বর্ষ ২, সংখ্যা ৬, জুলাই ২০২২
সম্পাদক
শাহ্ জে. চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক
মুবিন খান
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
মোহাম্মদ আসাদ খান
ইলাস্ট্রেশন
আনিসুজ্জামান মুহাম্মদ
দাম:
বাংলাদেশে ১০০ টাকা
যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৯৯ ডলার
পদ্মা সেতু ও মায়ের মতো নদী
বাংলাদেশে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ হলো। সে কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে উদযাপিত হয়ে গেল এক আনন্দযজ্ঞ। আর এই উদযাপনের কেন্দ্রটির নাম পদ্মা সেতু।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান নদীটি হলো এই পদ্মা নদী। নদীমাতৃক মানে হলো মায়ের মতো। গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা নদী অববাহিকা এলাকা বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানের প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। তিন অববাহিকার মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত গঙ্গা বা পদ্মা অববাহিকা, প্রায় ১১ লাখ বর্গকিলোমিটার। এই অববাহিকার সিংহভাগই পড়েছে ভারত ও নেপালে। বাংলাদেশে পড়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। ভারতে যেটি গঙ্গা, সেটির নাম বাংলাদেশ অংশে পদ্মা। এটি গঙ্গার প্রধান ধারা। গঙ্গা নদী বাংলাদেশে যমুনার সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত গঙ্গা নামেই প্রবাহিত। এরপর থেকে পদ্মা নামে মেঘনার সাথে গিয়ে মিলেছে।
এখন বর্ষা। ভরা বর্ষায় পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে সাড়ে ৪ মিটার। কঠিন এই স্রোতের সঙ্গে তুলনা চলে শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদীর। খরস্রোতা নদী হিসেবে অ্যামাজন প্রথম, ওর পরেই আমাদের পদ্মা। কিন্তু প্রকল্পে কাজ করা বিদেশি বিশেষজ্ঞরা স্রোতের এই বিষয়টি মানতে চাইতেন না। কেননা ওই অতটা স্রোত থাকে কেবল পাহাড়ি নদীতে। আর পদ্মা তো সমতল ধরে সোজা গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। আমরা অতটা জল বুকে নিয়ে প্রবল বেগে বয়ে চলা, গড় প্রস্থ যার ১০ কিলোমিটার, সে পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করে ফেলেছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। দৈর্ঘ্য তার ৬.১৫ কিলোমিটার। আর এই নির্মাণটি করা হয়েছে বাংলাদেশের নিজেদের টাকায়। সে টাকার পরিমাণ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি।
দক্ষিণাঞ্চলে যারা যাতায়াত করেন ফেরি পারাপারে পদ্মা পাড়ি দেয়া কি ভীষণ দুর্ভোগ সেটি তারাই জানেন। সাত আট ঘণ্টার সে দুর্ভোগ এখন সাত মিনিটে বাহনের আসনে বসেই পেরিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা সেতু বিভিন্নভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প বিকাশে ব্যাপক যে ভূমিকা রাখবে সেটি অনস্বীকার্য।
আমরা কি তবে নদীকে জয় করতে পেরেছি? প্রশ্নটি ঋণাত্মক বটে। কিন্তু উত্তরটি ধনাত্মক।
বাংলাদেশের পরিচিতি নদীমাতৃক হিসেবে। ফলে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম নদী পথেরই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নৌপরিবহনে খরচ কম হলেও, জ্বালানি সাশ্রয়ী হলেও, পরিবেশবান্ধব হলেও বাংলাদেশের সকল সরকারই কাছেই নদী অবহেলিত হয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ৩৭ শতাংশ মালামাল পরিবহন হতো নদীপথে। তখন ১৬ শতাংশ যাত্রী নৌপথে যাতায়াত করত। এখন এইটি কমে যথাক্রমে ১৬ শতাংশ এবং ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নদী দিন দিন নাব্যতা হারাচ্ছে, নদীপথ পরিবর্তিত হচ্ছে এবং নদী হচ্ছে সংকীর্ণ।
অন্যদিকে সড়ক পথের উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে হাজার হাজার খাল-বিল ও নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। অথবা দখলদারিত্ব চালিয়ে সংকোচনের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, ওসব জলপথ ধরে এখন আর নৌযান চলে না। ঢাকার রামপুরার ঝিলটিতে এক সময় দেশের নানা প্রান্ত থেকে পণ্য ও ফসল পরিবহণ হয়ে আসত। সেটি হাতিরঝিল করে বানাবার পর ওর জল এখন অস্পৃশ্য। আফতাবনগর আর মেরাদিয়ার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত খালটি উন্নীত হয়েছে নর্দমায়। ছিল সায়েদাবাদ ও ফকিরাপুলের খাল। দুটোই এখন বিলুপ্ত। পুরনো মানচিত্র ধরে এগুলে এমনি শত শত উদাহরণ দেয়া যাবে। অথচ ছোট ছোট সেতু নির্মাণে খুব সহজেই এসব খাল-বিল-ঝিল বাঁচিয়ে রাখা যেত। আর বুড়িগঙ্গা নিয়ে তো নতুন করে বলবার কিছু নেই।
আর নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ও নদীপথের প্রতি এই উদাসীনতারই ফলাফল দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। পদ্মা সেতুর যখন উদ্বোধন চলছিল তখন সিলেট ও সুনামগঞ্জের অধিকাংশ অঞ্চল বন্যার পানির তলায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জানিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তদেশীয় উদ্যোগের অভাব ও নিজেদের অব্যবস্থাপনার কারণেই এই বন্যা। এবং এই তিনটির দায়ই একান্তই আমাদের। আর কারও নয়।
বিশাল কর্মযজ্ঞের পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক গর্বের, অহংকারের। এই সফলতাকে ঘিরে আনন্দযজ্ঞ চলতেই পারে। কিন্তু যে নদীকে আমরা ‘মায়ের মতো’ ডেকে ডেকে বেড়ে উঠেছি, উঠছি— নিজেদের জীবনে তার গুরুত্ব যেন আমরা ভুলে না যাই।
এবারের সংখ্যায় লিখেছেন:
লুৎফুল হোসেন
আনিসুজ্জামান মুহাম্মদ
ড. নাজমুন খাতুন
মাসুদ অর্ণব
রেখা আক্তার
হোসেন ইমাম
জাহান আরা
সুলতানা পারভীন শিমুল
সেলিনা হোসেন
মাহমুদ জামাল কাদেরী
আহসান কবির
মিত্র সত্যপ্রকাশ
নহরা খান নিয়ন্তা
শাহ্ জে. চৌধুরী
মুবিন খান
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।