দেশে তখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। সরকার লকডাউন দিয়েছে। হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সকল সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা বন্ধ। কেউ অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা দেয়ার কেউ নেই। ডাক্তারের চেম্বারগুলোও বন্ধ। রোগীর স্বজনরা রোগিকে নিয়ে উদভ্রান্তের মতো হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে। হাসপাতাল রোগি নিচ্ছে না। বেড খালি নেই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালের বাইরে খোলা জায়গায় রোগী ধুঁকছে। রোগির স্বজনরা হাহাকার করছে। আহাজারি করছে।
ঠিক এইরকম দুঃস্বপ্নের মতো একটা বাস্তবতায় রীনা আপাকে হাসপাতাল যেতে হলো। ঢাকায় এখন ভাড়ায় অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়। ফোন করলেই চলে আসে। রীনার আপার স্বামী ফোন করলেন। অ্যাম্বুলেন্স এলে তাতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। শুরুতে যে ভয়াবহ বাস্তবতার বর্ণনা রয়েছে তাতে সরকারি হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। রীনা আপার কিডনি সমস্যা আছে। ডায়ালিসিস করা লাগে। ডায়ালিসিস চলতে থাকা অবস্থায় রীনা আপা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এ অসুস্থতার সঙ্গে তিনি ও বাড়ির লোকেরা পরিচিত নন। একদিন পর রীনা আপা মরে গেলেন। মারা যাবার পর জানা গেল রীনা আপা হাসপাতালেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এবারে বাড়ির লোকেরা ফিরবেন। কিন্তু হাসপাতালের দরজায় তাদের আটকে দিল। তারা লাশ দেবে না। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগির দাফন কাফন সরকারি ব্যবস্থাপনায় করা হয়। কিন্তু স্বজনরা সে ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি নন। দু পক্ষে বিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল। তখন অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার এগিয়ে এল। ঘটনা জানতে চাইল। এরপর রীনার আপার স্বামীকে ওখান থেকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে ইমারজেন্সির দরজা দিয়ে ভেতরে গেল। মিনিট পনের পর ফিরে এসে বলে, তিন হাজার টাকা দেন।
রীনার আপার স্বামী কারণ জানতে চাইলে বলে, আপনারা লাশ নিয়ে যাবেন না রেখে যাবেন?
নিয়ে যাব, ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন রীনার আপার স্বামী, বলে তিন হাজার টাকা বের করে দেন। টাকা নিয়ে ড্রাইভার ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দুলাভাইয়ের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, যান, লাশ নিয়া আসেন। তারা ভেতরে যান। লাশ আসতে এবারে আআর কেউ বাধা দেয় না। ড্রাইভারের দেয়া ও কাগজটি ছিল করোনা টেস্ট রিপোর্ট। ওতে লেখা ছিল মারা যাওয়া আমাদের রিনা আপা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন নি। নেগেটিভ। ওটা লিখতে তিন হাজার টাকা নিয়েছে।
দুর্নীতি মোটামুটি পৃথিবীর সকল দেশেই আছে। উন্নত দেশেও দুর্নীতি হয়। দরিদ্র দেশগুলোতে একটু বেশি থাকে। থাকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও। আমাদের দেশ তো উন্নয়নশীল। ফলে দুর্নীতি থাকবেই। হয়ত সেকারণেই গেল কয়েক দশক ধরে উন্নয়নশীল হয়েই রয়েছি। উন্নত আর হওয়া হয় নি। সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই যেন এই মহামারী কালে এই মহামারী নিয়েই দুর্নীতি চলেছে।
করোনা মহামারীতে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুব সফলভাবে আলোচনায় থেকেছে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি। বেরিয়ে এসেছে মাস্ক, পিপিই কেনায় দুর্নীতি, কোভিড-১৯ পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভারের বিপুল সম্পদ, নামসর্বস্ব অটোমোবাইল কোম্পানিকে দিয়েছে সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের কাজ।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাস্ক দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এন-৯৫ মাস্কের নামে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করেছিল জেএমআই নামের একটি প্রতিষ্ঠান। দুদক জেএমআইয়ের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু প্রতিষ্ঠানকেও কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা করার অনুমতি দিয়েছিল। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ হেলথকেয়ার। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা না করেই পরীক্ষার ফলাফল ও সনদ দিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়।
আরও যে কথাটি না বললেই নয় সেটি মো সাহেদ ও রিজেন্ট হাসপাতাল। লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের অপকর্ম প্রকাশ হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে, করোনা চিকিৎসার মতো স্পপর্শকাতর দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠান কীভাবে পেল! তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছিল।
আলোচিত এসব দুর্নীতি শুধুই কি দুর্নীতি? প্রচলিত আইনের ধারায় এসব অসাধু কর্মকাণ্ড দুর্নীতি বটে তবে এর বাইরেও আসলে অনেক কিছু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজের ক্ষেত্রটিতে সরাসরি মানুষের জীবন জড়িত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যারা কাজ করেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যারা কাজ করেন তারা দেশের উচ্চ শিক্ষার সনদধারী নাগরিক। আমরা প্রায়ই লেখাপড়ার সঙ্গে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কথা বলি। তারমানে মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা যায় না। মানুষকে হতে হয় মানবিকবোধ সম্পন্ন। কেবল মোটা মোটা বই মুখস্ত করে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলেই মানবিক মানুষ যে হওয়া যায় না। মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে দরকার মূল্যবোধ, বিবেক, দরকার চেতনা। মানে শিক্ষাটা অর্জন নয় কেবল, ধারণ করতে হয়। তিনি চিকিৎসক হোন আর উচ্চ শিক্ষার সনদধারী কর্মকর্তাই হোন, মানুষের জীবন নিয়ে যারা বাণিজ্য করেন তারা আর যাই হোন, মানুষের মতো মানুষ যে নন, এটুকু নিশ্চিত। কিন্তু মানুষ তো?
সাংবাদিক ও লেখক শাহ্ জে. চৌধুরী আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। নিউ ইয়র্কের রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রধান ব্যক্তি। এছাড়া তিনি অধীনে রয়েছে নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলার সম্পাদক এবং নিউ ইয়র্কের অন্যতম বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা চ্যানেল’-এর চেয়ারম্যান।