বুলার শরীরটা ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে যেন। কিছু করার নেই। বুলা নিজে ডাক্তার। তার হাসপাতাল থেকে তাকে এই করোনাকালীন সময়ে প্রথম শ্রেণির ডাক্তার হিসাবে কাজ করে যেতে হচ্ছে। অবুঝ রোগীরা বোঝে না, রোগের কথা গোপন করে চিকিৎসা নিতে চলে আসছে। সরকারি হাসপাতাল তো, গ্রামের অতি দরিদ্র আর নিরীহ লোকগুলো চিকিৎসা নিতে আসে। তারা এই ভয়াবহ অসুখটা সম্পর্কে বুঝতে চাচ্ছে না। ব্যক্তিগত সুরক্ষা বা সামাজিক দূরত্বের বিষয়গুলো নিয়েও একদম মাথা ঘামাচ্ছ না তারা।
বুলা আদিবকে বলেছে যে সে তার স্যাম্পল টেস্ট করতে দিয়েছে। সে নিজে করোনা সাসপেক্টেড। কি যে দুর্বিষহ দিন যাচ্ছে! প্রায় দু’মাস হলো বাচ্চাদুটো আম্মার কাছে। বুবাই-টুবাই পাঁচ আর সাত বছরের এতটুকু বাচ্চা। সারাদিন ওরা বুলার গা ঘেঁষে থাকত। চাকরির পর বুলাও বাকিটা সময় বাচ্চাদের সাথেই কাটাত। এখন এই গত দু’মাস ধরে বাচ্চাদের কাছে যেতে সাহসে কুলাচ্ছে না তার। কিন্তু এই বাচ্চাদের এতদিন না দেখে থাকা যায়! ফোনে কথা বলে বা ভিডিও কলে ওদের দেখে শান্তি পায় না বুলা। কিন্তু কি করবে- সে নিজে ডাক্তার। তাকে তো সব সময় সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আবার এই ভাইরাসটার ব্যাপারে পরিস্কার কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। ভ্যাকসিন, মেডিসিন যে কবে আসবে, আদৌও আসবে কিনা- তাও বোঝা যাচ্ছে না।
বুলা আদিবকেও বলেছিল আম্মার কাছে চলে যেতে। আবার এও ভাবছিল- হাসপাতালের আশেপাশে কোনো রুম ভাড়া করে একাই থাকা যায় কিনা। আদিবকে বলছিল সেসব কথা। আদিব মোটেও রাজি হয় না। সে একরাতও বুলাকে বাইরে থাকতে দেবে না। নিজেও একা থাকবে না। বুলা বুঝতে পারে না,আদিব কেন এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে।
বুলা অবশ্য বাসাতেই আলাদা করে নিয়েছে নিজের ঘর-বিছানা। আদিবকে বলেছে, ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, এবার বিরহ-কালীন সময় শুরু।’
‘ইয়ার্কি মারো? ইয়ার্কি করবে না বুলা। আর খুব সাবধানে কাজ করো তুমি। তাছাড়া তোমার অত আগ বাড়িয়ে রোগীদের কাছে যেতে হবে কেন?’
এই এক স্বভাব আদিবের। কি যে বলে! দায়িত্বজ্ঞান আছে না? নিজের কাজ থেকে কেউ সরে আসে নাকি? আর ডাক্তাররা কিভাবে সাবধানে থাকবে? তাতে তো রোগীকে অবহেলা করতে হবে। সে তো নিজেকে উৎসর্গ করেই এই পেশায় এসেছে। এখন সরে দাঁড়ানো যায় নাকি! দায়িত্ব থাকলে কেউ ওসব করতে পারে না। বুলা আর আদিবকে কিছু বোঝাতে যায় না।
আদিব ডাকে, ‘এই বুলা, কাছে আসো। আমার কাছে আসো বুলা।’
‘কি যে বলো! বলছি না তোমাকে- আমার শরীর ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে। গলাটাও ভারী ভারী।’
‘আসো তো কাছে, অসুখ হলে দুজনের একসাথেই হবে। মরে গেলে একসাথে মরে যাব, বেঁচে থাকলে একসাথে বেঁচে থাকব।’
বুলা চিৎকার করে, ‘চুপ করো। কী সব আজেবাজে কথা বলছো! বাচ্চাদের কথা মনে করো,এমন বাজে কথা বলতে নেই। ওদের দেখতে হবে না? ওদের কে দেখবে?’
‘দু’জন মিলেই দেখব। আগে অসুখ থেকে সেরে উঠবো। তারপর আমাদের মেয়ে হবে। মেয়ের নাম রাখব জয়ীতা। ছেলেরাও বড় হবে, আমাদের হবে খুব সুখের সংসার।’
বুলার মাথা ভার, চোখ লালচে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে সে আদিবের দিকে তাকায়। আদিব তার দিকে এগিয়ে আসছে বুঝতে পেরে সে সরে যায় এবং ঘরে গিয়ে পৌছায়। ঘরের দরজা লাগিয়ে জানালায় এসে দাঁড়ায়।
‘শরীর সত্যি খারাপ লাগছে আদিব।’
‘কি হলো বুলা? ওষুধপত্র খেয়েছ?’
‘হুম, বুলা লাল চোখে তাকিয়ে বলে, গলাটায় খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘কিচ্ছু হবে না তোমার বোকা মেয়ে। ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো। তুমি শুয়ে পড়ো।’
‘বাবুদের দেখতে ইচ্ছা করছে।’
কেঁদে ওঠে বুলা। বিছানায় শুতে পারে না। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। উঠে বসে। আবারও শুয়ে পড়ার চেষ্টা করে। খুব ছটফট করতে থাকে।
আদিব জানালায় দাঁড়িয়ে বুলাকে সাহস দিতে থাকে, ‘তোমার কিছু হবে না বুলা। তুমি সুস্থ হবে। পৃথিবী সুস্থ হবে। তুমি আমি দৌড়াদৌড়ি করে অফিস করব। তারপর আমরা বেড়াতে চলে যাব। পাহাড়-সমুদ্র সব ঘুরবো। তুমি ভেঙে পড়ো না।’
বুলা নিজের অবস্থা ভালো মনে করে না। মনে হচ্ছে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। বাসায় থেকেই অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানোর চেষ্টা করে। জ্বর মাপে, অক্সিজেন লেবেল দেখে। শুধু হতাশ হয় সে।
আদিব সারারাত জানালায়। তার কেন যেন ভয় লাগছে এখন। বুলা নিজে খুব নরম মনের মেয়ে হলেও, অসুখের কাছে কাবু হয় না কখনো। আদিব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বুলা ইশারা করে তাকে থামায়।
শেষ রাতে বুলার ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হলেও সকাল হতে হতে কমে যায় সেসব। জ্বর অনেক, গলাও ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট কমেছে একটু। বুলা বুঝতে পারে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে সে। ক্লান্ত শরীর পেরে উঠছে না, তবুও আস্তে আস্তে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে। আদিব চূড়ান্ত করছে। ওর দিকেও তাকানো যাচ্ছে না। বাচ্চাদের সাথে ভিডিও কলে দেখা করে। আম্মা কি যে কান্নাকাটি করছে। আদিব জানালার কাছ থেকে একটুও সরছে না। এবার বুলা বলে, ‘অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলো আদিব।’
আদিবের দিশেহারা অবস্থা। বুলার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। ঐ অবস্থাতেই হাঁপাতে হাঁপাতে বুলা বলল, ‘আমি একটু শফিক ভাইকে দেখব আদিব।’
আদিব চমকে তাকায়। শফিক বুলার চার বছরের সিনিয়র। মেডিকেল কলেজে পরিচয়, বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় ছিল বলে আদিব শুনেছে। কিছুটা আন্দাজও করে। এখন বুঝতে পারছে, শফিক বুলার অনেক জায়গা জুড়েই আছে। একটু অপমান লাগলো তার। আদিব বোঝানোর চেষ্টা করে,এখন সেই অবস্থা নেই।
বুলা কাতর গলায় বলতে চেষ্টা করে, ‘কিছু বলব না, শুধু একটু দেখব তাঁকে।’
‘পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো বুলা।’
‘আমি মনে হয় ফিরবো না আর।’
আদিব বাসা থেকে বের হয়। কোথায় খুঁজবে শফিককে? চেনেও না ভালোমতো। যোগাযোগ করার কোনো নম্বরও নেই তার।
শফিকের অফিসে গিয়ে শফিককে পেয়ে যায় আদিব। বুঝিয়ে বলল সব। বুলার করোনা পজিটিভ, আদিব চাচ্ছে না শফিক বুলার সাথে দেখা করুক। করোনা রোগীকে দেখতে যেতে হয় না। কিন্তু শফিক দেখা করতে চাইল বুলার সাথে। সে নিজেও ডাক্তার। জানে, কি সুরক্ষা প্রয়োজন। প্রস্তুত হয়ে নিল। জানালার বাইরে এবার শফিক, ভেতরে বুলা। বুলা এজটু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। শফিক কবিতার লাইন বলে, ‘আমি কিন্তু কখনো তোমাকে ছেড়ে থাকি না বুলা।’
বুলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘মাফ করে দিও শফিক ভাই।’
অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ বাইরে। বুলার শারিরীক আর মানসিক অবস্থা দেখে আদিবের শরীরও অবশ হয়ে আসছে।
দশ বছর পার হয়েছে। পৃথিবী সুস্থ হয়েছে। পৃথিবীতে মহামারী আকারে করোনা নেই। সকলে ভ্যাকসিন পেয়েছে। প্রায় যমে-মানুষে টানাটানির পর আদিব বুলাকে বাসায় নিতে পেরেছে। বুলা সুস্থ। ছেলেরা বড় হয়েছে। জয়ীতার জন্ম হয় নি। আদিব-বুলার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আছে কিন্তু সেখানে কোনো ভালোবাসা নেই, খুনসুটিও নেই। লোক দেখানোর জন্য তারা পাশাপাশি আছে। আদিব আর কোনোদিনই বুলার হাত ধরতে চায় নি। বুলাও এগিয়ে আসে নি।
শফিক চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তার মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে। হসপিটালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল তাকে। তবু মাথার অসুখটা থেকেই গেছে। বিড়বিড় করে টোকন ঠাকুরের কবিতা আওড়ায়, ‘আমি কিন্তু কখনও তোমাকে ছেড়ে থাকি না।’