বর্ষ ১, সংখ্যা ১০, নভেম্বর ২০২১
সম্পাদক
শাহ্ জে. চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক
মুবিন খান
প্রচ্ছদ
আনিসুজ্জামান মুহাম্মদ
দাম:
বাংলাদেশে ২৫ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২.৪৯ ডলার
নভেম্বরের অভ্যুত্থান
নভেম্বর সংখ্যাটি অনুস্বরের দশম সংখ্যা। এবং নভেম্বরের সংখ্যাটি বিষয়ের দিক থেকে একটু অন্যরকমও বটে। এবারের অনুস্বরের বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে ‘নভেম্বরের অভ্যুত্থান’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়টা ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য একটি ক্রান্তিকাল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় অস্থির এক সময়। একে কেউ অন্ধকার সময় বলছেন, আবার কেউ বলছেন এ হলো আলোকরশ্মি আগমনের সময়। রক্তপাতহীন রক্তপাতের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছিল বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের রাজনীতির। অবিশ্বাস্য পালাবদলে সেদিন পৃথিবী দেখেছিল ‘কয়েক মুহূর্ত’র ‘সরকারবিহীন’ একটি রাষ্ট্র। সিপাহী-জনতার মগজে ওইটুকু সময়ে যে দ্বিধা আসন গেড়ে বসেছিল, রাজনীতির দারুণ প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পরও, ছেচল্লিশটি বছর অতিক্রান্ত হবার পরও, পুরো একটি প্রজন্ম সময় নিঃশেষিত হবার পরও, নতুন আরেকটি প্রজন্ম হাল ধরবার পরও সে দ্বিধাবিভক্তি এখনও কাটে নি। দ্বিধা আর বিভক্তি রয়ে গেছে সেই ছেচল্লিশ বছর আগে যেখানে ছিল সেখানেই। এখন আরও গাঢ় হয়েছে।
সেসময়ের সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে একটা প্রবল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল, নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নির্মাণ তারই ধারাবাহিকতা। ২০০২-এর সেপ্টেম্বরে কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল দৈনিক প্রথম আলো সমপাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘…৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করা; সংবিধান লঙ্ঘন করে যে অবৈধ খুনি সরকার দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল তার অপসারণ করা।…’
৩ নভেম্বর মধ্যরাত পার হবার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান হয়। ’৭৫-এর আগস্টে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল ৩ নভেম্বরের এই পাল্টা অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফের সঙ্গী ছিলেন। খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান। সেকারণেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেছিলেন। ৩ নভেম্বরেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের দিন দশেক পর সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে। ’৭৫-এর ২৪ আগস্ট খন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। নানান লেখাপত্র থেকে জানা যায়, কিন্তু জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলেও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা বঙ্গভবনে সেনাবাহিনীর অনেককিছুই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
অন্যদিকে বন্দি জিয়া ফোনে কর্নেল তাহেরের কাছে সাহায্য চাইলে তাহের জাসদকে নিয়ে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াকে মুক্ত করেন। পরে গোপন সামরিক আদালতে বিচারের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জিয়াউর রহমানই তাহেরসহ ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সে বিচার ও তাহরের ফাঁসিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহী সৈন্যরা জেনারেল খালেদ মোশাররফকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে চার্জ করে হত্যা করে। হত্যা করে তার দুই সহযোগী কর্নেল হুদা এবং লে. কর্নেল হায়দারকে।
খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান। কিন্তু কতগুলো প্রাণ ঝরে গেল! দেশ গড়ার মানুষগুলোকেই মেরে ফেলা হলো। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ- এই চারটি বিষয়কে সামনে রেখে সংগঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। এই চারটিই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। এ কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। ৭ নভেম্বরের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা হলো। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকেও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো। কিন্তু যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে সংঘটিত হয়েছিল নভেম্বরের অভ্যুত্থান, সেটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।
অনুস্বর এ অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো বিশ্লেষণে যেতে অনাগ্রহী ছিল। অনুস্বর কেবল পেছন ফিরে ঘটনাগুলো দেখে দেখে বলতে চেয়েছে। অন্য কিছু নয়।
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।