প্রথমেই আমরা দেখব কীভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো-
৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ কানাডায় বসবাসরত Mother Language Lover of the World নামের একটি বহুভাষী ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী গ্রুপ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। এই পত্রে তারা উল্লেখ করেন যে, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার না করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে, কাউকে মাতৃভাষা ভুলে যেতে বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে, সেসব ভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না। কোনো কোনো। চমৎকার ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করেন, এসব কিছু সব ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে’র মারাত্মক লঙ্ঘন।
এক সময় বাংলা ভাষাকেও এই সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বলে। তাদের আবেদনে তারা ২১ ফেব্রুয়ারির পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। বাঙালি ভাষার জন্য যে জীবন দিয়েছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। সেজন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিলে প্রতিটি মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত দিবস হবে।
এই আবেদনপত্রের উত্তরে তাদের জানানো হয় যে, বিষয়টি নিয়ে ইউনেস্কোতে যোগাযোগ করতে হবে। সে অনুযায়ী তারা ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের নিকট প্রস্তাব পেশ করেন । ইউনেস্কো উক্ত গ্রুপটিকে জানায় যে, এ ধরনের প্রস্তাব ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রসমূহের যে কোনো জাতীয় কমিশন কর্তৃক উত্থাপিত হতে হবে। ভাষাপ্রেমী গ্রুপের পক্ষে রফিকুল ইসলাম টেলিফোনে বিষয়টির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শিক্ষাসচিব বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের মহাসচিবকে অবহিত করেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে প্রস্তাবটি ইউনেস্কো সদর দপ্তরে যথাসময়ে পেশ করে।
১৯৯৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ত্রিশতম সাধারণ সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা সংরক্ষণ এবং শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে বহুভাষা ব্যবহারে অগ্রগতি অর্জন সম্পর্কিত ইউনেস্কোর নীতিমালার আলোকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে প্রতি বছর তা বিশ্বের সকল সদস্যরাষ্ট্র ও ইউনেস্কো সদর দপ্তরে উদ্যাপন করার জন্য একটি রেজুলেশন প্রস্তাব পেশ করে।
ইউনেস্কোর ২৮টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাব লিখিতভাবে সমর্থন করে। দেশগুলো হলো: বেনিন, বাহামা, বেলারুশ, কমোরস, চিলি, ডোমিনিকান রিপাবলিক, মিশর, গাম্বিয়া, হন্ডুরাস, ইতালি, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, আইভরি কোস্ট, লিথুয়ানিয়া, মালয়েশিয়া, মাইক্রোনেশিয়া, ওমান, ফিলিপাইন, পাপুয়া নিউগিনি, পাকিস্তান, প্যারাগুয়ে, রাশিয়া, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, সুরিনাম, স্লোভাকিয়া ও ভানুয়াতু । Draft Resolution-35 হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশের প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর ল্যাংগুয়েজ furenta FCATTO Advisory comittee on Linguistic Pluralism and Multilingual Education-এর মাধ্যমে বিবেচনার জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণের পক্ষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক মহোদয় অভিমত ব্যক্ত করেন ।
দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাবটির উপস্থাপন যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পূর্বেই তা সাধারণ সম্মেলনে উপস্থাপনের পক্ষে মহাপরিচালকের পরিবর্তিত অভিমত আদায় করে। এরপর ১২ এবং ১৬ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে কমিশন-২ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পাস করা হয় ও সাধারণ সম্মেলন অধিবেশনে উপস্থাপন করার জন্য সুপারিশ করা হয়।
১৭ নভেম্বর সাধারণ সম্মেলনের অধিবেশনে সকল সদস্যরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে তা প্রতিবছর সকল সদস্যরাষ্ট্র ও ইউনেস্কো সদর দপ্তরে উদযাপন করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, যে দু’জন বাঙালি বিদেশে বসে নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন তাঁদের নামও রফিক এবং সালাম । ভাষা-শহীদ রফিক এবং সালামের সঙ্গে এক অদৃশ্য হৃদয়বন্ধন।
যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন তাদের যেমন আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি, তেমনি প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ । তারা এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের ভূমিকাকেও যথাযোগ্যভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। কোনো ইতিহাস থেকে কারও নাম কোনোভাবে বাদ পড়া ইতিহাসের শিক্ষা নয় ।
বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। আমরা ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। আমরা নানাভাবে বাংলাকে আন্তর্জাতিক দরবারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা চেয়েছি নিজেদের পরিচয়কে বিশ্বের দরবারে পৌছে দিতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে বাঙালির পরিচয় বিশ্বের মানুষের কাছে ব্যাপক হয়েছে। জাতিসংঘের আহ্বানে যেমন মে দিবস, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস, বিশ্ব শিশু দিবস, জনসংখ্যা দিবস, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়, তেমনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে।
তবে এটাও সত্যি এই অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেল আমাদের। আমরা ভুলে যেতে পারব না যে আমাদের এই গৌরব শুধুই উৎসব বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রবল কর্তব্যেরও।
১৯৫৩ সাল থেকেই অমর একুশে পালিত হয়ে আসছে, বহু বছর প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতার পর থেকে বাধাবন্ধনহীনভাবে। এ বছর অমর একুশে পালিত হচ্ছে শুধু অমর একুশে হিসেবে নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও। দিনটিতে একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত হলো।
পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর বহু অঞ্চলে একসময়কার জীবন্ত কোনো ভাষা পরবর্তীকালে বিশেষ কোনো কারণে লুপ্ত হয়ে গেছে। ভারতে দেখা গেছে হিন্দি ভাষার প্রভাবে উত্তর ভারতের অনেকগুলো উপভাষা হিন্দির অঙ্গীভূত হয়ে গেছে অথবা যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময়ে বড় রাষ্ট্রগুলো ছোট রাষ্ট্রকে শুধু আগ্রাসনই করে নি, তাদের মাতৃভাষা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং তা করতে সফলও হয়েছে। কারণ, ঔপনিবেশিক দখলদারেরা জানে মাতৃভাষাকে ভুলিয়ে দিতে পারলে মানুষ তার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করতে পারবে না। আস্তে আস্তে বিলোপ হবে তার জাতিসত্তার ধারণা এবং কালক্রমে সে জাতি হবে দখলদার শাসকগোষ্ঠীর বশংবদ, যারা প্রভুর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। এছাড়া দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনও একটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার চর্চা ধীর প্রক্রিয়ায় মুছে ফেলার চেষ্টা করে। এভাবে অনেক দেশ হারিয়েছে তাদের মাতৃভাষা, আবার কোথাও ভাষা স¤পূর্ণভাবে বিলোপ না হয়ে শাসকগোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে মিশে ভিন্ন ভাষা তৈরি হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশে এমনটি ঘটেছে। সেখানকার অনেক দেশের ভাষা ‘পিজিন ইংরেজি’ নামে পরিচিত, অর্থাৎ সেখানে ঘটেছে দেশীয় ভাষার সঙ্গে ইংরেজির সংমিশ্রণ। আমাদের বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে, পৃথিবীর যে অঞ্চলে যত ছোট ভাষাগোষ্ঠী থাকুক না কেন, তারা নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে আজ সগৌরবে বিশ্বের দিকে তাকাতে পারবে। জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকবে প্রত্যেকের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান।
এখানে আমি একটু ভিন্ন কথা বলতে চাই। গত সপ্তাহে ঢাকায় এসেছে আমার অস্ট্রেলিয়ান বান্ধবী হানিফা দীন। হানিফার বাবা-মা অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্র্যান্ট হন হানিফার জন্মের আগে। তাদের মূল বাড়ি পাকিস্তানে। হানিফা নন-ফিকশন রাইটার। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলিম মহিলাদের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি বই লিখেছে ইৎড়শবহ ইবহমধষ নামে। এই বই লেখার ব্যাপারে হানিফা পাঁচবার বাংলাদেশে এসেছে। এবারে ওর সঙ্গে এসেছেন ওর স্বামী ফ্রানেজ ওসওয়াল্ড। তিনি পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার কাটিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিষয়ক সিনিয়র লেকচারার, সমাজবিজ্ঞান ও এশিয়ান ভাষা বিভাগে। ড. ফ্রানজ গতকাল কাগজে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিষয়ে পড়ার পর আমার সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন ভাষার অসংখ্য ইমিগ্র্যান্ট আছে, আমরা তাদের ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার কথা বিভিন্ন ফোরামে বলছি। তা ছাড়া এমন অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে, যাদের ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একটি গোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্ম অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি শিখে নিজের ভাষা ভুলে গেছে। ওদের শেষ বুড়ো মানুষটি মরে যাওয়ার পর ভাষাটি শেষে যে উচ্চারণ করেছে, সেটি একটি তোতাপাখি। পাখিটি মরে গেলে ওই ভাষা আর কেউ বলেনি। এটি শোনার পর আমি তাঁকে বললাম, ড. ফ্রানজ এটা কি রসিকতা? তিনি মৃদুকণ্ঠে বললেন, না, রিয়ালিটি। এমন রিয়ালিটি কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনে যেন আর না আসে।
নতুন মাত্রার এই একুশে ফেব্রুয়ারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। প্রশ্ন করার কথা বলছি এজন্য যে, অমর একুশই আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। প্রশ্ন করার অধিকার, স্বাধীনতা ও সুযোগ যদি না থাকে বা খর্ব হয়ে যায় তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারির অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমার প্রথম প্রশ্ন, এই যে নতুন মাত্রা, এই মাত্রা একুশে ফেব্রুয়ারির মূল সত্তাকে ঢেকে ফেলবে না তো? এমন হবে না তো যে, এই দিনটি এক সময়ে, হয়ত একশ’ বছর পরে, কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেই মানুষ মনে রাখবে, একুশে ফেব্রুয়ারি হিসেবে নয়? এই মুহূর্তে অবশ্য এ রকম আশঙ্কা আমি দেখি না, কিন্তু এখন যা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না, ভবিষ্যতে তাই যে সত্য হবে না এমন কে বলতে পারে? আমি এখন আশঙ্কা দেখি না এ কারণে যে, এ মুহূর্তে এ দিবসটি প্রধানত বাংলাদেশেই পালিত হচ্ছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে পালিত হচ্ছে এমন আমার জানা নেই। কেন হচ্ছে না? অন্য দেশের মানুষ কি তাদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসে না?
বছরের একটি দিনকে সে ভাষার জন্য উৎসর্গ করতে পারে না? নাকি ভাষার জন্য এ মমত্ববোধ কেবল আমাদের একার? তাই যদি হয় এই একাকী অবস্থানে আমি নিঃসঙ্গ বোধ করব না, গৌরববোধ করব আশা করব এ গৌরব একদিন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে। আশা করব এ গৌরব সত্ত্বেও একুশে ফেব্রুয়ারি এতদিন যেমন ছিল ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে চাই না যে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে শুধুই মাতৃভাষা দিবস নয় একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে শহীদ দিবসও। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো কোনো দ্বিতীয় দিন নেই আমাদের জীবনে এই দিনটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ -নির্বিশেষে সব মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করেছে। আমরা সবাই এক হয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করি। এটিও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক সর্বজনীন উৎসব কিন্তু একুশের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। একুশের সঙ্গে আছে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া শহীদেরা, আছে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় সমুন্নত করার ত্যাগের প্রাণশক্তি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলব কেন? এমন কোনো ভাষা আমার জানা নেই, যা কোনো না কোনো মানুষের মাতৃভাষা নয়। এমনকি যেসব ভাষা হারিয়ে গেছে কিংবা মৃত হয়ে গেছে, সেসব ভাষাও কোনো না কোনো সময় কারও না কারও মাতৃভাষা ছিল। এদিক থেকে দেখলে, ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস না বলে, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস বলাই কি অধিকতর সমীচীন নয়?
মাতৃভাষা কাকে বলে? এর দুটি উত্তর হতে পারে। প্রথমত, একজন ব্যক্তির মা যে ভাষায় কথা বলেন সেটিই তার মাতৃভাষা। আমাদের দেশে কোটি কোটি মা আছেন, যাঁরা তাঁদের আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তাঁদের সন্তানদের মাতৃভাষা তাহলে সেই আঞ্চলিক ভাষাই, অন্য ভাষা নয়।
কিন্তু এসব সন্তান কালক্রমে অন্য ভাষা আয়ত্ত করতে পারে, বাংলাদেশের একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষ সে অঞ্চলের ভাষায় কথা না বলে প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে এবং সে আঞ্চলিক ভাষা ভুলে না গেলেও প্রধানত জীবনযাপনে প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারে।
এই ব্যক্তিটির মাতৃভাষা বলতে আমরা কী বুঝব? মায়ের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আঞ্চলিক ভাষা, নাকি নিজ চেষ্টায় অর্জন করা প্রমিত বাংলা ভাষা? কোন ভাষার জন্য আমরা এই দিবসটি পালন করব? দ্বিতীয়ত এমন হতে পারে একজন মানুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাষা অর্জিত ভাষা থেকে স¤পূর্ণ ভিন্ন। আমি এ দেশের অনেক মানুষকে চিনি, যাঁদের মাতৃভাষা সিলেটি এবং অর্জিত ভাষা ইংরেজি, তাঁরা বাংলা জানেন না এবং বাংলা বলতেও পারেন না। তাঁদের মাতৃভাষা বলতে কোনটি বোঝাব? তৃতীয়ত এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা একইসঙ্গে একাধিক ভাষায় পারঙ্গম। একইরকম স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে এবং অবলীলাক্রমে এ দেশের অনেক মানুষ একইসঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা বলেন। যখন ইংরেজি বলেন তখন তাঁদের মনেই পড়ে না যে, তাঁরা একটি বিদেশি ভাষা বলছেন। যখন বাংলা বলেন, তখন তাঁরা ইংরেজির মিশেল দেন, কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ এসে পড়ে, ইংরেজি দেখা দেয়, এসব মানুষ প্রকৃতপক্ষে দ্বিভাষিক। মাতৃভাষা বলতে যদি আমরা অর্জিত ভাষা বোঝাই, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাষা নয়, তাহলে এসব মানুষের মাতৃভাষা বলতে আমরা কী বোঝাব? আমাদের এসব জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। শুধু ভাষাপ্রেমিক হিসেবে নয়, সত্যসন্ধানী হিসেবে এবং নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখার শক্তিতে উজ্জীবিত মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আমাদের পরিচয় দেখা দিক। যে ভালোবাসা ভাবালুতায় আচ্ছন্ন কুয়াশার আবরণ সৃষ্টি করে, নানা স্বার্থবুদ্ধিতে বিভ্রান্ত করে, সেই ভালোবাসা নয়, ভাষার জন্য আমাদের অনুভব হোক স¤পূর্ণ খাঁটি এবং শুধু আমাদের নিজের ভাষার জন্য নয়, সব ভাষার জন্য। একটি আনন্দের বিষয় এই যে, ভাষা-শহিদদের কথা এখন সারা বিশ্ব জানতে পারবে, তারা আমাদের থাকবেন কিন্তু একইসঙ্গে হবেন বিশ্বের সব মানুষের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক