দেশ তখন উত্তাল, সারা বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ ২০ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী শাসক কুখ্যাত ইয়াহিয়া খান। ২১শে ফেব্রুয়ারি ’৭১-এ শহীদ মিনারে সারা বাংলার মানুষ জড় হয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলে। স্বাধীনতাকামী মানুষের সেই ঢল দেখে পাকিস্তানি শাসকদের ভিত কেঁপে উঠেছিল।
১মার্চ ১৯৭১
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর গোটা বাঙালি জাতি। আমি সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে। সম্ভবত কমনওয়েলথ বনাম পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। সেখানেই রেডিওতে শুনলাম কুখ্যাত সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান কুচক্রী ভুট্টোর প্ররোচনায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে তাদের সিদ্ধান্ত। অফিস, কলকারখানা থেকে বেরিয়ে সবাই রাজপথে নেমে আসে।
তৎকালীন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একটি মিছিল খেলার মাঠে প্রবেশ করল । খেলা বন্ধ হয়ে গেল। জানা গেল, অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষনিকভাবে হোটেল পূর্বাণীতে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেছেন। সে সময় ঢাকায় প্রচুর বিদেশী সাংবাদিক অবস্থান করছিল। আমি তখন সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজে আইএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের (এখন যেটি ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড) সাংগঠনিক সম্পাদক। মূল দলের কর্মী হলেও আমি ’৬৬-’৬৯-’৭০ আর ’৭১-এর বেশিরভাগ সময়ই আমার বন্ধু জাহিদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে যেতাম। শেখ জাহিদ হোসেন তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আর ইকবাল হল এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। সে সময় ইকবাল হলে মুক্তিযুদ্ধ প্রস্তুতি পর্বের বিভিন্ন গোপন রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলছিল। আমিও সেসব কর্মকান্ডে অংশ নিতাম। জাহিদ এখন নেই। বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছে।
ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমেই জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছি। হাইকোর্টের সামনে এসে দেখি বিশাল মিছিল আসছে। সে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আ স ম আবদুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নুরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজসহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা। আমিও মিছিলে মিশে গেলাম। মিছিল নিয়ে আমরা হোটেল পূর্বাণীতে পৌছে দেখি চারদিকে জনসমুদ্র!
‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব’ শেখ মুজিব, জয় বাংলা’ প্রভৃতি স্লোগানে গর্জে উঠেছে সবাই। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। ভেতরে সাংবাদিক সম্মেলন চলছে। আমরা বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। শুনলাম ৩ মার্চ বিকাল ৩ টায় পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ সভা। বঙ্গবন্ধু গোটা বাঙালি জাতিকে সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং বাঙালির স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি নিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠী ও ভুট্টোর কঠোর সমালোচনা করলেন। সেইসঙ্গে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনকে আরও জোরদার করে বাঙালির মুক্তির ইশতেহার – স্বাধীনতার জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
আমি ও জাহিদ খাওয়া-দাওয়া সেরে পল্টনের জনসভায় গেলাম। জনসভা শেষে গেলাম ইকবাল হলে। সেখানে তখন ‘নিউক্লিয়াস’ কমিটির জরুরি সভা চলছিল। জাহিদ ওপরে গিয়ে জরুরি সভায় যোগ দিল। নীচতলায় আমি পোস্টার লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ পর জাহিদ ফিরলো। বলল, একটু বলাকা ভবনে যেতে হবে। বলাকা ভবন মানে বলাকা সিনেমা হল ভবন। ওই ভবনের দোতলায় তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। আমরা বলাকা ভবনে গেলাম। জাহিদ খবরের কাগজে মোড়া একটি প্যাকেট নিয়ে এলো। আমরা দুজনেই গুলবাগে থাকতাম। এবার গুলবাগে ফিরবো। পথে রেডিওতে ঘোষণা শুনলাম ‘তথাকথিত পতাকা বহনকারীকে দেখামাত্র গুলি করা হবে এবং যে ভবনে এ পতাকা দেখা যাবে সেই ভবনের আশপাশে ১০০ গজের মধ্যে সমস্ত কিছু গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।’
কিন্তু জনগণ এ ঘোষণা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল। মৌচাক মোড়ে এসে দেখি চারদিকে শুধু মানুষ! সবাই উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। রাস্তায় জাহিদ আমাকে বলেছিল, এই প্যাকেটে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আছে। সবুজের মাঝে লাল গোলকের ভেতর বাংলাদেশের মানচিত্র। এটা বানানো হয়েছিল ছাত্রলীগের ‘জয় বাংলা বাহিনী’র জন্য।
জাহিদ বলল, ‘কিন্তু আজকের ‘নিউক্লিয়াস’ কমিটির জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের পতাকা নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে আগামীকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা পরিষদে প্রতিবাদ সভা হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হবে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে ওই পতাকা মিছিল নিয়ে প্রতিবাদ সভায় যেতে হবে। তুই কি আমার সঙ্গে থাকবি?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘অবশ্যই।’ ❐
[বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়]