মালয়েশিয়ার একটি হোটেল রুমে ফ্র্যাঙ্ক পেলিগ্রিনো টেলিভিশনের পর্দায় বিমানগুলোকে টুইন টাওয়ারে আছড়ে পড়তে দেখেই বলে উঠলেন, ‘মাই গড, এটা নিশ্চয়ই খালিদ শেখ মোহাম্মদের কাজ’! যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তা পেলিগ্রিনো প্রায় তিন দশক ধরে লেগেছিলেন খালিদ শেখ মোহাম্মদের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার সঙ্গে সবচেয়ে উচ্চারিত ও জড়িত ব্যক্তিটির নাম ওসামা বিন লাদেন। কিন্তু খালিদ শেখ মোহাম্মদ বিমান দিয়ে এভাবে হামলার ধারণাটি ভেবে নিয়ে আল-কায়েদার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার অর্থ হলো, ২০ বছর আগে ৯/১১ ভয়াবহ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী এই খালিদ বিন মোহাম্মদ। গেল ১৯ বছর ধরে বন্দি রয়েছেন কিউবার গুয়ান্তানামো বে কারাগারে।
খালিদ শেখ মোহাম্মদ একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত ইসলামপন্থী জঙ্গি। কুয়েতে ১ মার্চ, ১৯৬৪ কিংবা এপ্রিল ১৪, ১৯৬৫ সালে তার জন্ম। লেখাপড়া করেছেন আমেরিকায়। পরে ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে যুদ্ধে করেছিলেন।
খালিদ শেখ মোহাম্মদ গ্রেপ্তার হন ২০০৩ সালে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগনে বিমান হামলার পেছনে নিজের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। জেলে থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালে আমেরিকার এক সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে খালিদ জানিয়েছিলেন, তিনি ৯/১১ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। বস্তুত আমেরিকায় মুসলিমদের প্রতি বিভিন্ন অন্যায় আচরণই তাকে প্রতিশোধ নিতে তাকে প্ররোচিত করেছিল।
২০০৩-এর মার্চে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর স্পেশাল অ্যাক্টিভিটিজ ডিভিশন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে গ্রেফতার করে খালিদকে। তারপর থেকে আমেরিকার হেফাজতেই রয়েছেন তিনি। ২০০৬ থেকে কিউবার গুয়ান্তানামো বে-ই তার ঠিকানা। একাধিকবার সামরিক আদালতে খালিদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা পিছিয়ে যায়। বিচার শুরু হলেও তা কবে শেষ হবে তা নিয়ে সন্দিহান খালিদের আইনজীবী ডেভিড নেভিন।
২০১৫ সালে গুয়ান্তানামো বে জেল থেকে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে খালিদ লিখেছেন, ‘লড়াইটা আমরা শুরু করি নি। আমাদের দেশে তোমরা, তোমাদের শাসকরা লড়াইটা শুরু করেছিলে।’ ৯/১১ সন্ত্রাসের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে প্যালেস্টাইন এবং ইরাকে মুসলিম নিপীড়নের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকার পরমাণু বোমা ফেলার কথাও উল্লেখ করেছেন চিঠিতে।
আমেরিকার আইন অনুযায়ী ৯/১১-তে নিহত ২,৯৭৭ জনকে খুনের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অপরাধ প্রমাণিত হলে খালিদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
১১ সেপ্টেম্বরের হামলার কয়েক বছর আগে থেকেই এফবিআইয়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফ্র্যাঙ্ক পেলিগ্রিনো খালিদ শেখ মোহাম্মদকে অনুসরণ করছিলেন। ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলার ঘটনায় এফবিআই পেলিগ্রিনোকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কর্তৃপক্ষ তখনই এই নামটির কথা প্রথম জানতে পারে। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তির কাছে খালিদ অর্থ পাঠিয়েছিলেন। পেলিগ্রিনো ১৯৯০-এর দশকে যখন তাকে অনুসরণ করছিলেন, তখন তাকে একবার প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন।
তিনি ও আরেকটি দল ওমানে যান। খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ধরার জন্য তাদের পরিকল্পনা ছিল তারা কাতারে যাবেন। একটি বিমানও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কূটনীতিক এ পরিকল্পনায় বাধা দেন।
পেলিগ্রিনো কাতারে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের বললেন, তার কাছে খালিদ শেখ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিমান দিয়ে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ রয়েছে। তখন তারা খুব সতর্ক হয়ে পড়ে। তারা ভেবেছিল সেরকম কিছু হলে সমস্যা হবে। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পেলিগ্রিনোকে জানালেন কাতারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খালিদ শেখ মোহাম্মদের কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না। পেলিগ্রিনো জানিয়েছেন, নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত খালিদ শেখ মোহাম্মদকে বড় ধরনের টার্গেট হিসেবে দেখা হয় নি। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দশ ফেরারির তালিকাতেও তার নাম ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র যে তাকে ধরতে চাইছে সম্ভবত এই তথ্য খালিদকে কেউ জানিয়ে দিয়েছিল। এরপর খালিদ কাতার ছেড়ে আফগানিস্তানে চলে যান। এর পরের কয়েক বছর ধরে তার নাম বারবারই সামনে আসতে থাকে। সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে যাদের ধরা হয়, তাদের অনেকের কাছে খালিদের নাম পাওয়া যায়।
খালিদ শেখ মোহাম্মদ একটি পরিকল্পনা নিয়ে যান ওসামা বিন লাদেনের কাছে। তাতে পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিমান উড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে কিছু ভবনের ওপর হামলা চালানোর আইডিয়াটিও ছিল। তারপরই ৯/১১-এর হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় খালিদের জড়িত থাকার ব্যাপারে পেলিগ্রিনোর সন্দেহ তখনই প্রমাণিত হয় যখন হেফাজতে থাকা আল কায়েদার গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা তাকে চিনতে পারেন। পেলিগ্রিনো যখন জানতে পারলেন খালিদই সেই ব্যক্তি তখন তারচেয়ে বেশি দুঃখিত আর কেউ হয় নি।
খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ২০০৩ সালে খুঁজে বের করার পর তাকে পাকিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়।
সিআইএর বন্দি করে রাখার কর্মসূচির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর খালিদ শেখ মোহাম্মদের মতো ‘মূল্যবান বন্দিদেরকে’ ২০০৬ সালে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে সেখানে এফবিআইকে যেতে দেওয়া হয়েছিল।
ফ্র্যাংক পেলিগ্রিনো যার পেছনে এতো দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে তার মুখোমুখি হন। পেলিগ্রিনো খালিদকে জানাতে চাইছিলেন, নব্বই দশকে খালিদকে অভিযুক্ত করবার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ৯/১১ হামলার বিষয়ে তথ্য বের করতে আলোচনার একটা পথ তৈরি করা। এর বেশি আর কিছু জানান নি পেলিগ্রিনো। কিন্তু তিনি খালিদের কৌতুকবোধের প্রশংসা করেছেন।
৯/১১ হামলার বিচারের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটা হয় নি। নিউ ইয়র্কেও একটি বিচার অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণ ও রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে সেটিও হতে পারে নি। পরে গুয়ান্তানামো বে’তে তার সামরিক বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নানা প্রক্রিয়ার কারণে সেটিও পিছিয়ে যায়। কোভিড মহামারির ফলে গুয়ান্তানামো বন্ধ হয়ে গেলে এই বিচার অনুষ্ঠান আরও জটিল হয়ে পড়ে।
পেলিগ্রিনো এফবিআই থেকে অবসর নিতে তিন বছর দেরি করেন। তিনি আশা করেছিলেন যে এই সময়ের মধ্যে সামরিক ট্রাইব্যুনালে খালিদ শেখ মোহাম্মদের বিচার শেষ হয়ে যাবে যাতে তিনি সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু বিচার আর হয় নি। পরে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।
খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ধরতে বিশ্ব পাড়ি দেওয়া ফ্র্যাংক পেলিগ্রিনোর মধ্যে এখন তীব্র ব্যর্থতার এক বোধ কাজ করে। তিনি মনে করেন, নব্বইয়ের দশকে তাকে ধরতে পারলে ৯/১১ হামলা হয়ত এড়ানো যেত। প্রতিটি দিনই খালিদ শেখ মোহাম্মদের ভাবনা পেলিগ্রিনোর মাথায় আসে। আর সে ভাবনা মোটেও খুব সুখকর নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়, ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু ফ্র্যাংক পেলিগ্রিনোর এই ব্যাপারটি এখনও একই রকম আছে।
লেখক: সিনিয়র এক্সিউটিভ-কাস্টমার সার্ভিস, নাইন ইউনাইটেড বাংলাদেশ।