ঘরখানা বানিয়েছিল উমাতারার স্বামী পঞ্চানন। সে কী আর আজকের কথা? নয় নয় করেও বাইশটা বছর হয়ে গেল। তার আগে ছিল মাটির দাওয়ায় বাঁশের খুঁটির ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া চৌচালা ছোট্ট একখানি ঘর। পূব মুখো ঘর। ঘরের সামনে উঠোন। উঠোন পেরোলে মাঠ। মাঠ বলতে ফসলের ক্ষেত। যেখানে সারা বছর রাজ্যের ফসল রোদে গা মেলে দিয়ে শুয়ে থাকত। পূবের হাওয়া সেই সব ফসলের গায়ের গন্ধ মেখে ভেসে এসে ঢুকে যেত একেবারে ঘরের মধ্যে। বেশ লাগত উমাতারার। সকাল-বিকেল উঠোনের সাথে সাথে ঘরের মেঝেটাও ঝাঁট দিত নিয়ম করে। মাঝে মধ্যেই গোবর জলের লেপা দিত। লক্ষ্মীপূজো এলে চালের গুঁড়োর আলপনা দিয়ে সাজাত বেশ করে। সে ঘরে না ছিল তেমনি শীত, আর না ছিল গরম। গাঁয়ে তখনও কারেন্ট ঢোকে নি। সন্ধে হলেই ঘুটঘুটে আঁধারে ঘিরে ধরে চারপাশ। ঝিঁঝিঁ ডাকে। জোনাকগুলো জ্বলে ওঠে। মাথার ওপরে বিরাট একখানি আকাশ। রাজ্যের তারা সেখানে সারারাত ফুটে থাকে বেলকুঁড়ির মতো। মন্দ লাগত না অমন একখানি ঘরে থাকলে। তা সত্তে¡ও এক সন্ধেবেলায় নিশিগঞ্জের হাট থেকে ফিরে পঞ্চানন বলল, বুঝলে গৌরের মা, ঘরখানি নতুন করে না দিলেই নয়। ভাবছি সামনের ফাল্গুনেই-
আচমকা স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে উমাতারা তো অবাক। চোখ জোড়া কপালে তুলে বলল, বলো কী? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?
পঞ্চাননের মুখে হাসি। বলল, মাথা আমার ঠিকই আছে।
উমাতারা বলল, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কেন? এই ঘরখানা খারাপ কী আছে শুনি, যে এতে থাকা যাবে না?
কত বয়স হলো এই ঘরের জানো? খুঁটিগুলো দ্যাখো কেমন নড়বড়ে হয়ে গেছে। ঝড়-বাদলায় চাল চুইয়ে জল পড়ে। পোকামাকড়ে বাসা বানায়। না গো, এ ঘর পাল্টাতেই হবে।
অগত্যা সেবার ফালগুনেই নতুন ঘর উঠল ভিটের উত্তর পোতায়। দক্ষিণমুখো ঘর। কাঠের খুঁটি। টিনের চালা। বেড়াটাও টিনের। বছর বছর পাল্টানোর ভাবনা নেই। ঝড়-বাদলায় চালা উড়ে যাওয়ার ভয় নেই। জল পড়ার ভাবনা নেই। নিশ্চিন্তের একখানি আশ্রয়।
আজ পঞ্চানন নেই। তবে ঘর খানি আছে। আর আছে পঞ্চাননের স্মৃতি। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে ঘরটাকে পরম মমতায় আঁকড়ে পড়ে আছে উমাতারা। এখন দুপুর। রোদ ভাজা চৈত্র দুপুরের অসহনীয় উত্তাপ ছলকে ছলকে নেমে আসছে আকাশের গা বেয়ে। ঘরের দাওয়ায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে উমাতারা। বয়সের সাথে সাথে মনটাও তার বুড়িয়ে গেছে। সেই কবে এ সংসারে বৌ হয়ে এসেছিল। কত বছর হয়ে গেল তারপর। দু চোখ দিয়ে এতদিনে কত কিছুই না দেখা হলো। দেখছে এখনও। আর কতই বা দেখতে হবে কে জানে।
বসে বসে এ সব কথাই ভাবছে উমাতারা। খানিক আগে এ বাড়িতে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেছে। কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে পড়েছিল দুই বৌ। দুটোই মুখরা। যখন কথা ছোটায় পাড়া প্রতিবেশীরাও কানে আঙুল চাপা দিয়ে থাকে। হেন কথা নেই যা ওদের মুখ দিয়ে বেরোয় না। একটা সময় মাঝে মধ্যে হলেও ইদানিং সেটা নিত্যদিনে এসে দাঁড়িয়েছে। উমাতারা কিছু বলতে পারে না। যাকেই বলতে যাবে সে ই দু কথা শুনিয়ে দেবে। কী দরকার অমন যেচে কথা শোনার। তবুও এক আধবার থাকতে না পেরে দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দুজনকেই বলে, এবার থামো দেখি বৌমা। ঢের তো হলো। পাড়ার মানুষ বলবে কী?
অমনি দু বৌয়ের এক সুর, পাড়ার লোকের খাই? না পরি? কে কী ভাবল তাতে আমার কী?
বৌদের এমন বেসুরো হতে দেখে চুপ করে যায় উমাতারা। দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে আকাশ দেখে। আকাশের গা থেকে গড়িয়ে নামা রোদ্দুর দেখে। উড়ে যাওয়া পাখি দেখে। চারপাশের গাছপালা দ্যাখে।
এখনও তেমনি দেখছে। তবে ঝগড়াটা আর নেই। খানিক আগেই থেমে গেছে তা। ছোট বৌয়ের সঙ্গে পেরে না উঠে বড় বৌ মাঠে গেছে স্বামীকে ডাকতে। আজ তার হেস্তনেস্ত কিছু একটা চাই। এই জ্বালা সে আর সহ্য করতে পারছে না। বাড়ির বড় বৌ, অথচ এতটুকু সন্মান নেই তার?
ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল উমাতারার। আর ঠিক তক্ষুনি একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে মাঠ থেকে এসে হাজির গৌর। সে এ বাড়ির বড় ছেলে। তার বৌকে যা নয় তাই বলা? মাথাটা বেজায় গরম হয়ে আছে তার। বাড়িতে ঢুকেই সে একেবারে উমাতারার মুখোমুখি, এসব কী শুনছি মা?
উমাতারা আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো গৌরের দিকে, কেন রে? কী হলো?
মেজাজটা বুঝি বিগড়ে গেল গৌরের, তুমি যেন কিছুই জানো না? কেন? ছোট বৌ কেন নিত্যদিন যা নয় তাই বলে গাল দেবে বড় বৌকে? বড়-ছোট কী তার মাথায় থাকে না?
উমাতারা বলল, সবে মাঠ থেকে এলি। খানিক বোস। মাথাটা ঠাণ্ডা কর্। তারপর না হয়-
শোনো মা, ঢের হয়েছে। আর নয়। আমি ভেন্ন হবো।
আঁতকে উঠল উমাতারা, কী বলছিস গৌর? ভেন্ন হবি? ভাইয়ে ভাইয়ে ভেন্ন হবি? তোর বাবার নিজে হাতে গড়া সাধের সংসারটাকে ভেঙে দিবি তোরা?
আর যে পারছি নে।
আর একবার যদি ভেবে দেখতি।
ঢের ভেবেছি। ভেবেছি জন্যেই তো এতদিন এক ছিলাম। আর নয়। আজই ভেন্ন হবো আমি।
অগত্যা ভেঙেই গেল সংসারটা। উমাতারার হাতে সাজানো সংসার। পঞ্চাননের ঘামে ভেজা স্বপ্ন নিয়ে গড়া সংসার। খানিক আগেই পাড়ার মান্যগণ্য মানুষগুলোর উপস্থিতিতে যে যার ভাগ বুঝে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল দুই ভাই। পাড়ার মানুষ শেষ চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, মা-টা যদ্দিন বেঁচে আছে আলাদা নাইবা হলি। মা মরলে এমনিতেই তো যার যার তার তার।
গৌর মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, না গো খুড়ো, তা আর হয় না।
কানাই মাস্টার বলেছিলেন, কেন? হয় না কেন?
গৌর বলেছিল, বাড়ির বড় বৌকে যদি দু বেলা ছোট বৌয়ের কাছে গাল শুনতে হয়, সে সংসারে থাকি কেমন করে?
পাশ থেকে নিতাই বলে উঠেছিল, সব দোষ তো ছোট বৌয়ের। আর বড় বৌ বুঝি ধোয়া তুলসিপাতা?
দ্যাখ নিতে, মুখ সামলে কথা বলবি।
মুখ তো সামলেই ছিলাম দাদা। তুমিই তো শুরু কল্লে।
কানাই মাস্টার দুজনকেই থামিয়ে দিয়ে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ রে নিতাই, তোরও কী এক কথা?
মানে?
তুইও কী আলাদা হতে চাস?
নয় তো কী? এমন সংসারে আমিও থাকতে চাই নে।
কানাই মাস্টার বারকয়েক এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে বলেছিলেন, সে না হয় হলো। তা তোর মাকে কে নিবি? মানে তোর মা কার মধ্যে খাবে এটা তোরাই ঠিক র্ক্।
ঠিক করার কী আছে? মা তো সব দিন তার ছোট ছেলেকেই বেশি করে ভালোবেসে এসেছে। তাছাড়া আমার এতগুলো পেট। না খুড়ো, আমি পারব না। মা নিতের সাথেই থাকবে। বলেছিল গৌর।
বললেই হলো। পাশ থেকে একপ্রকার খেঁকিয়ে উঠেছিল নিতাই, মা কোনোদিন তার বড়ছেলের দোষই দেখতে পায় নি। আজ বড়ছেলেই তার দায় নিক।
উঁহু, সেটি হচ্ছে না। চেঁচিয়ে উঠেছিল গৌর।
কানাই মাস্টার বলেছিলেন, ওরে, অমন করে বলিস্ নে। হাজার হোক তোদের মা। তোদের জন্ম দিয়েছে। খাইয়ে পরিয়ে বড় করেছে। এখন তাকে নিয়েই-
শেষমেশ কানাই মাস্টার উমাতারাকে ডেকে বলেছিলেন, কী আর করবে বৌদি, কোনো ছেলেই যখন তোমার দায় নিতে চাইছে না, তখন তোমার দায় তোমাকেই নিতে হবে। বাঁচতে হবে তো। এক কাজ করো, ঘর তো তোমার আলাদাই আছে, বিঘে দুই জমি নিয়ে আলাদাই খাও।
চোখ দুটো বুঝি ভিজে এসেছিল উমাতারার। বলেছিল, শেষে আমাকেই ভেন্ন হতে বলছ কানাই?
কী আর করবে বলো। কেউই যখন খেতে দিতে চায় না-
অগত্যা পশ্চিমের মাঠে দু বিঘে জমি আর উত্তর পোতার ঘরখানি দিয়ে উমাতারাকে আলাদা করে দিয়ে গেছে সবাই। বাকি জমিজমা ভাগ হয়েছে সমান দু ভাগে। শোওয়ার ঘরও দুজনের আলাদা। তাছাড়াও গৌর পেয়েছে রান্নাঘর। নিতাই গোয়াল। উঠোনের ওপরের বড় আমগাছটা বেচে নেবে উমাতারা।
সন্ধ্যে উতরে এখন রাত। আর রাতটা গভীরও হয়ে এসেছে অনেকখানি। মাঝ চৈত্রের রাত অনেকটাই মনোরম। সারাদিন যে আকাশের গায়ে ছিল তপ্ত দহনের আঁচ, এখন সেখানে নরম চাঁদের আলো। পূবদক্ষিণের দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়া সেই চাঁদের আলো গায়ে মেখে আদুরে মেয়ের মতোই শান্ত। তার ছোঁয়া শরীর জুড়িয়ে দেয়। শুক্লপক্ষের রাত। আকাশ জোড়া জ্যোৎøা গলে গলে পড়ছে গাছের পাতায়, বাড়ির উঠোনে। এখনও ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে যায় নি পুরোপুরি। জোনাকিরাও থামিয়ে দেয় নি তার জ্বলা-নেভা। তবুও অনেকখানিই নির্জন হয়ে আসছে চারপাশ। গাঁয়ের মানুষের ক্লান্ত শরীর জুড়ে ঘুম নামতে শুরু করে দিয়েছে এর মধ্যেই।
ঘুম নেই একমাত্র উমাতারার চোখে। সেই চোখে এখন কেবলই ভেসে আসছে অতীত। কেবল গৌর আর নিতাই নয়, আরও একটা ছেলের মুখ কেবলই মনে পড়ছে আজ। যার মা মারা যেতে উমাতারাকে বৌ করে সংসারে এনেছিল পঞ্চানন। ছেলেকে ডেকে বলেছিল, নে বাবা, তোর মাকে এনে দিলাম।
তখন কতই বা বয়স পীতাম্বরের। বড়জোর তিন। নতুন মা পেয়ে সে তো বেজায় খুশি। কিন্তু খুশি হতে পারে নি উমাতারা। কাছে আসতে গেলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
পঞ্চানন বলেছে, কী করছ উমা, ও তোমার ছেলে।
কী বললে? ছেলে? যে ছেলে জন্ম নিতেই মাকে খেয়েছে অমন ছেলের মুখও আমি দেখতে চাই নে।
হ্যাঁ, ছেলেটার মুখের দিকে ভালো করে কোনোদিন তাকিয়েও দেখে নি উমাতারা। একপ্রকার লাঞ্ছনা, অপমান, অবহেলা সয়েই বড় হয়েছে পীতাম্বর। নিজের বাড়িতেই সে থেকেছে বাইরের মানুষের মতো। সারাদিন খেটেখুটে পরিবর্তে দু বেলা দু মুঠো খেতেই পেয়েছে কেবল। একটু গায়ে গতরে হতেই তার বিয়ে দিয়ে তাকে ভেন্ন করে দিয়েছে পঞ্চানন। আসলে পঞ্চানন নয়, উমাতারাই তাকে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
খালপাড়ে দু বিঘে জমি আর টিনের ছাউনি, পাটকাঠির বেড়া দেওয়া একখানি ঘর দিয়ে পীতাম্বরকে পঞ্চানন বলেছিল, এর বেশি কিছু তোকে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই রে বাবা। এই নিয়েই তুই খুশি থাক।
আজ সে সব দিনের কথা কেবলই মনে পড়ছে উমাতারার। যে ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতবড় অন্যায় করেছে উমাতারা, সেই ছেলেরাই কিনা আজ-
বাইরে এখন অনেকটাই রাত। ক্রমশ বড় বেশি নির্জন হয়ে আসছে চারপাশ। একটা নৈঃশব্দ্য ঘিরে ধরতে শুরু করেছে। সারা বাড়ি জুড়ে একপ্রকার শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা। সেই সন্ধেবেলায় ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে খাটের কোণায় বসে আছে উমাতারা। ভিজে আসা দুই চোখ গাঢ় আঁধারে মাখামাখি। রাজ্যের ভাবনারা এসে কুরে কুরে খাচ্ছে মাথার ভেতর। কত পাপ, হ্যাঁ, কত পাপই না করেছে সে। যাদের জন্যে এই পাপ, তারা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে অনেক আগেই। অথচ একটিবারের জন্যেও তাকে ডাকে নি কেউ। এতটুকু খোঁজ পর্যন্ত নিয়ে যায় নি।
ভেতর থেকে ডুকরে ওঠা একটা কান্না বেরিয়ে আসতে গিয়েও থেমে গেল হঠাৎ। আচমকাই দরজায় টোকা পড়ার শব্দ। সেই সঙ্গে কেউ বুঝি ডাকল, মা।
চমকে উঠল উমাতারা, কে?
ও পাশ থেকে সাড়া এল, আমি পীতাম্বর।
পীতাম্বর!
হ্যাঁ মা, দরজা খোল।
উঠে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুললো উমাতারা, পীতাম্বর? তুই? এত রাতে?
পীতাম্বর বলল, কী করব বলো তো মা? তুমি না খেয়ে আছ, আর আমি বসে থাকব? তাই হয় কখনও? সব শুনেছি আমি। আর তাই তো তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি মা। খুব সুখে হয় তো তোমায় রাখতে পারব না। তবে পেট ভরে দু মুঠো ভাত আর গায়ের পোশাক ঠিকই দিতে পারব।
পীতাম্বর…!
হ্যাঁ মা, তোমার বৌমাও না খেয়ে বসে আছে। এমন কি আমার ছেলেটা পর্যন্ত খায় নি। তোমাকে নিয়ে গেলে একসাথে বসে খাবে সবাই। তুমি না কোরো না মা।
জীবনে এতটা ভালো লাগা কোনোদিন ছুঁয়ে যেতে পারে নি উমাতারা কে। একরাশ খুশির কান্না দু চোখে আছড়ে পড়তেই দু হাত বাড়িয়ে পীতাম্বরকে বুকে টেনে নিল উমাতারা।
বাইরে তখন উঠোন জোড়া জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে সারা বাড়ি।