বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়েছিলেন- সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বলেছিলেন – ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। এ রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমান সুখে শান্তিতে বসবাস করবে’ একটি জাতিকে তৈরী করতে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে, ষড়যন্ত্র, নির্যাতন আর অপপ্রচার উপেক্ষা করে তিনি ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস, জামায়াত ইসলাম ব্যতীত দেশের বৃহত্ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। দুই লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধা ইতিহাসের সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ও শক্তি দিয়ে বর্বরতম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে সম্মান-সম্ভ্রম বিনষ্ট করেছেন। বাঙালির এই বৃহত্ অংশকে ভয়-ভীতি, মিথ্যা-অপপ্রচার চালিয়ে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। স্বাধীনতাবিরোধীরা যত চেষ্টাই চালিয়ে যাক না কেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। কারণ স্বাধীনতাকামী বাঙালি স্বাধীনতাবিরোধী ধর্ম ব্যাবসায়ীদের সর্বদা প্রত্যাখ্যান করেছে, মৌলবাদীদের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জিত ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের নারী সমাজের জন্য বঙ্গবন্ধু এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। সর্বপ্রথম নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সূচনা করা সংবিধানে নারীর অবস্থান নিশ্চিত করে। ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে সর্বপ্রথম নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই নেয়া হয়েছিল নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের উদ্যোগ। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সব নারী অবদান রেখেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব নারীর পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। এ সময় ১৯টি জেলা ও ২৭টি মহকুমাসহ মোট ৬৪টি কেন্দ্রের মাধ্যমে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সরকারে দুজন নারীকে মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বাঙালি জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, সেই কাজে নানা ধরনের জটিলতা, নানা বাধা, নানা প্রতিকূলতা, স্বাধীনতাবিরোধী সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থানে দেশ থমকে যায়। স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে স্বাধীনতাবিরোধী সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ঘাতকরা শুধুমাত্র স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে – ইতিহাসের নৃশংস, মর্মসপর্শী কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। এভাবে জাতীয় জীবনের অর্জিত ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে এই দিবস পালন করে। দেশের অপশক্তি নিজেদের স্বার্থে জাতির জনককে হত্যা করেছে। এসব স্বার্থান্বেষীদের জন্য বাংলা ও বাংলার মানুষ হারিয়েছে জাতির স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ২১ বছর পর তাঁর পিতার হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেন। এবং বিচারিক কাজ শেষে ২০১০ সালে এই বাংলার মাটিতে তাঁর হত্যার বিচারকার্য সমপন্ন করে পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করেন এবং জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন।
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেমের অর্ন্তনিহিত অর্থ ছিল দেশের জনগণের অধিকার আদায়। দেশের মাটিকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নির্দিষ্ট ভূখ– হিসেবে স্থাপন করা এবং মানুষের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা।
স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার ন্যায্য অধিকার চায়’ এই আহ্বান ছিল বাংলাদেশের মূলমন্ত্র ও মূলসূত্র। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস এ ভাষণ ছিল যুদ্ধ শ্লোগান। এই ভাষণ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি কে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল।
১৯৭১ এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ- বাঙালির জীবনের সুখ ও শোকে মেশানো মহান এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে জাতির জনকের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ পেলো মহান স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা বাঙালির গর্ব, বাঙালির অহংকার। যার প্রতিটি ঘাসফুল, বালুকণা, মাটি-কাদা, গাছ, লতাপাতার সাথে জড়িয়ে আছে ত্রিশ লক্ষের অধিক মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু নারী-পুরুষের রক্ত। ১৯৭১ সালে এর সাথে জড়িয়ে ছিল সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সকলের অনুপ্রেরণার অংশ। মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় জীবনের একটি অর্জিত ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে নৃশংস গণহত্যার পর ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নয়মাস কারাভোগের পর বিশ্ব চাপের মুখে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ মুক্তি পেয়ে তিনি বাংলার মাটিতে পদার্পণ করেন। বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০২০ সালে বাঙালি জাতি উদযাপন করেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই সময় কিছু উগ্র ধর্মীয় শক্তির ধ্বংসলীলা উপেক্ষা করে সম-মর্যাদাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা, শহর ও গ্রামের উন্নয়ন এবং নারীকে অংশীদার করে এগিয়ে চলছে দেশ। আগামীর বাংলাদেশ গড়তে নারীকে শুধু অংশীদার হলে চলবে না, তাকে তার প্রাপ্য পাওনা বুঝে পেতে হবে, বুঝে নিতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রাজনৈতিক শক্তি, পেশীশক্তি, ধর্মীয় অপব্যবহার, অর্থের দৌরাত্ব থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালির চেতনা উন্মেষ এবং তার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি জাতিকে একটি নিজস্ব সত্তায় দাঁড় করানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছেন। প্রথমে তিনি নিয়মতান্ত্রিকতার মাধ্যমে নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং পরবর্তীতে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তিনি ১৯৪৭ সালে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করে ধীরে ধীরে তিনি জাতিকে মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে গেছেন। তিনি বাংলার ইতিহাসে সততা ও ন্যায়ের এক উজ্জ্বল প্রতীক। স্কুল জীবন থেকেই স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্দীপ্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। তারুণ্য ও যৌবনের সকল ভালোবাসা দেশ ও দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিলিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের কাছে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। দেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন। স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত বাংলাকে গড়ার কাজে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। যুদ্ধ পরবর্তী একটি দেশের সকল চাহিদা মেটানোর জন্য উন্নয়নের লক্ষ্যে সারা বিশ্বের কাছে চেয়েছেন সহযোগীতার হাত। সেই নেতা বাঙালি জাতির থেকে প্রতিদানের বিনিময়ে পেলেন হত্যার কলঙ্কিত অধ্যায়।
যে মানুষটি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কখনই ধর্মের নামে রাজনীতিকে সমর্থন না করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে হিন্দু-মুসলিম বৈষম্যসহ সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বাঙালির সকল অসামপ্রদায়িক নীতিতে সর্বদা বিরোধীতা করতেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের সকল ধর্মকে রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে সকলকে উজ্জীবিত করেছেন। সবার উপরে মানব ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন মানুষটি। বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা অস্তিত্বে মিশে আছে প্রিয় মাতৃভূমি, বাঙালি জাতি। তিনি মিশে আছেন দেশের সকল মানুষের মণিকোঠায়।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ