সম্পাদকীয়, অনুস্বর
মার্চ ২০২১, সংখ্যা ২, বর্ষ ১
‘অনুস্বর’-এর দ্বিতীয় সংখ্যাটি প্রকাশ হলো। প্রথম সংখ্যাটি আশাতীত প্রশংসা পেয়েছিল বটে, সঙ্গে সমালোচনাও জুটেছিল। দ্বিতীয় সংখ্যায় আমরা সেসব সমালোচনা মূল্যায়নের সাধ্যমতো চেষ্টাটি করেছি। ভুল থাকবেই। ভুলকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে শুদ্ধতার খোঁজ।
বর্তমান অনুস্বর সংখ্যাটিকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যা’ হিসেবে সাজানো হয়েছে। বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। সবচেয়ে বড় ক্ষতও। মুক্তিযুদ্ধ এত বিশাল আর এতটাই জুড়ে আছে যে ক্ষীণকায় ‘অনুস্বর’ তার সর্বাঙ্গ দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষুদ্রতম অংশকেও ধারণ করতে পারে না। তবু চেষ্টা তার সীমাহীন।
এই মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। দেখতে দেখতে পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে গেল। পঞ্চাশ বছর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই মধ্যরাতে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের ওপর আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হামলা করল। এই হামলার তারা নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ মুক্তিযুদ্ধের লেখক বলে পরিচিত রবার্ট পেইনের বই ‘ম্যাসাকার’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। সে বইয়ে তিনি একাত্তরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া পাকিস্তানিদের গণহত্যার তথ্য দিয়েছেন। রবার্ট পেইন বলেছেন, ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার পরিকল্পনাটি হয়েছিল এক মাস আগে, ২২ ফেব্রুয়ারি। ‘ম্যাসাকার’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস।’
কিন্তু কেন এ দেশের ‘থ্রি মিলিয়ন’ ও বাকি সকলকে মেরে ফেলতে বলল ইয়াহিয়া!
পাকিস্তানিরা কথা রেখেছে ইয়াহিয়ার। মেরে ফেলেছে তিরিশ লক্ষ মানুষকে। ধর্ষণ করেছে দু লক্ষ নারীকে। আরো অসংখ্য মানুষের ওপর চালিয়েছে নির্যাতন নিপীড়ন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা করত। পশ্চিমপাকিস্তানের শাসকরা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ধর্মকে ব্যবহার করত। কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিত। ফলে বাঙালিরা নিজেদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করত। এ দেশের মানুষ সে বৈষম্যর অবসান চাইত। সে বৈষম্যর প্রতিবাদ করতে চাইত, সে বৈষম্য ঘোচাতে চাইত, সে বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে চাইত। মানুষের এসব আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠ হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু গণমানুষের কথা একলাই বলে দিলেন- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। এই চারটি বিষয় মিশে গিয়ে তৈরি হলো- বৈষম্যের অবসান। বৈষম্যের অবসানের এই স্বপ্ন নিয়েই সংগঠিত, সংঘটিত হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু অবসান কি হলো বৈষম্যর? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে— পূর্ণতা কি পেল আকাঙ্ক্ষা? ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তি কি এসেছে?
এখন গণতন্ত্রের ধারণা পাল্টে গেছে। এখন স্বেচ্ছাচারিতার জয়জয়কার। গণতন্ত্র মানে যেন এখন গায়ের জোর। সমাজতন্ত্র বলতে মানুষ এখন কোনো আদর্শ বোঝে না, বোঝে কজন মানুষের মুখ।ফলে সমাজতন্ত্র এখন দুর্বৃত্তায়িত হয়ে গেছে। আর রাষ্ট্র যেহেতু প্রাণ ধারণ না করেও ধার্মিক হয়ে গেছে, সে কারণে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ থাকবারও আর কোনো কারণ নেই। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি আপন আভিধানিক অর্থটি হারিয়েছে। এটি এখন অন্যতম বিতর্কিত একটি শব্দ। এবং যেভাবে দেশের মানুষ ‘বাঙালি’ শব্দটাকেই গালাগাল হিসেবে ব্যবহার করছে, যেভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে ডেকে এনেদুধেভাতে রাখা হচ্ছে তাতে জাতীয়তা ব্যাপারটা যে কি সেটা নিয়েই প্রশ্ন খাড়া করা যেতে পারে।
মানুষ কেবল ছুটতে যায় প্রবাসে। দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমে গেলেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারিতে সিপিআই ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নীচের দিক থেকে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। শিক্ষাকাঠামোর নানামুখী স্ববিরোধিতায় দেশের বর্তমান শিক্ষার ব্যবস্থা লক্ষ্যহীন, দিকভ্রান্ত। মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। সকলে সকলকে সন্দেহের চোখে দেখে। বেড়েছে নিরাপত্তাহীনতা। স্ত্রী নির্যাতনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ। বেড়েছে শিশু নির্যাতন। আমরা রাস্তা বানাচ্ছি, সেতু বানাচ্ছি, আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণ করছি। কিন্তু মানুষ নির্মাণ করছি না। মানুষের গুণগত মান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না। সেকারণে এত দাম দিয়ে স্বাধীনতাটা পেয়েও কাজে লাগছে না। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তি আমাদের আসে নি। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না।ইতিহাস হলো ভিত্তি। ভিত্তি না থাকলে বর্তমান দাঁড়াবে কি করে? তাহলে ভবিষ্যৎকে কিভাবে নির্মাণ করবে! তাই মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের সামনে অবশ্যই আনতে হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন আজ জরুরি। খুব বেশি জরুরি।❐
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।