বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ যেন একে অন্যের পরিপূরক শব্দ, যেখানে একটি ছাড়া অন্যটি অসমপূর্ণ। প্রতি বছর আগস্ট মাস এলেই আমরা শোকার্ত হই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে। তাঁর অবদানের যথার্থ মর্যাদা আমরা মন থেকে করি কি? কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভীত, আনসেটেল্ড একটি জাতিকে করেছেন সংঘবদ্ধ, গড়ে তুলেছেন দুর্বার। তাদের নিয়ে এই অতুলনীয় মানুষটি তৈরী করে দিয়ে গেছেন গোটা একটি দেশ, বাংলাদেশ। শান্তিপ্রিয়, তবুও নিজেদের স্বকীয়তায় অবিচল কিছু মানুষদের এক করে নিজের ভাষা, নিজের মাটি নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছেন, গর্ব করতে শিখিয়েছেন। কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু দেশদ্রোহী তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে রেখে গেছে তাঁর নিজ বাসস্থানে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রপ্রধানের সতর্কবার্তাকেও যিনি হেসে অকপটে উড়িয়ে দিয়ে আস্থা রেখেছিলেন নিজের মানুষদের প্রতি!
‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে’ -১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর বিবিসির দেয়া এই লাইনটি আমাকে হণ্ট করে। কারণ অন্য আর দশটা ছেলেমেয়েদের মতো করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার জানা হয় নি। শুধু বইয়ের পাতায় তাঁকে নিয়ে লেখা পড়ে তাঁর সমপর্কে জেনে হয়ত এই ইমোশন আমার মধ্যে কাজ করত না। আমার মা-বাবা দুজনেই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, তাই ছোটবেলা থেকেই তাদের মুখে গল্পগুলো শুনে বড় হয়েছি আমি। তাদের দৃষ্টি দিয়ে সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধকে, বাংলাদেশের প্রতি জাতির পিতার অবদানকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার বাবার ছাত্রজীবনে সামনাসামনি দেখা-কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেই গল্প বাবার মুখে অনেক শুনেছি। শেখ মুজিবকে তিনি ‘মুজিব কাকা’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁকে নিয়ে কিছু বলার সময় সবসময়ই বলতেন, ‘অমন ব্যক্তিত্ববান, একইসাথে অমন একজন অমায়িক মানুষের সামনে গিয়ে শ্রদ্ধায় যেন মাথা নত হয়ে আসে।’
জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমরা এখন পাড়া-মহল্লায় প্রায় সব বিশেষ রাজনৈতিক দিনগুলোতে বাজাতে শুনি। অনেকেই বলেন যে তারা বিরক্ত হন। একই জিনিষ প্রতিনিয়ত শুনতে তাদের ভালো লাগে না। বরং এতে সর্বজনের কাছে আরো মূল্যহীন হয়ে পড়ে। হয়ত আংশিকভাবে কথাটি ঠিক। তবু আমার অবাক লাগে তাদের মন্তব্য শুনে। ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করি, আদৌ কি বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো মন থেকে উনারা অনুধাবন করতে পারেন কিনা! ওই কঠিন সময়ের দিনগুলোতে মনে মনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে কখনও ভেবেছেন কিনা যে সামনে থেকে এই ভাষণ শুনলে রক্ত টগবগ করে ফুটে ওঠে কিনা, দেশগড়ার লক্ষ্যে প্রাণ দিয়ে হলেও নিজেকে বিসর্জন দেবার ইচ্ছে মনে জাগে কিনা!
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এ পর্যন্ত অনেকগুলো ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তাঁর ভাষণ নিয়ে গবেষণাও হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে নিয়েছে ১৮ মিনিট ধরে বজ্রকন্ঠের সেই কথাগুলো। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতির পিতার ঐতিহাসিক এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সর্বজনীনতা এবং মানবিকতা। যে কোনো মুক্তিকামী অথচ লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থ জনগণের জন্য এই ভাষণ সব সময়ই থাকবে আবেদন সৃষ্টিকারী। এই ভাষণে গণতন্ত্র, স্বাধিকার, মানবতা এবং সকল সাধারণ মানুষের কথা বলা হয়েছে। যার জন্যই এই ভাষণ দেশ এবং সময়ের সীমা ছাড়িয়ে সবার কাছে সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়েছে। একজন সুযোগ্য নেতা একটি জাতির সংকটময় সময়ে একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে খুব কম সময়ের জন্য কোনো প্রকার পুনরুক্তি ছাড়াই নতুন রূপে সৃষ্টি হতে যাওয়া একটি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা রয়েছে। তিনি সমপূর্ণ তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথাগুলো বলেছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষায় তাঁর মনের ভাব সাবলীলভাবে তুলে ধরেছিলেন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাদের মনের কথাই বঙ্গবন্ধু তাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন ওইদিন। যার ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হতে পেরেছিল। এই ঐতিহাসিক ভাষণই একটি জাতিকে প্রাণের তোয়াক্কা না করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মিলানওয়ালী কারাগারে বন্দী ছিলেন, কিন্তু তাঁর কথাগুলো প্রেরণা জুগিয়েছে যুদ্ধে অংশ নেয়া সব মানুষের মনে। এতবছর পরেও তাঁর সেই ভাষণ গায়ে কাঁটা দেয়, ইচ্ছে জাগায় যুদ্ধে যাবার, নিজের জন্য একটি দেশ গড়ার লক্ষ্যে।
কিন্তু আমরা সরকার বদলের সাথে সাথে ইতিহাসকে আমূল বদলে ফেলার চেষ্টা করি। পাঠ্যপুস্তক থেকে, দেশের সব বিখ্যাত স্থানগুলো থেকে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সর্বোপরি মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রধানের নাম জুড়ে বিকৃত করে ফেলা হয় সব সত্য ঘটনা। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বলি, সেখানেও সরকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু তাই বলে তারা তো নিজেদের জাতির পিতাকে অস্বীকার করে না! নিজের জাতির জনককে অস্বীকার করার অর্থ তো নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। একটি মুল্যবোধহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি আমরা দিন দিন, যেখানে ক্ষমতা আর টাকার লোভ আমাদের অন্ধ করে রাখছে। নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে আমরা অন্যদের নকল করার পেছনে ছুটছি। ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের লোভে রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করে যে কেউ আজ যা কিছু করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এমন একটি আওয়ামী লীগ কি বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় কখনো কল্পনা করেছিলেন? তিনি যে আদর্শ নিয়ে একটি অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন, আমরা কি সেই বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি? সব সমস্যার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা নিজেরা যদি সত্ থাকতাম, নিজেদের ক্ষুদ্র দায়িত্বগুলো সদুপায়ে পালন করতাম, তাহলে সব অন্যায়ের দায়ভার এক সরকার প্রধানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া লাগত না।
প্রসঙ্গ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। তাঁর কথাতেই ফেরত গেলে বলতে হয় – তাঁর মতো সত্, সাহসী, বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানকারী, একনিষ্ঠ এবং অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক এই ভূখন্ডে আর জন্মগ্রহণ করবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমি শুধু তাঁকে ছবিতে দেখেছি, বইয়ে তাঁর গল্প পড়েছি, কিন্তু এই ব্যক্তিত্ববান মানুষটি আমার হাতে পাওয়া পাসপোর্টের ওপরে লেখা ‘বাংলাদেশ’ নামটি তৈরি করে দিয়ে গেছেন ু ভাবতেই গর্ববোধ হয়। তাঁকে নিয়ে লেখার সাহস আমার হয় না।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে বিশ্ববাসী তাঁকে সম্মান করতে পেরেছে। তাঁর সাধারণ জীবনযাপন বিশ্বের নেতাদের কাছে ছিল বিস্ময়কর। তাঁর সমপর্কে বিশ্বের নেতাদের মন্তব্য নতুন করে লেখার কিছু নেই, আমাদের সবারই জানা। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম নিয়ে বায়োপিক তৈরি হচ্ছে মুম্বাইতে (বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে)। অন্যদিকে, ১৫ আগস্ট ২০২১-এ নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের আইকনিক টাইমস স্কয়ারের প্রধান বিলবোর্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি প্রদর্শন করা হবে। আগামী ১৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে ২৪ ঘণ্টায় ৭২০ বার আলো ঝলমলে টাইমস স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভেসে উঠবে। আমেরিকায় অবস্থিত শুধু বাংলাদেশিরা নন, লাখো বিদেশীরা ছোট এই বাংলাদেশের জাতির জনককে দেখবে, তাঁর সমপর্কে ধারণা পাবে। এই মহত্ উদ্যোগটিকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমি চাই নতুন বিশ্ব চিনুক, মনে রাখুক এই মহান নেতাকে যিনি এই পৃথিবীতে জন্ম না নিলে হয়ত এই স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিত না।
লেখক: পিএইচডি রিসার্চার, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ দিল্লী, ভারত। প্রভাষক, র্ব্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা।