‘ফর মোস্ট’ অব হিস্ট্রি অ্যানোনিমাস ওয়াজ অ্যা উইমেন
-ভার্জিনিয়া উলফ্
উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা বাংলাদেশ আজকে বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ। কৃষিতে, শিল্পে, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, সর্বপরি অবকাঠামোগত ভাবে বাংলাদেশ আজ বিগত সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত পৃথিবীতে। সবদিক দিয়ে উন্নতি করা সত্ত্বেও একটি জায়গায় বাংলাদেশ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। যেটি হলো – সমাজে নারীর অবস্থান।
এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললে বা নারীর অধিকার নিয়ে কথা বললে সবাই ধারণা করে বসতে পারেন আমি নারীবাদ নিয়ে আলোচনা করছি এখানে। নারীবাদ একটি তত্ত্ব, একটি দর্শন, একটি বোধ, একটি সামাজিক অবস্থান। নারীবাদের সংজ্ঞাকে এক লাইনে বা কয়েকটি শব্দে ব্যাখ্যা করা জটিল। আমি নিজেকে নারীবাদী না বলে বরং মানববাদী হিসেবে দাবি করতে বেশি পছন্দ করি। উদাহরণ হিসেবে এখানে নাইজেরিয়ান সাহিত্যিক বুচি এমেচেতার কথাও বলা যেতে পারে। যিনি জীবনের পুরোটা সময় নারীদের জন্য সংগ্রাম আর নারীর প্রতি সামাজিক অবিচারের কথা তাঁর উপন্যাসে লিখে গেছেন, তাঁর লেখালেখিতে স্বামীর সায় না থাকায় সংসার ত্যাগ করেন তিনি। একজন আফ্রিকান অভিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে ইংল্যান্ডের মতো একটি দেশে একা সন্তানদের মানুষ করার মতন প্রচণ্ড সাহসী জীবনযাপন করার পরেও নিজেকে নারীবাদী হিসেবে পরিচিতি দিতে তিনি নারাজ। তিনি মনে করেন, ফেমিনিজম একটি পশ্চিমা ধারণা। শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ নারীদের জন্য। একইভাবে আরব আমিরাতের প্রগতিশীল মুসলিম নারীরা নারীর অধিকার আদায়ের জন্য লেখালেখি করে শরিয়া আইন সংস্কারের মতো কঠিন কাজ কট্টর ইসলামি রাষ্ট্রে থেকে সম্পন্ন করে ফেলেছেন তাঁরাও এই ধারণায় নিজেদের নারীবাদী উপমা দিতে অপছন্দ করেন। তবে আমি দেশভিত্তিক কোনো ধারণায় যেয়ে নিজেকে বিতর্কে দাঁড় করাব না। আমি মনে করি নারীবাদের বিষয়বস্তু এবং মানববাদের বিষয়বস্তু-এর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। বরং লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের কারণেই নারীবাদ তত্ত্বের জন্ম। এই বিভাজনকে সমাজ থেকে বাদ দিতে পারলে পরিষ্কার দেখা যায় মানববাদ-এর দাবি এবং নারীবাদীদের আর্জি মূলত একই।
বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুরু হয়েছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের হাত ধরে। তাঁর প্রচেষ্টার ফল আজকের নারীবাদের বলিষ্ঠ স্বর। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বেগম রোকেয়া লৈঙ্গিক বৈষম্যের প্রতিবাদে সোচ্চার থেকেছেন। তাঁর এবং পরবর্তী নারী অধিকার আদায়ে কাজ করে যাওয়া সকল নারীবাদীদের অবদান কতটা মনে রাখতে পেরেছি আমরা? এই ২০২১-এ ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন সবাই মোবাইলে, ফেসবুকে নিউজ পড়ছে, নিচে মন্তব্য করার সুবিধা ভোগ করার নামে বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকীতে তাদের মনের বিষ উগড়ে দেয়, তখন আমি লজ্জিত হই! তাদের মন্তব্যের ভাষা পড়ে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আদৌ কোন নারীর ঔরস থেকে তারা জন্মগ্রহণ করেছে।
নারীবাদ আর দশটা তত্ত্বের মতোই চলমান, পরিবর্তনমুখী বা রূপান্তরের আদর্শে গড়ে ওঠা একটি দর্শন। এটি একটি শক্তির নাম যা অনুধাবন করার কথা সকল নারী পুরুষের। যে বৈষম্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজকতৃক সৃষ্ট, সেখানে সমাজে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই শক্তিকে নারী-পুরুষ সকলে নিজেদের মধ্যে ধারণ করবে। তবেই নারীবাদের সার্থকতা। কিন্তু এসব কথাই কাগজে চাপা পড়ে যায়, যখন দেশের সর্বাধিক ক্ষমতার আসনে নারীনেত্রী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের হার প্রতিবছর চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকে। আর এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য ধর্ষকের যে শাস্তি হওয়া উচিত তার কোনো উদাহরণ বাংলাদেশ স্থাপন করতে পারে নি এ পর্যন্ত। বিনা দোষে ভিকটিমকে মেনে নিতে হয় আজীবন দুর্ভোগ। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে দেশে বর্তমানে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বিরাজ করছে। ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বলতে এমন এক সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়, যেখানে সমাজের প্রত্যেক নারী, শিশু কিংবা কিশোরী বালিকা ধর্ষণের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫,৪০০টি। এ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ৪ জন নারী-শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। আমরা দেখতে পাই ১৯৯১, ২০০১, ২০১১ ও ২০১৮ সালে প্রতি লাখে ধর্ষণের হার যথাক্রমে ০.৩৯ জন, ২.৩৭ জন, ২.৩৮ জন ও ২.৪৫ জন। শুধু পরিসংখ্যান বিবেচনায় ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের এ হার বাড়ার পরিমাণ প্রায় প্রতি লাখে ১.৩৫ জন বা এক-তৃতীয়াংশ (বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ওয়েবসাইট, ২০১৯)।’ [প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০]
টক শোতে আলোচনা বা ‘মি-টু’ মুভমেন্ট’ কোনোটাই বাংলাদেশের এই চিত্র বদলাতে পারে নি। ২০২০-এ বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে সংশোধনী আইনও ভয় ঢোকাতে পারে নি রেপিস্টদের মনে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় রাস্তায় মেয়েদের পোশাকের দিকে আঙুল তুলে মোর্যাল পুলিশিং করতে আসা জনতাকে দেখে বা বন্ধুর সাথে বসে কোনো মেয়েকে সিগারেট খেতে দেখলে সমাজ উচ্ছন্নে যাওয়া থেকে বাঁচাতে আসা ধর্মরক্ষকদের দেখে। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশের নাটক, গান অনেক কিছুই শেয়ার করেন অনেকে। কিন্তু সেসবের নিচে ভরে যাওয়া মন্তব্যগুলো দেখে মন চায় না যে বিশ্বাস করি এটা বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের মতো কট্টর ইসলামিক দেশকেও যেন হার মানায় তাদের আগ্রাসন। নারীদের কিভাবে বেঁধে ফেলা যায় চার দেয়ালে, কিভাবে ধর্মের নামে তাদের প্রতিহত করা যায়-এর নীল নকশাই দেখি সব জায়গায়। আমার গবেষণা থেকে প্রথমেই যে ব্যাখ্যা আমি নিজে উপলব্ধি করেছি, তা হলো, কোনো ধর্মই নারীবাদকে সমর্থন করে না। ধর্ম এবং নারীমুক্তি, আদতে দু’টি বিপরীতমুখী দর্শন। নারীকে বাহিরবিমুখ করাই ধর্মের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধার্মিক মাত্রই উগ্র এবং নারীর অধিকারে অসচেতন, হোক সে বাংলাদেশ কি প্রতিবেশী দেশের উগ্রবাদিতা। অথচ সব বুঝেও আমরা যেন দিন দিন এক অন্ধকূপের দিকে ধাবিত হচ্ছি, যার থেকে আলোতে উঠে আসা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দুষ্কর হয়ে উঠবে।
নারীবাদকে পুরুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না ভেবে, নারীকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে প্রত্যেক পুরুষের উচিত নিরপেক্ষভাবে বাড়ির নারীটির জায়গায় নিজেকে একদিনের জন্য দাঁড় করানো। সমাজ-সংসার ও বৃহত্তর সভ্যতা বিনির্মাণে নারী-পুরুষের সমগুরুত্ব সম্যকভাবে বোঝাতে বেগম রোকেয়া একটি গাড়ি চলতে দুটি চাকার সমান ভ‚মিকার কথা বলে গেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীতা দিয়ে এই গাড়িকে এক পা-ও এগোনো সম্ভব না। বরং সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায়। প্রকৃতি যেখানে নারীদের সম্মানিত করেছে মা হবার বাড়তি অধিকার দিয়ে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর অবস্থানকে বাধাগ্রস্থ করার অসদুদ্দেশ্য খুবই বেমানান। তবু যুগের পর যুগ তাই মেনে নিয়ে সমাজের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তার থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি। প্রত্যেক বিভাগে প্রতিবছর শতভাগ জিপিএ ৫ এই সচেতনতাকে জাগ্রত করতে পারবে না, যদি না এই বোধ প্রতি ঘর থেকে শুরু হয়। বর্তমান সমাজের বিকৃত মানসিকতা থেকে যদি পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা প্রকৃতই বাঁচাতে চাই, তাহলে আগে নারীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রসর হতে হবে। নারীকে বস্তাবন্দী করে যা কোনোদিনও হাসিল করা সম্ভব হবেনা।
লেখক: পিএইচডি রিসার্চার, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন দিল্লী, ভারত।