অবশেষে অনুস্বর অর্ধ বছর পূর্ণ করল। প্রকাশিত হলো অনুস্বরের ষষ্ঠ সংখ্যাটি। এবারের সংখ্যাটি বাংলাদেশের প্রবাসীদের নিয়ে। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ। সরকারি হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি। এক হিসেবে জানা যায়, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশি রয়েছেন। বিএমইটিএর হিসেব মতে, ১৯৭৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছে। গেল বছর করোনা ভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী আয় কিছুটা কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে। ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ ছিল অষ্টম স্থানে। পরের বছর করোনা মহামারী প্রথম বছরে উঠে এসেছে সপ্তম স্থানে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পেয়েছে। এটি মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির নিরিখে যা ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান সাধারণত উত্স হয় দেশটির উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি খাত থেকে। বাংলাদেশেরও সেটিই ছিল। স্বাধীনতার পরের বছরেই ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। তার মধ্যে ৯০ পণ্যই ছিল পাট ও পাটজাত। পাটের পর প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল চা ও হিমায়িত খাদ্য। একসময় ছেলেমেয়েদেরকে পাঠ্য বই শেখাত, কৃষিপ্রধান এই দেশটিতে পাট হলো সোনালী আঁঁশ। কেননা পাট হলো এ দেশটির প্রধান অর্থকরী ফসল। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে স্বীকৃত ছিল পাট। পঞ্চাশ বছর আগের ওই পণ্য রপ্তানির চিত্রটি এখন বদলে গেছে। পাট শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। পাটকলগুলো লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বা ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এসব কলকারখানায় কাজ করতে থাকা শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। পাটকে সরিয়ে পণ্য রপ্তানির শীর্ষস্থানের জায়গাটি দখল করেছিল তৈরি পোশাক খাত। এখন সে জায়গাটিও পাল্টেছে। সে জায়গা এখন নিয়ে নিয়েছে মানুষ।
আমরা এখন মানুষ রপ্তানি করি। কায়দা করে এর আমরা নাম দিয়েছি জনশক্তি রপ্তানি। এই রপ্তানি করা মানুষদের আয়ই এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের একভাগের নিয়মিত কোনো কর্মসংস্থান নেই। প্রতি বছর ১৮ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে আসছে। এদের মধ্যে গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রতি বছর কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা দেশের চলতি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেকেলে বলে আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলছেন, শিক্ষার মানের সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানও ভালো নয়। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী বেশ ক’বারই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার কথা বলেছেন। তারমানে সরকারও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ওই বক্তব্যকে সমর্থন করেন। সে কারণেই শিক্ষা ঢেলে সাজাতে চান। তারওপর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক নেই। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার যোগাযোগ নেই বলে শিক্ষা থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ে।
সমাজের প্রধান অংশটির কাছে জীবিকাই মুখ্য। এটি খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ভালো ও সুস্থভাবে বাঁচতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি খুব দরকার। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র অর্থ উপার্জনের পন্থা তৈরি করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সে ব্যর্থতা ঢাকতে রেমিট্যান্সকে আঁঁকড়ে ধরেছে। সরকারের রেমিট্যান্সের বিজ্ঞাপনের ফলে দরিদ্র মানুষ ঋণ করে, জমি বেচে, গয়না বেচে শ্রমিকের কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু চাইলেই ফিরতে পারছে না। খরচের টাকাটা তুলতে হবে। আটশ’ থেকে হাজার রিয়াল বেতন। দেশে পরিবারকে খরচও পাঠাতে হয়। এভাবেই বৃত্তে আটকে যায় প্রবাসী শ্রমিকের জীবন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব পেশায় দক্ষকর্মীর চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কমিপউটার সিস্টেম অ্যানালিস্ট, রোবটিক্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বিগ ডাটা অ্যানালিস্ট, সিকিউরিটি এক্সপার্ট, কিউলিনারি সার্ভিস এবং নির্মাণশিল্প। এছাড়া জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নার্সিং, বয়স্ক সেবা, ওয়েল্ডিং, কেয়ার গিভিং, পাইপ ফিটিং, প্লাম্বার, কৃষি, হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ইত্যাদি পেশার চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রধানত নির্মাণশিল্পের জন্যে শ্রমিকের চাহিদাটি সুষ্ঠুভাবেই পূরণ করে। কিন্তু দক্ষতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলাম ও কারিগরি শিক্ষা পদ্ধতি এখনো পুরোনো ধাঁচের তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের ৭৫ শতাংশ নিয়োগকারীদের বাংলাদেশি শ্রমিকদের কারিগরি দক্ষতার ওপর আস্থা নেই।
কারণ আমাদের কর্মীরা দক্ষ নয়। শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার যোগাযোগটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জীবিকার সে যোগাযোগটা নেই। ফলে দক্ষ কর্মীও আমরা তৈরি করতে পারছি না। শিক্ষার সঙ্গে যতদিন কাজের ক্ষেত্রটির মেলবন্ধন তৈরি করা না যাবে, ততদিন আমরা না পাবো দক্ষ কর্মী, না পাবো শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।