বইমেলায় গেছি। বইমেলাটা একসময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চললেও এখন তো মূল মেলাটা চলে গেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দেখা গেল নানান সংগঠনের স্টল। মজা হলো, এই ‘নানান সংগঠন’গুলোর সিংহভাগই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। আর আছে বই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত এত বই! সেসব বই মনের ভেতর দু’টা প্রশ্ন জাগালো। একটি, এই বইগুলোর কয়টি টিকবে? দ্বিতীয়টি, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ‘৯৬ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নামে এই এত এত সংগঠন করা লোকগুলো কোথায় ছিল!
বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠা হওয়া এই সংগঠনগুলো ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পরের দিনের পত্রিকাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরদিনই বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো নিজেদের ভূমিকা রাতারাতি পাল্টে ফেলেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি কোনো পত্রিকা প্রধান শিরোনাম করে নি। খবরে নতুন সরকারের গুণগান করতেও দেখা গেছে। চেপে গেছে সেনা অভ্যুত্থান আর অবৈধ ক্ষমতা দখলের খবর।
স্বাধীনতার আগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত ইত্তেফাক পত্রিকাটিকে আওয়ামী লীগের মুখপত্র মনে করা হত। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সে ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ: খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’। খবরে কেবল ‘বঙ্গবন্ধু নিহত’ হয়েছেন বলা হয়, তাকে যে সপরিবারে হত্যার ঘটনাটি চেপে যাওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। …শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’
আমার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা মনে পড়ে। গেল বছরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৪৯তম বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার ঘটনা তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘এত বড় একটা ঘটনা, বাংলাদেশের কোনো লোক জানতে পারল না? কেউ কোনো পদক্ষেপ নিল না? লাশ পড়ে থাকল ৩২ নম্বরে! সেই কথা আমি এখনও ভাবি! এত বড় সংগঠন, এত নেতা, কোথায় ছিল তখন? মাঝে মাঝে আমার জানতে ইচ্ছে করে, কেউ সাহসে ভর দিয়ে এগিয়ে আসতে পারল না? বাংলার সাধারণ মানুষ তো বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল।’
শুধুমাত্র ইত্তেফাক নয়, অন্য পত্রিকাগুলোও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলা তাদের প্রধান প্রতিবেদনে পুরো আট কলাম জুড়ে শিরোনাম লিখেছিল, ‘খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি।’ প্রধান প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হন বলে ঘোষণা করা হয়।’
দৈনিক বাংলা সেদিন প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে লেখা হয়, ‘জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। জাতীয় জীবনে সূচিত এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা। দেশে কোথাও কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেনি। সর্বত্র বিরাজিত স্বাভাবিক অবস্থা।’
১৫ আগস্টের পর থেকে পরবর্তী একুশ বছর দেশে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে কোনো আলোচনা উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া না।
ভাবা যায়!
প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পাঁচদিনের মাথায় ২০ আগস্ট মার্শাল ল’ জারি করে। ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ- ৫০/১৯৭৫ জারি করে। অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ রয়েছে, প্রথম অংশে বলা হয়েছে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ভোরে বলবত্ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের র নৃশংসতম ও কাপুরুষিত ঘটনাটিকে বৈধতা দেয়া হলো। একইসঙ্গে নিষিদ্ধ করা হলো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও রূপকারকে। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নটি ধার করে বলি, এই যে এখন বঙ্গবন্ধুর নাম দিয়ে এত এত সংগঠন- এরা ’৭৫-এর আগস্টে কোথায় ছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর এই প্রশ্নটির সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন জুড়ে দিতে চাই- আজকে যদি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরে যায়, এদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে তো?
সাংবাদিক ও লেখক শাহ্ জে. চৌধুরী আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। নিউ ইয়র্কের রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রধান ব্যক্তি। এছাড়া তিনি অধীনে রয়েছে নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলার সম্পাদক এবং নিউ ইয়র্কের অন্যতম বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা চ্যানেল’-এর চেয়ারম্যান।