বর্ষ ১, সংখ্যা ৫, জুন ২০২১
সম্পাদক
শাহ্ জে. চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক
মুবিন খান
প্রচ্ছদ
আনিসুজ্জামান মুহাম্মদ
দাম:
বাংলাদেশে ২৫ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২.৪৯ ডলার
‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে‘অনুস্বর’-এর পঞ্চম সংখ্যাটি প্রকাশ পেল। এবারের বিষয় মহমারী। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন পৃথিবীর বয়স চারশ’কোটি বছর। আর মানুষের বয়স দু লক্ষ বছর। আজ থেকে চল্লিশ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল কীট পতঙ্গ। তিরিশ কোটি বছর আগে এ পৃথিবীর নাগরিক ছিল ডাইনোসর। চারশ’কোটি বছরের ইতিহাসে আধুনিক মানুষের অংশগ্রহণ মাত্র দু লক্ষ বছর। ৯৬.২ ভাগ অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন আর নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত ছোট্ট জৈবিক দেহটি নিয়ে মানুষেরা পৃথিবীকে নিজেদের সম্পদ ভাবতে শুরু করল। পৃথিবীর মাটিকে নিজের সম্পদ ঘোষণা করে তাতে দখলদারিত্ব চালাতে লাগল। ধ্বংস করতে লাগল নিজেদের প্রশ্বাসের অপরিহার্য উপাদান গাছপালা।
মানুষ নিজেই হিসেব কষে বের করেছে পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। মানুষ হিসেব কষে আরো বের করেছে ওই তিন ভাগ জলের মাত্র আড়াই ভাগ তার তৃষ্ণা মেটাবার যোগ্য। এই জানাজানির পরেও কি ভীষণ অবহেলায় ধ্বংস করেছে জলাধার গুলো। কেবল তাই নয়। সীমাহীন দূষণ ঘটিয়ে পৃথিবীর পরিবেশ আর জীবনগুলোকে ঠেলে দিয়েছে হুমকির মুখে। বিশেষজ্ঞ আর উদ্ভাবক দিয়ে ধ্বংস ও দূষণের ও ধারাটি নিরবিচ্ছিন্নভাবে এখনো অব্যাহত রেখেছে। বিষাক্ত করছে জলাধার। বিষাক্ত করছে হাওয়া। আকাশে মেঘের ওপরে যে প্রলেপটি সূর্যকিরণ থেকে অতিবেগুনী রশ্নিকে ছেঁকে আটকে রেখে পৃথিবীতে ঢুকতে দেয়, যার পরিচয় ওজোন স্তর, সে ওজোন স্তরকেও ছিঁড়ে ফেলল।
নিজেদের বেঁচে থাকবার অবলম্বন পরিবেশটাকে মানুষ নিজেই ধংস করতে থাকল। মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ল জলবায়ুতে। জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকল। এর ফলে ঘনঘন দুর্যোগের গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হতে লাগল। পৃথিবীর বরফ গলতে থাকার ফলে নানা জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কিছু প্রাণী এসব জীবাণু ধ্বংসে ভূমিকা রাখত। মানুষেরা তাদেরকেও বাঁচতে দিচ্ছে না। পৃথিবীর সকল কিছু হিসেব করে বের করা মানুষ ভুলে যায় নিজেদের স্বার্থেই সকল প্রাণীকে বাঁচবার সুযোগ দিতে হবে।
পৃথিবীটি যে মানুষের একলার নয়, পৃথিবীতে বসবাস করা আর সকল প্রাণীকুলেরও- এটি মনুষ্য প্রজাতি জানে না, তা নয়। জানে। কিন্তু ভুলে যায়। ভুলে যায় না আসলে। আপন স্বার্থ চিন্তায় মনে রাখতে চায় না সে। মনে রাখবার দরকার মনে করে না সে। কেননা তার বিপুল ক্ষমতা। অন্তত তাই ভাবে সে। কিন্তু ভুলে যায় দেহটি তার জৈবিক।
২০১৯ সালে এল করোনা ভাইরাস মহামারী। থমকে গেল পৃথিবী। মানুষের পৃথিবী। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়া মানুষেরা হলো ঘরবন্দি। এবারে মানুষের থেকে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিলো অতিশয় ক্ষুদ্র খালি চোখে দেখতে না পাওয়া করোনা ভাইরাস। প্রকৃতিতে বয়ে গেল আনন্দর বন্যা। কমে গেল বায়ু দূষণ। কমল শব্দ দূষণ। জুড়ে গেল ছিঁড়ে যাওয়া ওজোন স্তর। ঝকঝকে প্রাণবন্ত হলো প্রকৃতি। প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারল এতদিন মানুষ থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকা প্রাণিরা। বিশ্বগণমাধ্যম শিরোনাম লিখল, প্রাণীদের জন্যে প্রকৃতিতে এটিই বোধহয় প্রথম প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ।
পৃথিবীতে মহামারীর ইতিহাস বেশ ঋদ্ধ। মানুষের মতোই। মানুষ যখন থেকে ইতিহাস লিখতে শুরু করেছে, তখন থেকেই মহামারীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মানব সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, সংক্রামক রোগ ততই বেড়েছে। একই সঙ্গে ভয়ংকরও হয়েছে। সকল কিছু হিসেব কষে বের করে ফেলা মানুষ হিসেব কষে জানাল, একশ’ বছর পর পৃথিবীতে মহামারী আসে। আসে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকরতে। আসে পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে নিরাময় করতে। গেল কয়েক হাজার বছরে পৃথিবীতে অসংখ্য মহামারী এসেছে। চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। মরেছে কোটি কোটি মানুষ।
মহমারীতে এই কোটি কোটি মৃত্যু দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী মানুষের পরাজয়। আদিম মানুষ পাথর ঘষেঘষে আগুন জ্বালাত। সে মানুষ বিবর্তনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে দারুণ সফল হয়ে উঠে মঙ্গলগ্রহে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখছে। সে স্বপ্ন সার্থক করতে ভীষণরকম গতিতে এগিয়েও চলেছে। কিন্তু‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’কখনও‘প্রাণপণে পৃথিবীটার জঞ্জাল সরিয়ে আগামী শিশুর বাসযোগ্য’করবার চেষ্টাটি করে নি, করছে না এখনও। করোনা আমাদের জানাল, দারুণ সফল মানুষের পরাজয়ের মূল জায়গাটির নাম স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত। গেল দু বছরে পৃথিবী জুড়ে দেশে দেশে চলতে থাকা যে মৃত্যুর মিছিল, সেটি আমাদেরকে সে তথ্যটিই জানায় আসলে। আমরা দেখলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দারুণ সফল মানুষ জীবন সাজাতে খুব করে সার্থক হলেও জীবন বাঁচাতে খুব করে ব্যর্থ হলো। কেননা ব্যবস্থা মুনাফা বোঝে, মানবতা বোঝে না। বিবেচনাটি তাই একজন মানুষ মানে একজন গ্রাহক কিংবা ক্রেতা, জীবন নয়।
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।