ইংরেজি এপ্রিল এলেই বাংলা সাল নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়ে যায়। উপলক্ষ্যটি ১৪ এপ্রিল। ১৪ এপ্রিল মানে পয়লা বৈশাখ। বছর জুড়ে বাংলা মাস কিংবা তারিখের খোঁজটি না রাখলেও পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা চাই। আর সে উদযাপনের হিসেবটি করা হয় ইংরেজি ১৪ এপ্রিল দিন গণনায়। যদিও ইংরেজি সাল বলে কিছু নেই। এর পরিচয় গ্রেগরিয়ান বছর। খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের জন্মের বছর থেকে গণনা করা হয় বলে এর নাম খ্রিস্টাব্দ। যাক, এটি আমাদের আলোচ্য নয়। আমাদের আলোচ্য বঙ্গাব্দ।
তো ১৪ এপ্রিল ঘনিয়ে এলেই বাংলা বছর বা বঙ্গাব্দ নিয়ে বেশ একটা নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। এই যে দেখুন, অনুস্বরের এ সংখ্যাটিও সে নড়াচড়ারই অংশ বটে। অনুস্বর আসলে শেকড়ে যেতে চাইছে।কতটা পেরেছে বলা মুশকিল। তবে চেষ্টাটা আছে।
সংস্কৃতি বলে আমরা যাকে অভিহিত করি তার মূলধারাটির পরিচয় লোকসংস্কৃতি। আর এই লোকসংস্কৃতিই হলো আবহমান বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতার প্রকৃত পরিচয়। প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে বটে কিন্তু সগর্বে ধরে রেখেছে আমাদের ঐতিহ্য। আমরা দেখি। দেখে দেখে আবেশে আপ্লæত হই। সগর্বে সে আবেশ প্রকাশও করি। সংস্কৃতির মূল উৎসটি জীবন ও জীবিকা। আর আবহমানকাল ধরে আমাদের জীবন-জীবিকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে কৃষি। জাতিগতভাবে কৃষক আমরা। আমি, আপনি হয়ত এখন কৃষক নই কিন্তু আমাদের পিতামহ, প্রপিতামহ কিংবা তাঁর পিতা- এভাবে বংশ পর¤পরায় অতীত থেকে যদি হেঁটে আসেন- পরিচয়টি তখন কৃষক-পুত্রই বেরুবে। এই কৃষিতে ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে আমার, আমাদের সংস্কৃতির উৎস থেকে বিকাশ। এবং এই যে বিকশিত সংস্কৃতি, এর মধ্যেই প্রোথিত রয়েছে বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয়।
বাংলায় ইতিহাসবিদরা বলছেন, দু হাজার বছর আগে প্রস্তর যুগের এবং প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। প্রস্তর যুগ হলো মানুষ ও তার সমাজের বিবর্তনের যে ধারা, তার একটি পর্যায়। সেসময় মানুষের অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের প্রধান উপকরণ ছিল পাথর। বিষয়টা দাঁড়াল, তখনো এই বাংলায় জনপদ ছিল। হরপ্পা নগর-সভ্যতার আরম্ভকাল প্রায় ২৭০০ খ্রিস্টপূর্ব । প্রায় এক হাজার বছর পর হরপ্পা নগর-সভ্যতার অবসান হয় প্রায় ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। নগর পরিকল্পনা ও শিল্পকলায় হরপ্পা সভ্যতার নাগরিকরা দক্ষতার ছাপ রেখে গিয়েছেন। হরপ্পা নগর-সভ্যতার অবসান পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশের মানব-বসতি আবার গ্রামীণ-সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে, যা তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতি নামে পরিচিত। এ সময়ে উপমহাদেশের কোথাও কোনো নগরের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম নগরগুলি ছিল মহেঞ্জোদারো, কালিবান, চানহুদারো, কোটদিজি, আলমগিরপুর, রংপুর, বানওয়ালি, লাথোল, সুরকোটরা, রাজেদি প্রভৃতি। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বিকশিত হওয়া এই সভ্যতায় উন্নত রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, পয়ঃপ্রণালী, স্নানাগার, শস্যাগার প্রভৃতির নির্মাণ ও নির্মাণ কৌশল উন্নত নগর সভ্যতার পরিচয় বহন করে।
নৃতাত্তি¡কভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মূলে নিগ্রোয়েড ধারার মানবজাতি, আর তার সাথে সংমিশ্রণ ঘটেছে তিন মহাজাতি নিগ্রোয়েড-মঙ্গোলয়েড ও ইউরোপয়েড ধারার নানা সংযোগী বর্গের। বাংলার মূল যে গ্রামীণ সমাজকাঠামো ও সংস্কৃতি তাতে সিংহভাগ অবদান ভাষাজাতি অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের, ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তারকারী অপর ভাষাজাতি আর্যদের প্রভাব বাংলায় সীমিত। তিন প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলাম বাংলার জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আর ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ইতিহাসের মধ্যপর্বে মধ্যপ্রাচ্যের ইরানি-তুরানি ও আরব সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে এখানে। এর মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে পারস্যসভ্যতার নানামুখী মৌলিক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলাম যে ধর্মই হোক বাংলায় তার বিকাশ ঘটেছে মূল সাংস্কৃতিক প্রণোদনার স্বভাবধর্মে। হয়ত মন্তব্য হিসেবে একটু কঠোর শোনাবে তবু সত্য এই যে বাংলা চিরকালই শাস্ত্রবিরোধী। কি হিন্দু কি বৌদ্ধ কি মুসলিম সব আমলেইÑ ‘মানবপন্থী বাংলাদেশ’ শাস্ত্রপন্থী সমাজনেতাদের কাছে নিন্দিত হয়েছে। এমনকি এই সেদিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্মনির্বিশেষে বাঙালির ওপর নিষ্ঠুর হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার বড় কারণ তাদের শাস্ত্রপন্থী বিচারে বাঙালি মুসলমান যথেষ্ট মুসলিম নয়; তাদের ধারণায়, হিন্দুয়ানি দোষে দুষ্ট এই মাটি থেকে উদ্ভ‚ত বৌদ্ধ সহজসাধনা, গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন, নানা ধারার সুফিসাধনা, এবং আরও একান্তভাবে বাঙালির নিজস্ব সাধনা আউল বাউল কর্তাভজা নাথপন্থা কোথাও শাস্ত্রের শাসনদÐের গুরুভার নেই, আছে স্বতঃস্ফ‚র্ত সাধনার প্রাণময় আবহ।
বাংলার নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায়। বাঙালির নববর্ষ আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল চড়ক উৎসব, ঘুড়ি ওড়ানো, গরুর দৌড়, হালখাতা, পুণ্যাহ এবং ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা আরাধনা ও মেলা। ইতিহাসে দেখা যায় যে এক সময়ে অগ্রহায়ণ মাস থেকে নববর্ষ শুরু হতো। কিন্তু কখন থেকে কিভাবে বৈশাখ মাসে নববর্ষ হলো তা পরিষ্কারভাবে জানা যায় না। অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান তোলা হয়, কৃষকের ঘরে ওঠে ফসল। অতএব আনন্দের মাস অগ্রহায়ণ। নববর্ষে যে সব আচার-অনুষ্ঠান হয় সে স¤পর্কে প্রখ্যাত পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘আমাদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদিতে কোথাও বৈশাখে নববর্ষ উৎসব স¤পর্কিত আচার নির্দেশ নেই।’ তাহলে নববর্ষের আচার-অনুষ্ঠান হিন্দুদের শাস্ত্রীয় আচার নয়, অতি প্রাচীন স্থানীয় বাসিন্দাদের লোকাচার বলেই মনে করা হয়। কৌম জীবনের সঙ্গেই এর সম্পর্ক। হালখাতা, পুণ্যাহ প্রভৃতি নববর্ষের উৎসবসমূহ অর্বাচীন।
ইতিহাসের নানান বইপত্র ঘেঁটে দেখা যায় অনেকে দাবি করছেন, গৌড়াধিপ রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল ৫৯৩-৬৩৫ খ্রিঃ) বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ চালু করেন। তবে আরেক পক্ষ এই ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বলছেন, গৌড়রাজ শশাঙ্ক এই সন প্রবর্তন করতে পারেন না। তাদের যুক্তি গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের আমলে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে বাংলা বা বঙ্গ নামে কোনো রাজ্যের পরিচিতি গড়ে ওঠে নি। আবার আরেক দল বলছেন, মহারাজা বল্লাল সেন বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের উদ্ভাবক। ইতিহাস গ্রন্থ জানাচ্ছে ইনি বিক্রমপুরের বল্লাল সেন। তবে প্রতিষ্ঠিত মতটি হলো, মোগল সম্রাট আকবর (রাজত্বকাল ১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ) খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর ফসলি সন বা বাংলা সন চালু করেন।
এরপর ধীরে ধীরে নতুন বছরের আগমনকে কেন্দ্রে রেখে আয়োজিত হতে লাগল নানান উদযাপন। পয়লা বৈশাখে ভর করে এল হালখাতা। হালখাতা বাঙালী ব্যবসায়ীদের উৎসব যেন। এদিন তারা পুরনো বছরের হিসেব গুছিয়ে তুলে রেখে নতুন হিসেবের খাতা খোলে। এই খাতার নামই হালখাতা। এর উদযাপনে চলে মিষ্টিমুখ। হালখাতার অনুষ্ঠান পয়লা বৈশাখের একটি সর্বজনীন একটি রীতি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পালন করত। বাঙালীর নববর্ষ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হালখাতা উৎসব। কৃষক প্রত্যেক চাষাবাদ চৈত্র মাসের শেষ দিনে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। পরদিন পয়লা বৈশাখ ভ‚মির মালিকরা তাদের প্রজাদের জন্যে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। পরবর্তীতে তা ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা বন্ধ করতে পয়লা বৈশাখের দিনে নতুন পোশাকে বসতেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো ‘নববর্ষে’ হালখাতার হিড়িক পড়ে প্রত্যেক গ্রামগঞ্জে।
বাংলা নতুন বছরকে কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে বসত বৈশাখী মেলা। কৃষিজ পণ্য, কুটির শিল্প দ্রব্য, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, নানান হস্তশিল্প, প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র বেচা-বিক্রির ধুম পড়ে যেত মেলায়। থাকত বাঁশের বেতের তৈজসপত্র আর নানান রকম খেলনা সামগ্রী। নারকেল মুড়কিসহ কত কি থাকে মেলায় সে খোঁজ পাওয়াও মুশকিল। বৈশাখী মেলাকে উপলক্ষ্য করে আয়োজন হতো নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা। সেসময় মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসতো বাপের বাড়ি। সকলেই বৈশাখী মেলায় হয়ে যেত আনন্দে আত্মহারা।
বাঙালির নতুন বছর উদযাপন অনন্য বৈশিষ্ট্যময় এক উৎসব। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে স¤পর্কিত। যেমন শুরুতে খ্রিস্টাব্দের কথা বলা হলো, যিশুর জন্মের সঙ্গে স¤পৃক্ত বলেই খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় কোনো অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরেই এর উৎপত্তি ও প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো- হালখাতা। কালের বিবর্তনে পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠল সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসবের প্রেরণা। সকল ধর্ম-স¤প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী সকলের জীবনেই স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়।
তথ্য সূত্র:
স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি – আবুল মোমেন, বঙ্গাব্দ – জয়নাল আবেদীন খান, বাংলায় নগরায়ন- সুফি মোস্তাফিজুর রহমান মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, মিজানুর রহমান, হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা- ইটিসি বাংলা, ‘বাংলা সন ও আমাদের সংস্কৃতির রূপান্তর – শামসুজ্জামান খান, শুভ হোক নতুন গ্রেগরিয়ান বছর- শাহ্ জে. চৌধুরী।
লেখক: সাংবাদিক