মুবিন খান
ভোরের আলো ভালো করে ফোটবার আগেই আম্মা খুব আদরে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, মুবা ওঠ, ওঠ বাবা, সকাল হইছে তো।
এইরকম ডাকাডাকি শুনে মজার ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়বার পক্ষে সঙ্গত কোনো কারণ নেই। কাঁথাটা ভালোমত জড়িয়ে হাত-পা নেড়ে কোলবালিশ খুঁজতে থাকি। এরপর মনে পড়ল, আম্মা নিজেই তো ডাকছেন! তাহলে পাবো কি করে! এই উপলব্ধিতে কাঁথাটা ভালোমত গায়ে জড়িয়ে পাশ ফিরে গুটিসুটি মারি।
সাড়া না পেয়ে আম্মা হতাশ হয়ে চলে যান। আবার ঘুমের গভীরে ডুব দিয়ে তলাতে থাকি যখন, আব্বা চলে এলেন। আম্মা তাঁর হতাশা আব্বার কাছে সোপর্দ করলেন, কেউ তো উঠতেছে না, এগো উঠান তো।
আব্বা বিছানার কাছে এসে আদর-ডাকের ধার দিয়েও গেলেন না। ধমকে উঠলেন, ওই! ওঠ্! ওঠ্ জলদি! সাতটা বাজে!
আমি খুব করে জানি মোটেও সাতটা বাজে না। কিন্তু আমার জানাজানিতে কিছু যায় আসে না। আরেকটা ধমক খেতে রাজি নই বলে উঠে বিছানায় বসি। বসেই থাকি। আব্বা ভেবে নিলেন আরেকটা ধমকের জন্যেই বসে আছি। হুংকার দিয়ে উঠলেন, উঠলি না!
এবারে বিছানা থেকে নামি। মোটেও সাতটা বাজে না। ঘড়ির কাঁটা সবে ছয় ছুঁয়ে লম্বা হাতে বারোকে ছুঁতে চাইছে। ঘর থেকে বেরুলে বারান্দা। তার এক কোণে রান্নাঘর। শেলী দুলতে দুলতে রুটি বেলছে। আম্মা পাশে জলচৌকিতে বসে তাওয়ায় রুটি সেঁকছেন। আমি দাঁড়াতে আম্মা মুখ ঘুরিয়ে চাইলেন, তারপর বললেন, যা, গোসল করে আয়। শিউড়ে উঠি। শীত চলে গেলেও বসন্তকে ভালোই দখলে রেখেছিল। রাতে কাঁথা নিয়েই ঘুমাতে হয় প্রায়ই। আর এখন বলে কি! গোসল করব মানে! কাঁথার উষ্ণতা ছেড়ে আসাতে এমনিতেই মেজাজ খারাপ। এখন বলছে গোসল করতে! মজা নাকি!
আমি বলি, এখন গোসল করমু ক্যান!
আম্মা বলেন, আজকে পয়লা বৈশাখ না! যাও বাবা, গোসল করে আসো।
গোসল ছাড়া উপায় নেই। গরম পানির দাবি তোলা দরকার। কিন্তু আব্বা কাছে পিঠেই রয়েছেন বলে দাবি তোলার সাহস হলো না। মগ দিয়ে পানি তুলে হাপুস হুপুস গায়ে ঢেলে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। দিপালী গামছা নিয়ে এসে গা মুছিয়ে দিল। এরপর ধুয়ে শুকিয়ে রাখা হাফপ্যান্ট-হাফর্শাট পরিয়ে বাঁ হাঁতে থুতনি চেপে ধরে চুল আঁচরে দিল। সন্দেহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে দিপালীর দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম কাজল বের করে কিনা। কাজল লেপ্টেই টিপ দেয়া দিপালীর স্বভাব। কাজল বের করলেই দৌড় দিতে হবে। তখনই আম্মা নাস্তা খেতে ডাকলেন। আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম।
নাস্তা খেতে সকলে মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে। শুরুতে পিরিচে করে সেমাই দেয়া হলো। আজ পয়লা বৈশাখ। বছরের পয়লা দিন। এদিনটা শুরু করতে হয় মিষ্টি মুখ করে। দুপুরে পোলাও-মাংস-কোরমা রান্না হবে। পাড়ার দোকানদারেরাও যার যার দোকানে মিষ্টি এনে রাখত। আমরা গিয়ে চাইলেই মিষ্টির বাক্স থেকে মিষ্টি তুলে দিত কিংবা মিষ্টির বাক্সটা সামনে ধরত, আমরা তুলে নিতাম। বাজারে গেলে আরো ভালো আপ্যায়ন। পিরিচে মিষ্টি এগিয়ে দিত। পরে জেনেছিলাম পয়লা বৈশাখ এলে সকল ব্যবসায়ীরা হালখাতা খোলে। সেজন্যে সকলকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। হালখাতা হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসেবের খাতার পোশাকি নাম। পয়লা বৈশাখে নতুন আরেকটি খাতার উদ্বোধন করা হয়। একে উপলক্ষ্য করেই দারুণ আড়ম্বরে ব্যবসায়ীরা ক্রেতা ও ব্যবসা সংশ্লিষ্টদেরকে মিষ্টি মুখ করিয়ে সম্পর্কের নতুন হিসেবটি খোলেন।
আমরা জেনেছিলাম, বছরের পয়লা দিনটি সুন্দরভাবে শুরু করলে, ভালো-মন্দ রান্না হলে, নতুন কিংবা ভালো পোশাক পরলে বছরের আর দিনগুলোও সেভাবেই কাটবে। এইটি কি কুসংস্কার? কু হয়ত নয়, তবে সংস্কার বটে। সংস্কার তো সংস্কারই। ওর কোনো ভিত্তি নেই তো। কিন্তু তখন তো আমরা ভিত্তি থাকা না থাকার এই ব্যাপারটা জানতে পারি নি। এ ছিল বিশ্বাস। আমাদের একলার নয়, সকলেরই।
আসলে পয়লা বৈশাখ একটা একটা স্বপ্ন দিন। এদিনে পুরো একটা জাতি একসঙ্গে স্বপ্ন দেখে, খুব বড় কোনো স্বপ্ন নয়। জীবনকে ঘিরে ছোট ছোট স্বপ্ন- নতুন বছরের অনাগত দিনগুলো মিষ্টি হয়ে শুরু হবে, একটু ভালো-মন্দ খাবে, ভালো পোশাক পরবে আর সুন্দর করে দিনটি কাটাবে। খুব অল্পেই বাঙালির সন্তুষ্টি আসে। সে খুব সহজেই আনন্দ হয়, হাসে, পছন্দ করে উৎসব করতে। সেকারণে জাতিগতভাবে ওই স্বপ্নটি সকল বাঙালীই দেখে। আর বাঙালীর এই স্বপ্ন, এই আকাঙ্ক্ষার জন্যেই পয়লা বৈশাখ তাৎপর্যপূর্ণ। সে চায় নতুন বছরে পদার্পণের মুহূর্তে পুরনো বছরের জীর্ণতাকে ধুয়ে ফেলতে। চায় গেল বছরের সকল আবর্জনা দূর করে দিতে।
নতুন বছর তাকে এনে দেবে সুখ, সুখের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে থেকে আসবে সমৃদ্ধি। কেবল ওই একটি দিন নয়, সব দিন, প্রতিদিন। জীবনে তার দেখা দেবে উন্নতি। ভবিষ্যৎ জীবনে তার সন্তানেরা যেন থাকে দুধেভাতে। এই নিশ্চয়তাটুকু নির্মাণ করা গেলেই সে পেয়ে যাবে আত্মপরিচয়ের গৌরব। এ গৌরব তার একলার নয়, সকলেরই। সকল বাঙালীর। এই ব্যবস্থাটিই তো সামাজিকতা। এইটিই ঐক্য। এখানে আমি তুমি বলে কিছু নেই। আর এই কারণেই পয়লা বৈশাখ সর্বজনীন, সকলের। এই সকলে, সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলই আমরা।
কিন্তু এই ‘আমরা’র বাইরে একটা পক্ষ আছে। এরা ঐক্য চায় না। এরা ভাগ করতে চায়। এরা আগেও ছিল। এখন আরো প্রকট হয়েছে। আমরা এদের থেকে আলাদা হতে চেয়েছি। বাঙালীকে এরা আগেও ভাগ করতে চেয়েছে। ভাগ করতে ধর্মকে টেনে এনে ব্যবহার করেছে। সফলও হয়েছে। সফল হবার পর রাষ্ট্র পরিচালক নয়, তারা শাসক হয়ে গেল। তারপর নখদন্ত বের করতে শুরু করল। নখদন্ত দেখিয়েই ক্ষান্ত হয় নি। কামড়ও বসিয়েছে, খামচে ধরেছে পতাকা, আরোপিতভাবেই। উদ্দেশ্যটি বাঙালীকে খাটো করা। প্রথম আক্রমণটা করেছে ভাষার ওপর। যে কোনো জাতির জন্যেই ভাষাটা হলো ঐক্যের প্রধান ভিত্তি। বাঙালীরও তাই। এই ভিত্তিকে ভেঙে আলাদা করতে চাইল তারা। বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে ঘোষণা করল একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এরপর চালাতে লাগল নিষ্পেষণ। কিন্তু বাঙালী আলাদা হতে চায় নি। বাঙালী ঐক্য চেয়েছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন হয়ে থাকতে চেয়েছে। ঐক্যে থাকতে চেয়ে নতুন করে ঐক্য গড়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে।
এই যুদ্ধটি বাঙালী চায় নি। যুদ্ধটি তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ করে সে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছে নতুন এক রাষ্ট্র- বাংলাদেশ।
কিন্তু বিভাজনের লোকেরা রয়ে গেছে। এরা ঐক্য চায় না। এরা ভাগ করতে চায়। সন্তানকে দুধেভাতে রাখতে চাওয়ার নির্ঝঞ্ঝাট স্বপ্ন দেখতে বাধা দিতে চায়। চায় সর্বজনীনতা থেকে ধর্ম আর বর্ণকে টেনে বের করে আলাদা করতে। এদের বক্তব্য হলো, পয়লা বৈশাখ হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। যদিও এরা জানে তাদের এ বক্তব্য আদৌ সত্য নয়।
এদের ভয়টা আসলে সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতির নিজের একটা শক্তি থাকে। এদের ভয় সে শক্তিটাকে। ফলে এই ভয়টা যৌক্তিক। সংস্কৃতির কাজটিই হলো মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন করা। সংস্কৃতির পরিচয়টি তো কৃষ্টি। আর কৃষ্টিতে থাকে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচারের মতো নানান মানবিক গুণাবলী। ফলে এইটি সুস্পষ্ট পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ নেই। যেমন নেই মানুষে মানুষে কোনো ভেদ। আর এই ভেদটাই এদের দরকার। মানুষের ভেতর ভেদটা ঢুকিয়ে দিতে পারলেই এরা নিশ্চিন্ত হন। তখন এদের আর কিছু করা লাগে না। আহরিত ভেদ-বুদ্ধিতে বাঙালী নিজেই বহু কিছু করে ফেলতে পারে। করছেও বটে। এইত ক’দিন আগে মুন্সিগঞ্জের এক স্কুলের ছেলেরা মিলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মিছিল করল। এরপর সে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হলো। শিক্ষক এখন কারাগারে। ঘটনাটা দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছে।
সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। সেসব এখন না বলি। তারচেয়ে চলুন একজন প্রয়াত স্বল্পপ্রজ লেখক কি বলেছেন সেটি একবার দেখি, ‘সংস্কৃতি নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ‘আজিকালি বড়ো গোল’ দ্যাখা যায়। প্রতিপক্ষ ছাড়া কোন তর্ক তেমন জমে না, সংস্কৃতি বিষয়ে কথাবার্তায় একটি শত্রুপক্ষ জুটে গেছে, এই শত্রুবরের নাম অপসংস্কৃতি। শহর এলাকায় তো বটেই, নিম-শহুরে জায়গাগুলোতেও সচ্ছল, এমন কি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা রঙ-বেরঙের নানা রকম রম্য পত্রিকা, টিভি, ফিল্ম ও ভিসিআরের কল্যাণে অপসংস্কৃতির চর্চা প্রাণ ভরে দ্যাখে এবং নিজেদের জীবনে তার যথাযথ প্রয়োগে জন্য একনিষ্ঠ সাধনা চালায়। এই সাধনা আবার বিনা খরচায় হয় না, এর জন্য পয়সার দরকার। সদা পরিবর্তনশীল কাটছাঁটের কাপড় চোপড়, স্টিকার, চেন ইত্যাদি তো বটেই, কোকাকোলা থেকে শুরু করে মদ, গাঁজা, চরস, ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডার, টিভি, ভিসিআর, হোন্ডা, গাড়ি-যে যেমন পারে- প্রভৃতি উপাদান ছাড়া এই সাধনা অব্যাহত রাখা বড়ো কঠিন। এখানে ক’টা বাপমা আছে যারা নিয়মিত এসবের জোগান দিতে পারে? তা সে জন্যেও সাহায্য করার জন্য আমাদের টিভি, ও সিনেমাওয়ালারা সদা প্রস্তুত। হাইজ্যাক, চুরি, ডাকাতি, মারামারি, লম্ফ-ঝম্ফ প্রভৃতির ছবি দেখিয়ে যুব সম্প্রদায়কে এরা অর্থ সংগ্রহের শর্টকাট পথ রপ্ত করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। অর্থাগম হচ্ছে দেখে এদের ‘রক্ষণশীল’ বা ‘রুচিশীল’ বাপমাও চুপচাপ থাকাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন। কারণ কোনো কোনো কর্তব্যপরায়ন পুত্র তাদের উপার্জিত অর্থের খানিকটা বাড়িতেও ঢালে। এছাড়া, এইসব যুবকের অনেকের মধ্যে আজকাল ধর্মচর্চার প্রবণতাও দ্যাখা যায়। সব ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সময় না পেলেও শুক্রবার এরা মসজিদে যায়, মহা ধুম-ধাম করে ঈদ-শবেবরাত করে, পীরের পেছনে অকাতরে টাকা ঢালে, তাবিজ নেয়, সুলক্ষণা পাথর কেনে এবং মাজার দেখলেই সেজদা দেয় । এই সব দেখে পরহেজগার বাপমা বেশ তৃপ্ত, ‘না, যে যাই বলুক, চুরি-ছ্যাঁচড়ামি, হাইজ্যাক, ডাকাতি যাই করুক, মদ গাঁজা যতোই টানুক, কিন্তু ছেলের আমার ধর্মে মতি আছে; পীরের তেজে এইসব উপসর্গ একদিন ঝরে পড়বে, ততোদিনে ঘরে দু’টো পয়সা আসছে আসুক, ছেলের কল্যাণে বাপমাও জাতে উঠতে পাচ্ছে, এটাই বা কম কি ?’
(সংস্কৃতির ভাঙা সেতু / আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সংস্কৃতি, দশম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৮৪)
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।