ভাষার রাজনীতি এবং ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? অন্য কোনো দেশে আছে কিনা জানি না, কিন্তু বাংলাদেশে ছিল। ১৯৪৮ সালে যখন ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন তার মধ্যে ক্ষমতা দখলের কোনো রাজনীতি ছিল না। ছিল বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষা এবং পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু অধিবাসীদের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৪৮ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তখন দাবিটা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করারও ছিল না। ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কাজে ব্যবহারের ভাষা করার দাবি। উর্দুকে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করার ব্যাপারে বাংলা ভাষার আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজের কোনো আপত্তি ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি রাজনীতিকদের বড় কোনো ভূমিকা ছিল না। মুসলিম লীগের বাঙালি নেতারা বরং এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তারা এটাকে ‘যুক্ত বাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র’, ‘হিন্দুদের চক্রান্ত’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার এক বছর পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম নেয়। এর প্রথম দিকের সিনিয়র নেতাদের অনেকে এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। মুসলিম লীগ-শাসন উচ্ছেদের জন্য ভাষা আন্দোলন কোনো বড় রকমের সহায়ক শক্তি হবে এটা হয়ত তারা প্রথম দিকে বুঝতে পারেন নি।
একমাত্র এই দলের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান (তখন ছাত্রনেতা ছিলেন) বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনিও তখন বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম হিসেবে ভাষা আন্দোলনকে দেখেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে দেখেননি। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে কংগ্রেস দলের সদস্য শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তাকে পরিষদ ভবনেই ‘ভারতের গুপ্তচর’, ‘পাকিস্তানের শত্রু’ ইত্যাদি যে আখ্যা দেয়া হয়, তার সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন মুসলিম লীগের বাঙালি নেতারাও।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, মশিউর রহমান (যশোর), জহিরুদ্দীন প্রমুখ এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ যখন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করেছে, তখনও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাওয়া সত্তে¡ও সাবেক মুসলিম লীগ সরকারের বাংলাকে ‘ইসলামিকরণের’ নীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আবুল মনসুর আহমদ বাংলা ভাষায় অনাবশ্যকভাবে উর্দু-ফার্সি শব্দ ঢোকানোর পক্ষপাতী ছিলেন। তার চাপে আতাউর রহমান খান তার স্মৃতিকথা ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের দুই বছরে’ (এরশাদের আমলে) নাম পাল্টে রাখেন ‘ওজারতির দুই বছর’। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখন ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের উল্টোদিকে (স্টেডিয়ামসংলগ্ন) একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান তার নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘বাংলা বাগান’। আবুল মনসুর আহমদ বিরোধিতা করেন এবং তার প্রস্তাবমতো মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান পার্কটির নাম রাখেন ‘পার্ক বাগিচা’ (এখন বিলুপ্ত)।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের তরুণ অংশ এবং তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনে সার্বিকভাবে অংশ নেয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হতো না, যদি শেখ সাহেবের নির্দেশে ছাত্রলীগের প্রতিনিধিরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দিতেন।
এই সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শামসুল হকও ১৪৪ ধারা অমান্য করা ও রাজপথে মিছিল বের করার বিরোধিতা করেন। তখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনেক কর্মকর্তাই ভাষা আন্দোলনকে তাদের সরকার-বিরোধিতার রাজনীতির সহায়ক অংশ মনে করেন নি। বরং মনে করেছেন, (শামসুল হকের ভাষায়) ‘ভাষার জন্য আন্দোলনে নামলে এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করা হলে মুসলিম লীগ সরকার দমননীতি চালানোর একটা সুযোগ পাবে। তারা ১৪৪ ধারা অমান্যের দায়ে আমাদের শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে ভরবে এবং ১৯৫৪ সালে প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ওয়াদা করেছে, তা ভাঙবে এবং নির্বাচন আবার পিছিয়ে দেবে।’
এমনকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিও প্রথমদিকে বাংলা ভাষার আন্দোলনকে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের সহায়ক আন্দোলন মনে করে নি। হয়ত তারা মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের মানুষের (বাঙালিসহ) ইসলাম ও উর্দুপ্রীতি এত বেশি যে, এখানে বাংলা ভাষার পক্ষে এককভাবে কথা বলতে গেলে সম্ভবত তারা জনবিচ্ছিন্ন হবেন। ফলে তারা একটি ঘোষণা দেন ‘পাকিস্তানে সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই।’
এর অর্থ পাকিস্তানের আর চারটি প্রদেশের ভাষা- সিন্ধী, পাঞ্জাবি, পশতু ও বালুচ ভাষাকে বাংলা ও উর্দুর পাশাপাশি সমান রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ শীর্ষক ঘোষণার প্রথম প্রতিবাদ করেন তমদ্দুন মজলিসের নেতা অধ্যাপক আবুল কাশেম। তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনেরও অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি বলেন- সিন্ধী, পাঞ্জাবি, বালুচ ইত্যাদি ভাষা তো বাংলা ভাষার মতো উন্নত নয় এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ওসব ভাষায় কথা বলে না। আর উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই নিজস্ব ভাষা নয়। ফলে বাংলাই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বিরাট দূরত্ব ও জীবনযাপনের পার্থক্যের কথা বিবেচনা করে উর্দুকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে মেনে নিতে আমরা পারি। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার দাবিকে গুরুত্বহীন করার জন্য ‘সকল ভাষার সমান অধিকারের’ স্লোগান ব্যবহার করা উচিত নয়। (বিবৃতিটি তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিকে’ প্রকাশিত হয়েছিল। তারিখটি আমার স্মরণ নেই)।
কমিউনিস্ট পার্টি পরে তাদের কৌশল পাল্টায় এবং ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। আমার কথা, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন প্রথমে রাজনৈতিক চরিত্রের ছিল না, ছিল সাংস্কৃতিক চরিত্রের। একে রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনের দিকে ঠেলে দেয় পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা।
পাকিস্তানের জন্ম ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে। পাকিস্তানের শাসকরা যখন দেখলেন, উর্দুকে কোনোভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাচ্ছে না; তখন তারা ধুয়া তুললেন, উর্দু হচ্ছে ইসলামী ভাষা এবং ইসলাম প্রচারের বাহন। পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ড তা রক্ষার জন্যই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা দরকার।
এর প্রতিবাদ করেন প্রয়াত মহামান্য আগা খান এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। আগা খান ঢাকার কার্জন হলে এক ভাষণে বলেন, ‘উর্দু ইসলামের ভাষা নয়। দিল্লির মোগল রাজদরবারে এই ভাষার জন্ম এবং একমাত্র উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের মুসলমানরা উর্দু ভাষায় কথা বলে না, উর্দু তারা জানেনও না। উর্দু পরাজিত মোগল শক্তির দ্বারা সৃষ্ট ভাষা। এই ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হতে পারে না।’
অন্যদিকে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন, ইসলামী ভাষাকে যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হয়, তাহলে উর্দুকে কেন, আরবিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বেছে নিতে হয়। তার এই কথার কোনো জবাব দিতে পারেন নি পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরা অথবা তাদের একজন তপ্লিবাহক পণ্ডিত ‘বাবায়ে উর্দু’ নামে পরিচিত আবদুল হক। ড. শহীদুল্লাহ্র বক্তব্য ছিল তথ্যভিত্তিক। ভারতে ইসলাম প্রচার হয়েছে আরবি ও ফার্সি ভাষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে মূলত বাংলা ভাষার মাধ্যমে। ভারতে মুসলিম শাসনামলের শেষদিকে মোগল রাজদরবারে উর্দুর জন্ম।
উর্দুকে রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে ধর্মীয় জাতীয়তার বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসকরাই বাংলা ভাষার আন্দোলনকে রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণের দিকে ঠেলে দেন। ভাষা আন্দোলন থেকে তৈরি হয় অবাস্তব ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পাল্টা বাস্তব এবং আধুনিক সেকুলার ভাষাজাতীয়তা। শুধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) নয়, সিন্ধু প্রদেশে গড়ে ওঠে সিন্ধী ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জিয়ে সিন্ধু, বালুচ ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে বালুচিস্তান আন্দোলন এবং সাবেক সীমান্ত প্রদেশে জন্ম নেয় পশতু ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীন পশতুনিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো এখনও সফল হয় নি। কিন্তু বাংলা ভাষার আন্দোলন রাজনৈতিক তথা ক্ষমতার রাজনীতির চরিত্র অর্জন করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সেকুলার স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে।
ক্ষমতার রাজনীতির একটা মন্দ দিক এই যে, রাজনীতিকরা যে সিঁড়িটিকে ক্ষমতায় আরোহণের জন্য ব্যবহার করেন, ক্ষমতায় বসার পর সেই সিঁড়িটিকে উপেক্ষা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার এখন তাই হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা হওয়ার স্বীকৃতি পাওয়া সত্তে¡ও নিজের দেশেই বাংলাভাষার এখনও দুয়োরানীর অবস্থা। এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে, বাংলা ভাষাকে বিশ্বভাষার স্তরে তুলতে হলে আরেকটি ভাষা আন্দোলন দরকার। ইংরেজি সাইনবোর্ড ভেঙে ভাষা আন্দোলন নয়, ভাষার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভিত্তির প্রসারতায় আন্দোলন, যা ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এরও নেতৃত্ব ছাত্র ও যুবসমাজকে নিতে হবে। প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে শুধু নাচ-গানের উৎসব নয়। আবার শহরে-বন্দরে প্রভাতফেরি বের করতে হবে। তার স্লোগান হবে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ চাই। শুধু সাহিত্যের ভাষা নয়, বাংলা ভাষা হবে বিজ্ঞানের ভাষা, ব্যবহারিক ভাষা। সেই লক্ষ্যে ক্ষমতার রাজনীতিকে এড়িয়ে ভাষার রাজনীতি দরকার বাংলাদেশে। ❏