২০০৩ সাল। ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলেজে যাই। লোকাল বাসের মেয়েদের বরাদ্দের একদম সামনের সিটটা খুব পছন্দ ছিল আমার। ওটা খালি পেলে ওখানেই বসি। সেসময় গার্মেন্টসের তখন মিনিমাম ওয়েজ আঠার শ’ থেকে থেকে আড়াই হাজার টাকা হবে। ও সময় বাসে একজন গার্মেন্টস কর্মী উঠে তার সহকর্মীকে বাসে উঠতে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু ডাকলেন তিনি হেঁটেই রওনা দিয়েছেন। পাশে বসা মেয়েটি বললেন, ‘এক টাকার জন্য দুই কিলোমিটার রাস্তা হাঁইটা যাইবো। কইলাম আমি ভাড়া দিমু অয় আইলো না।’
তাকিয়ে তাকিয়ে গ্রীষ্মের দুপুরে তপ্ত সূর্যের নীচে সে মেয়েটির হেঁটে যাওয়া দেখছিলাম। মনে হলো, মেয়েটি সাহায্য নিতেই পারত। কিন্তু জীবন সংগ্রাম হয়ত এভাবেই সাজানো। এই এক টাকার ব্যক্তিত্বর ঘটনাটি আজও মনে গেঁথে আছে।
এরপর সময় গিয়েছে অনার্সের শেষ সময়ে এসে মনে হলো সেশন জট আর ভালো লাগছে না। ভর্তি হলাম ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে। কিছু করব। ছোট একটা ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগেই একটি স্বনামধন্য গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলাম। এত বড় পরিসর এত মানুষ কিভাবে সব সামলাবো ভয় লেগেছিল। আস্তে আস্তে কাজ বুঝে কাজ বুঝে নিতে সহজ হয়ে গেল।
চাকরিটা কমপ্লায়েন্স এবং ওয়েলফেয়ার দু’টোর কম্বিনেশন। কমপ্লায়েন্সের কাজ আইন প্রয়োগ করা আর ওয়েলফেয়ার তো কল্যাণ করে যাবে। প্রথমদিকে ভীষণ অপ্রস্তুত লাগত শ্রমিকদের সরল প্রশ্নে, ‘ম্যাডাম আপনি কত টাকা বেতন পান?’ ‘ম্যাডাম আপনার জামার দাম কত?’
জয়েন করার সাত দিনের মাথায় একটা ঘটনা ভীষণ মন খারাপ করল। রত্না নামে একটি মেয়ের নতুন নিয়োগ পেল। তাকে সেলাইমেশিনে বসিয়ে দেওয়া হলো । কিন্তু বিকেলেই তাকে ডেকে বলা হয় তোমার চাকরি নাই । মেয়েটা বলে কেন? প্রশাসন কর্মকর্তা বলেন ‘এমনি তোমাকে রাখব না।’ তখন মেয়েটার ব্যক্তিগত সার্টিফিকেট, ছবি ছিঁড়ে বিনে ফেলে দেয়। মেয়েটা কান্না করে অঝোরে। তাকে সিকিউরিটি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন। আমি তো নতুন, কি বলব বুঝতে পারি না। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আর সহ্য করতে না পেরে তার অপরাধ জানতে চাইলে জানা গেল, তার স্বামীটি দুটা বিয়ে করেছিল। রত্না মেয়েটি প্রথম স্ত্রী। তার দ্বিতীয় স্ত্রীও এখানেই চাকরি করে। দু’জন এক ফ্লোরে কিভাবে কাজ করবে! হয়ত দ্বিতীয় বউটার জোর বেশি, সে ঝগড়া করে কোন্দল বাঁধিয়ে এই কাজটি সারল।
আহা! রত্নাটা কত অসহায়! ওর স্বামীটি দ্বিতীয় বিয়ে করায় সংসারে সে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। এবারে চাকরিতেও আত্মসম্মান হারিয়ে দিন কাটাচ্ছে। চাকরির নতুন অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে দেখে, নারীর অসহায়ত্ব দেখে কেঁদেছিলাম ঠিকই। কিন্তু পরে দ্বিতীয় বিয়ে ছাড়াও নানা রকম সাংসারিক ঝামেলা দেখেছি যা দিনের-পর-দিন মানসিকভাবে খুব অসহ্য লাগত। মনে হতো কিছু করতে হবে তাদের জন্য কিছু করা উচিত।
কিন্তু সংসারের এত ঝামেলার মাঝে কিভাবে তারা এত হাসিখুশি থাকে বুঝতেই পারি না। উৎসবের দিনগুলোতে তারা এত রঙিন সাজে সজ্জিত থাকে! খুব খুব ভালো লাগে। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলো – বৈশাখের দ্বিতীয় দিনে সাদা লাল, ২৬ মার্চের পরের দিন লাল সবুজ, ফালগুনে হলুদ, ভালোবাসা দিবসে লাল সাজে হাজার হাজার মানুষ যখন একসাথে রং ছড়ায় কি যে ভালো লাগে! ঈদের আগের দিন তারা থাকে ঝলমলে।
এই সাজসজ্জার পেছনে থাকে কত অজানা কাহিনী। তাদের অনেকেরই কখনো মাসের মাঝে, কখনো মাসের শুরুতে পকেটে টাকা থাকে না। খুব কষ্ট করতে হয় তাদের। অনেকের সংসার খরচ বেশি থাকায় ওই টাকাগুলো বের করতে হিমশিম খেতে হয়, আবার অনেকের স্বামী বেতনের সাথে সাথে অফিস গেটের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে টাকা নেওয়ার জন্য। পুরো টাকাটাই নিয়ে নেয়। একশ’ টাকাও হাত খরচের জন্য রাখতে দেয় না। ওর ভেতরই অনেকে পাচশ’ টাকা আগেই সরিয়ে ফেলল নিজের মা কিংবা ছোট ভাইবোনের জন্য। কাছের মানুষদের কিছু দিতে সবারই তো ভালো লাগে। কিন্তু দেওয়াটা কত কঠিন!
নিজে কষ্ট করে উপার্জন করে অথচ উপার্জন নিজে খরচ করার কোনো স্বাধীনতা নেই । তারপর বেতনের পরদিনই অনেক মেয়েকেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। একদিন সকালবেলা অফিসের মেডিকেলে গিয়ে দেখি এক মেয়ের পুরো চোখের চারপাশ কালো হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। জানতে চাইলে প্রথমে বলে ব্যথা পেয়েছে। আবারও জানতে চাইলে বলল, ‘ম্যাডাম কলপাড়ে পইড়া চোখের মধ্যে খুব ব্যথা পাইছি।’
কলপাড়ে পড়লে চোখের চারপাশে এভাবে কিভাবে কালো হয়ে যায়! পরে মেডিকেলের নার্স টিমের কাছ থেকে জানা গেল, স্বামী বেতনের পর পুরো টাকা তার হাতে তুলে না দেওয়ায় ঘুষি দিয়ে তার চোখের চারপাশে এমন কালো করে ফেলেছে। দেখে ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেল মেয়েটির স্বামী আমাদের অফিসেই চাকরি করে। ডেকে দেখি মুখটা চেনা। খুব ঠাণ্ডা মাথায় তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কেননা যদি অফিশিয়াল প্রভাব তার ওপর ফেলি তখন মেয়েটার চাকরি করাটাই কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া নির্যাতনের পরিমাণও হয়ত আরো বেড়ে যেতে পারে। হয়ত সেটা কাজে লেগেছিল। টানা ছয় মাস মেয়েটাকে মনিটরিংয করেছি। মেয়েটাকে আবারও এমন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে কিনা খোঁজ নিয়েছি। তাদের মধ্যে এরকম কোন্দল আরও হয়েছে বলে মনে হয় নি।
অফিসের এমন ছোট ছোট অনেক কাজেই প্রতিনিয়ত আমাকে স¤পৃক্ত থাকতে হয়। হঠাৎ করেই দেশে সরকারি সিদ্ধান্ত হলো, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় সকল গার্মেন্টসগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হলো। ব্যাংকের মাধ্যমে মজুরি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাহলে নাকি তাদের টাকাগুলো নিরাপদ থাকবে। আসলেই থাকে। অনেক সমস্যার সমাধানও হয়েছে। নানান রকম চুরি থেকে তারা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু তারসঙ্গে নতুন কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।
হঠাৎ বায়ার থেকে পরিকল্পনা এল শ্রমিকদের মজুরি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হতে হবে। না করতে পারলে তাদের সাথে আমাদের ফ্যাক্টরিতে একটা স্কোর আছে তা কমতে শুরু করবে। ডিজিটাল ব্যাংকিং না থাকায় নিজের পারফরম্যান্স, কাজের মানের স্কোরিং খারাপ হবে। আমি আমার বসের সাথে কথা বলে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত ¯’গিত করে রাখি এভাবে চলতে থাকে।
এরপর করোনা ভাইরাস এসে দেশ আর পৃথিবী ¯’বির করে দিয়েছে। তখন গার্মেন্টসের প্রশাসন মানবস¤পদ বিভাগের ওপর চাপলো গুরুদায়িত্ব। মরি-বাঁচি কিছু করার নাই। অফিসে গিয়ে ফাইল থেকে কর্মীদের তথ্য নিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। সেখানেও মুশকিল আবার শ্রমিকরা নিজের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো সঠিকভাবে দিয়ে তারা চাকরি করছিলেন না। কেউ বোনের কাগজকে ভাইয়ের কাগজ, ভাইয়ের কাগজকে বন্ধুর কাগজ বা সার্টিফিকেট বানিয়ে কাজ করছেন। করোনার ওই প্রকল্পের সময় শ্রমিকদের ডেকে সব তথ্য হালনাগাদ করে সময়মতো তাদের মজুরি পরিশোধ করা হলো।
করোনা মহামারী পরিস্থিতি চলে যেতে আবারও পারিবারিক কোন্দল বাড়তে লাগল। আগে তো তবু ওভারটাইমের টাকা থেকে একশ’-পাচশ’ টাকা সরাতে পারত। এখন আর সেই উপায় নেই। যে ফোনে টাকা প্রাপ্তির এসএমএস যায় সে নাম্বার তো স্বামীর কাছে। তো নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আরো বেশি পরাধীনতায় পড়ে গেল। একশ’-পাচশ’ টাকার আত্মতৃপ্তির সুযোগটুকু রইল না শেষ পর্যন্ত।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যাওয়ার আগে দেশের এক পাঁচ তারকা হোটেলে একটি সেমিনার হয়। সব বাইরের সব নামকরা ব্যাংকের প্রধান, কোন কোন দেশের সরকার প্রতিনিধিগণ ছিলেন। আমি ছোট হলেও আমার ম্যানেজমেন্ট আস্থার সাথে আমাকে পাঠালেন। যে সমস্যাগুলোর সাথে শ্রমিকরা দিনযাপন করছেন সেগুলো মাথায় রেখে সেখানে প্রশ্ন রাখি, গার্মেন্টসে শ্রমিকদের বেশিরভাগই লেখাপড়া জানেন না, তারা কিভাবে এগুলো মেইনটেইন করতে পারবে? পারিবারিক যে কোন্দলে তারা পড়ছে এগুলোর সমাধান কি? যদিও প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় নি। অনভিজ্ঞ থাকার কারণে অনেক সময়ই তাদের প্রতারণা কিংবা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মজুরিকে ঘিরে মাসের শুরুতে বা শেষে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যা কখনও প্রকাশিত হয় না। কেউ কেউ তিন-চারটা বিয়ে করে বউ রাখত শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য। তাদের হিসেবটা থাকত, তিনটা বউ প্রতি মাসে দশ হাজার করে দিলে মাসে ৩০ হাজার টাকা। তাহলে তার আর কি লাগে! বসে বসেই সে নিজের ভরণপোষণ করতে পারবে। একবার এক মেয়েকে বললাম, এই যে টাকাটা দাও কেন? এমন স্বামী রাখার দরকারটা কি ? মেয়েটা বলল, ‘ম্যাডাম, এইডা একটা সাটিফিকেট। সমাজে চলতে গ্যেলে লাগে। একলা থাকা কত কঠিন এইডা আপনে বুজবেন না। নানান রকমের ঝামেলা হয়। আবার বাচ্চাকাচ্চার বিয়া-শাদী দিতে সমস্যা হয়। যেইখানে চলে সেইখানেই সমস্যা, তা যেমন আছে একটা থাকুক।’
শুধু যে দুঃখ বিচ্ছেদ আছে তাদের তা কিন্তু না। পার¯পারিক সমঝোতায় চলে তাদের সীমাহীন সুখের দিন। দু’জন মিলে চাকরি করে, একজনের টাকায় সংসার খরচ চালায়, অন্যজনেরটা সঞ্চয় করেন। যখন একটি বড় অংক হয় তখন কেউ জমি কেনেন, কেউ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেন। খুব ভালো লাগত যখন কোনো কর্মী জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য ছুটি নিতেন। যারা সমঝোতায় চলতেন তাদের কাছে শুনেছি, অনেক সময় স্ত্রীর দেরিতে ছুটি হয়, আবার কখনো স্বামীরও দেরিতে ছুটি হয়; তখন যিনি আগে বাসায় যেতেন, তিনি যেয়ে রান্না করে সংসারের অন্য কাজগুলো দেখভাল করেন। পার¯পারিক সমঝোতায় তাদের সুখের সীমা থাকে না আর সুখী দ¤পতিদের হাসি দেখলেই বোঝা যেত তারা সুখী। খুব অল্পতেই তারা সুখী হতে শুক্রবার ছুটি থাকলে একসাথে বসে বাংলা সিনেমা দেখেন, কাছেধারে কোথাও বেড়াতে যান।
হাসি আর কষ্ট নিয়েই তাদের জীবন। জীবনের মান আগের থেকে উন্নত করার চেষ্টা তাদের সব সময় রয়েছে। এখন তারা সন্তানদের শিক্ষিত করছেন। তারা চান তাদের সন্তানরা যেন তাদের মতো এত কষ্ট না করে। তারা যেন অনেক বড় হতে পারে, বড় চাকরি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এটাই তাদের লক্ষ্য।
চাকরি করে সন্তান লালন পালনে তাদের আবেগ ও কষ্টের শেষ নেই। ছোট ছোট শিশু সন্তান- চার মাস বয়সী পাঁচ মাস বয়সী ছয় মাস বয়সি সন্তানদের তারা গ্রামের বাড়িতে রেখে আসছেন দাদীর কাছে কিংবা নানীর কাছে। কিছু করার নাই কারণ এত দীর্ঘ সময় কাজ করে সন্তানকে দেখার মতো অবস্থা তাদের নাই। আবার একটি লোক রেখে সন্তানের দেখাশোনা করবে তাও সম্ভব নয়। তাতে চাকরির বেতনের বেশিরভাগ টাকাটাই দিয়ে দিতে হবে। তাই কষ্ট হলেও এই ছোট্ট শিশুটিকে, নবজাতককে শত শত কিলোমিটার দূরে রেখে আসতে হয়। এক ছুটি ছাড়া তাদের দেখা মেলে না। এখানেও তাদের জীবন সংগ্রাম। কখনো এসে বলে ‘ম্যাডাম, আমার বাচ্চারে সুজি খাওয়াইতে যায়া মুখটা পুইড়া ফেলছে। আমার একখনই বাড়িতে যাইতে হইব। আমারে ছুটি দেন।’ তখন তাড়াতাড়ি তাকে ছুটির ব্যবস্থা করে দিতাম। পরবর্তীতে একটু খোঁজ নিতাম, ব্যস এতটুকুই।
একবার সুমি নামের এক কর্মী কাঁপা স্বরে এসে বলে, ‘ম্যাডাম, আমারে একখনই রিজাইন দিয়া দেন এখনই আমার বাড়ি যাইতে হইব।‘ বললাম, অফিসের তো নিয়ম আছে। দুই মাস আগে নোটিশ ছাড়া কি রিজাইন দেয়া যাবে? তখন খুব কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘আমার স্বামী নাই, আমার মেয়েটারে বাড়িতে আমার এক চাচার কাছে রাইখা আসি। প্রত্যেক রাতে আমার চাচা আমার মেয়েটারে ধর্ষণ করত। সহ্য করতে না পাইরা আমি আমার মেয়েটারে দূরে আইনা বিয়া দিয়া দেই। এরপর চাচায় আরো রাগ হইয়া যায়। রাগ হয়ে এখন ওইখানে আমার ছোট্ট একটু ভিটামাটি আছে সে এখন ওইটা দখল করার চ্যেষ্টা করতেছে। গ্রামের লোকজন কইছে আমি যাইয়া যদি আমার বাড়িতে থাকি তাহলে আমার এই মাটিটুক রক্ষা করতে পারব। তাই আমার এখনই বাড়ি যাইতে হবে। নাইলে আমার ওই ভিটা মাটিটুক আমি বাঁচাইতে পারব না, আমি খাইয়া থাকি, না খাইয়া থাকি আমার ওইখানেই থাকতে হইবো। ম্যাডাম, আমার পোলাডা বাড়ি যাইতে চায় না, বলে, মা আমি পড়ুম, মা আমি পড়ুম আমারে বাড়ি নিও না। আমারে পড়তে দাও মা।’ আজও সুমির কান্না আমার কানে বাজে। মনের অজান্তেই চোখের কোণে নোনা পানি জমে। তৎক্ষণাৎ অব্যাহতি পত্র জমা রাখা ছাড়া কিছুই করতে পারি নি।
এমনই শত শত সমস্যা শুনে তার আইনগত বা অফিসের যে পলিসি রয়েছে সেই অনুযায়ী সুন্দর একটা সমাধান করাই ছিল আমার কাজ। কিছু কাজ সরাসরি করতে পারতাম আর কিছু কাজ কাউন্সেলিং করেই করতে হতো। এভাবেই ১১ টি বছর পার করেছি শত সমস্যার সাক্ষী হয়ে। নতুন শ্রমিক আসার কিছুদিন পর আমাকে যে চিনত না তার সমস্যাতেও সেকশন হেডদের বলতেন, ‘আমি আশা ম্যাডামের কাছে যাব’। এটুকুই ছিল আমার চাকরি জীবনের পাওয়া। কতজন মানুষই বা পারে এই আস্থা অর্জন করতে! আমি পেরেছি সবার আস্থা আর পেয়েছি হাজার মানুষের ভালোবাসা।
কর্ম জীবনের শেষ দিন যেদিন বিদায় নিতে গিয়েছিলাম। নিজের পাশের টেবিলের সহকর্মীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়াটা আমার জন্য যতটা সহজ ছিল শ্রমিক ভাই বোনদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়াটা ততটা সহজ ছিল না। নিজের সাথে যুদ্ধ করে আমি দু’জনকে বলে আর বলতে পারি নি। না বলেই চলে এসেছিলাম। ভালো থাকুক তারা। ১১ বছরের চাকরির ইতি টেনে চলে এলাম নিজের সন্তানদের সময় দিতে।
পাশাপাশি আবারো নতুন করে উদ্যোক্তা হিসেবে পথ চলা শুরু করলাম। চলতে শুরু করলাম একটি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রত্যয়ে, আবারও সেলাই দিদিমনিদের আস্থায় দিদিমনি হওয়ার স্বপ্নে।
লেখক: সাবেক সহ ব্যবস্থাপক, ডেকো গ্রুপ।
1 Comment
পূণ্যা
বাঃ একটা গল্পে কত গল্প জেনে ফেললাম!