংকরী ঝড়ের তাণ্ডব সবকিছুকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে একসময় যখন স্তিমিত হয়ে আসে তখন সেই তা-বের রেশ মনকে করে দেয় বিধ্বস্ত, উদ্ভ্রান্ত, করে মর্মাহত।
‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’- তার মানে মন কাঁদে। অঝোর ধারায় কাঁদে, হাপুস নয়নে কাঁদে। যে কান্না কেউ দেখতে পায় না। যার মন কাঁদে শুধু সে-ই উপলব্ধি করে মাত্র। হতে পারে এই কান্না দুঃখের কান্না, শোকের কান্না, এই কান্না বিরহের কান্না, বেদনার কান্না, হাহাকারের কান্না। চাপা হতাশার হৃদয় নিংড়ানো কান্না। কষ্টগুলো শুধু অবিরাম কান্না হয়েই ঝরে পড়ে। মন যেমন কাঁদে তেমনি রয়েছে তার হাসির ক্ষমতা। তবে সেই হাসি অট্টহাসি নয়। চুপিসারে হাসে, মিটিমিটি হাসে, নীরবে হাসে। মনের ভেতর রয়েছে আরও কত কি! রয়েছে আঁকাবাঁকা দীর্ঘ সমান্তরাল সর্পিল এক রেলপথ। প্রলম্বিত হুইসেল বাজিয়ে যেখানে চলতে থাকে কু-ঝিক-ঝিক মনের ট্রেন।
রয়েছে শাপলা ফোটা, পদ্ম ফোটা বিল-ঝিল, গাঙ, ডোবা, হাওর-বাওর। রয়েছে অনাবিল শান্তির টলটলে নীরব-নিথর এক স্বচ্ছ সরোবর যার নাম মানস সরোবর। ইছামতী, আড়িয়াল খাঁ নয়- রয়েছে মনের নদী। আছে নদীর কূল, আছে কিনার। রয়েছে বিশাল সাগর, সাগরের ঢেউ, প্রচ- নিনাদ। মানস সরোবরে তরঙ্গায়িত ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় ভেসে বেড়ায় আশৈশবের তৈরি ছোট বড় রঙিন কাগজের নৌকা। নদীতে চলে সাম্পান, চলে ছোটবড় হরেক রকম ডিঙি নৌকো। অবারিত নদীবক্ষে ডিঙি নৌকোয় শুয়ে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে আকাশপানে তাকিয়ে সে নাওয়ের যাত্রী শুধু একাই একজন। ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় তিরতির করে এ যেন অন্তহীন ভেসে বেড়ানো। অথৈ সাগর বক্ষে বিশাল জাহাজে করে নিরবধি ঢেউয়ের সাথে জলকেলির উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠা যাত্রী সেও সেই একইজন।
মন পোড়ে কারণে, অকারণে। কখনো দাউদাউ, কখনো ছাইচাপা তুষানলে। পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়, ভস্ম হয়। যার আঁচ কারো গা স্পর্শ করে না, কেউ টের পায় না। যার পোড়ে শুধু সে-ই তিলে তিলে নিঃশেষ হয়, সর্বস্বান্ত হয় সবার অজান্তে।
‘মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান কথা’- অর্থাৎ মন ভাঙে। ভেঙে খানখান হয়, টুকরো টুকরো হয়। নীরবে নিঃশব্দে- যার শব্দ কেউ শুনতে পায় না। কবির ভাষায় ‘কারো মনে দিও না তুমি আঘাত সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে’ তার মানে মনে আঘাত করা বা কারো মন ভাঙা অনেক বড় গর্হিত ও দূষণীয় ব্যাপার।
কিন্তু তারপরও কখনো কখনো কারো মনের অর্গল ভেঙে দিয়ে সেই আঘাত মর্মস্পর্শী রূপ ধারণ করে।
মন বা হৃদয় চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। সেই চোরকে মনচোর, চিত্তহরণকারী, হৃদয়হরণকারী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। আর মনচুরির ব্যাপারটা কিন্তু সচরাচর ঘটে থাকে অবচেতনভাবে। যার কারণে এই চুরির জন্য মালিক ও চোর সমানভাবে দায়ী। সবকিছু চুরির মতো কার মন কখন কিভাবে হরণ হয় সেটা নাকি মনের মালিক ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। যখন টের পায় তখন তার অশনি সংকেত বেজে গেছে। তারপর চোরের নাগাল পেয়ে গেলে তো ভালো। আর না হয় সারাজীবন হায় হায় করেই কাটিয়ে দিতে হয়। আবার মাঝে মাঝে এর বিপরীত অবস্থাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ কারো কারো মাঝে সজ্ঞানে, সুস্থ-মস্তিষ্কে মন দেয়া নেয়ার কর্ম স¤পাদিত হয়। মনের ব্যাপার বড়ই বিচিত্র। এমনও দেখা যায় সে সারাজীবন সাধনা করেও অনেকে অনেকের মনের নাগাল পায় না।
মন মরে- একবার মরে, একশবার মরে, হাজার বার মরে। এই মরা মন কখনো জিন্দা হয় আর না হয় সারাজীবন মৃতই থেকে যায়। এই মৃত মনটাকে সারাজীবন বহন করে ফিরতে হয়। তাই মনের মৃত্যু ঘটার আগেই তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হয়। কারণ মৃত মন বহন করা বা মৃত মন নিয়ে বেঁচে থাকা একটি অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার।
আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড- কথাটা মোটেই সর্বাংশে ঠিক নয়। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল কখনো কোনোদিন কোনোকিছু হয় না। মনের রয়েছে এক খণ্ড প্রগাঢ় স্বচ্ছ আয়না। সে আয়নায় ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠে অনেক প্রতিবিম্ব যা ফেলে আসা জীবনের মধুর অমধুর সঞ্চরণ। আবার চোখকে মনের আয়না বলা হয়ে থাকে কারণ ‘চোখ যে মনের কথা বলে।’
‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়’- অর্থাৎ মনের ভেতর রয়েছে লতাপাতায় আচ্ছাদিত তিমিরাবগুন্ঠিত এক গহীন অরণ্যের বসবাস। যেখানে ভাঁটফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা নিঝুম নিশুতি রাতে ডানা ঝাঁপটায় জানা-অজানা নিশাচর পাখি। থেকে থেকে ভেসে আসে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। কখনো কখনো শোনা যায় শিকারীর ফাঁদে ধরা পড়া বন্য হিংস্র প্রাণীর করুণ আর্তনাদ।
মনের সাথে মনের মিল না হলে ভাব হয় না, বন্ধুত্ব হয় না, ভালোবাসা হয় না। ‘মন মিললে মেলা, নইলে একেলা’। মনে মনে এক মন এক প্রাণ না হলে একা থাকাই ভালো। মনের মানুষ সবাই হয় না- একজন হয়। মনে যে ভালোবাসা জন্মে সেটিও মস্তিষ্কেরই কাজ। অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।
মনের রয়েছে ছোট্ট একখানা ঘর। সেই ঘরে দরজা আছে, জানালা আছে, আছে অলিন্দ, চিলেকোঠা, মণিকোঠা, আছে ছোট্ট একখন্ড আঙিনা। আঙিনায় রয়েছে পুস্পকুঞ্জ। সেই পুস্পকুঞ্জকে ঘিরে বিরাজ করে হরেক রঙের ফুল- ফুলে ফুলে প্রজাপতির বাহারি চমক, সেই সাথে ভ্রমরার গুঞ্জরণ। পাখিদের কিচির মিচিরে মুখরিত সারাবেলা। দরজায় কড়া নাড়ে কত শত কথা। কত শত স্মৃতি। চিলেকোঠায় বসে সেই স্মৃতির ঝাঁপিটা একবার খুলতে পারলেই হলো। ব্যস, হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে ফেলে আসা দিন। আর স্মৃতি হাতড়ে কুড়িয়ে পাওয়া যায় সেই দিনগুলোতে হারিয়ে যাওয়া একেকটা মণিমাণিক্য ও হীরক খ-। হাট করে খোলা দরজায় পা বাড়ালেই এক চিলতে বারান্দা। হু হু করে বহে মৃদু মন্দ সমীরণ সেই সাথে হৃদয়ের জলসাঘরে চলে অনুরণন, ‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে।’ আর জানালা? সে তো মহার্ঘ্য! ‘মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে, যার চোখ তাকে আজ মনে পড়ে না….।’ কার চোখ তাকে হয়ত মনে পড়ে না
কিন্তু চোখ দু’টো ঠিকই প্রোথিত হয়ে আছে অন্তরে। জানালা দিয়ে দৃষ্টি গলে কেউ হয়ত ঘুরে বেড়ায় চিরহরিৎ শস্য ক্ষেতে। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছোট আল পথে টায়ার গড়িয়ে ধীরে ধীরে দৃষ্টির অন্তরালে হারিয়ে যায় দুরন্ত কিশোর-কিশোরীর দল।
কেউ বা আবার নিরালা দুপুরে আঁধার কালো ঘনঘোর বর্ষায় উদাস নয়নে জানালায় বসে বাইরের ঝাপসা করা বৃষ্টির মধ্যে খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয়কে। আর তখনই হয়ত ভাবতে থাকে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়….।’ কি বলা যায় নিজেই জানে না। কিন্তু মনের জানালায় কারো চোখ একবার উঁকি দিয়ে গেলে সেই চোখ চিরদিনের জন্য বর্শাল ফলার মতো গেঁথে যায় অন্তরে। তারপর হাজার চোখের ভিড়েও সেই চোখগুলোকে আর মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। তাই কারো ‘মনের জানালা ধরে’ অযথা কখনো কারো উঁকিঝুঁকি না দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক: গল্পকার ও কলামিস্ট।