একুশ বছর আগে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলাটি হয়েছিল। ৯/১১ হিসেবে পরিচিত এ দিনটির সাত সকালেই যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূলের দিকে রওনা হওয়া চারটি বিমান একই সময়ে ছিনতাই হয়। এ বিমানগুলোর মধ্যে দুটি নিয়ে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের (টুইন টাওয়ার হিসেবে পরিচিত) দুই ভবনে মাত্র ১৭ মিনিটের ব্যবধান দুই দিক থেকে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটনের কাছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর পেন্টাগনে আরেকটি বিমান নিয়ে হামলার চালানো হয়। এর কিছু সময় পর চতুর্থ বিমানটি পেনসিলভেনিয়ার একটি ফাঁকা মাঠে বিধ্বস্ত হয়; যা বিমান ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের প্রতিরোধের ফল বলে ধারণা।
বিশ্ব জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এসব হামলায় ২ হাজার ৯৭৭ জন মানুষ নিহত ও প্রায় ২৫ হাজার আহত হয়। পাশাপাশি হামলাকারী ১৯ সন্ত্রাসীদের সবাই নিহত হয়। এ হামলাকারীরা সকলেই মুসলিম ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদার সদস্য। এদের মধ্যে ১৫ জন সৌদি আরবের নাগরিক, দুই জন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, একজন লেবাননের ও আরেকজন মিশরের।
বিশ্বের ইতিহাসে এমন হামলার নজির তেমন একটা নেই। প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থল হামলা চালায় কোনও রাষ্ট্র নয়, একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এমন হামলা চালাতে পারে এ ঘটনার আগে তা কেউ, এমনকি আধুনিক কোনও গোয়েন্দা সংস্থাও কল্পনা করতে পারে নি। এই একটি হামলা বিশ্বের তৎকালীন পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন আনে। ৯/১১-এর আগের আর পরের বিশ্ব এক থাকে নি।
১১ সেপ্টেম্বরের হামলা প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রথম মেয়াদের গতিপথ পাল্টে দেয় আর তিনি যাকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নাম দিয়েছিলেন তার দিকে নিয়ে যায়। ৯/১১-এর জেরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বব্যাপী সামরিক অভিযান বৃদ্ধি করে, বিভিন্ন অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকা গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে, যেসব দেশ ও সরকার তাদের আশ্রয়-প্রশয় দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা শুরু করে।
হামলার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা করেন, ‘হয় তুমি আমার পক্ষে, না হলে বিপক্ষে। নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই, নিরপেক্ষ দাবি করলেও বিপক্ষে ধরে নেওয়া হবে।’
তার এই ঘোষণার মাধ্যমে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ শুরু হয়। এই নীতির আলোকে ২০০১ সালের অক্টোবরেই সামরিক অভিযান শুরু করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আল কায়েদার নেতৃবৃন্দকে আশ্রয় দেওয়ায় আর গোষ্ঠীটিকে নিশ্চিহ্ন করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নেটো তৎকালীন তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তান দখল করে। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত তালেবান রুখে দাঁড়ায় আর এই যুদ্ধ পরবর্তী দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলতে থাকে। এই যুদ্ধে নেটোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক মিত্র জোট বাহিনীও যোগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এটি।
তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এ আন্তর্জাতিক উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’। মার্কিন বাহিনী মাত্র দুই মাসের মধ্যে তালেবানকে কার্যকরভাবে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে পারলেও যুদ্ধ থামে নি। তালেবানের বিদ্রোহী লড়াই চলতেই থাকে। এই যুদ্ধের কারণে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তানেও অস্থিরতা তৈরি হয়।
২০০৩-এ পাকিস্তান থেকে ৯/১১-এর অভিযান বিষয়ক নেতা খালিদ শেখ মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এরপর তাকে গোপন মার্কিন কারাগার গুয়ান্তানামো বে-তে নিয়ে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়। অন্যদিকে ১১ সেপ্টেম্বরের মূলহোতা হিসেবে বিবেচিত ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালের ২ মে পর্যন্ত পালিয়ে থাকতে সক্ষম হন। এরপর মার্কিন সেনারা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে লাদনকে খুঁজে পায় ও হত্যা করে।
ওই বছরেরই জুনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু করার ঘোষণা দেন। কিন্তু দীর্ঘ যুদ্ধের পর প্রত্যক্ষ লক্ষ্য অর্জন ছাড়াই ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয় মার্কিন বাহিনী। আর তালেবান ফের ক্ষমতাসীন হয়। তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পূর্তির এক পক্ষকাল আগে আর ৯/১১-এর প্রায় ২১ বছর পরে কাবুলে মার্কিন ড্রোন হামলায় আল কায়েদার দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি নিহত হয়।
৯/১১-এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালের মার্চে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকেও সামরিক অভিযান চালিয়ে দেশটি দখল করে নেয়। ক্ষমতাচ্যুত করে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। পরে সাদ্দামকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুণ্ড কার্যকর করে। ইরাকের সামরিক বাহিনীকে অকার্যকর করা ও প্রশাসনের পতনের পর দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায় আর আল কায়েদার উত্থানের পরিবেশ তৈরি হয়।
এই যুদ্ধও দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সাদ্দাম বিহীন অস্থির ইরাকেই জন্ম নেয় আরেকটি অত্যন্ত উগ্রপন্থী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এরা আল কায়েদার দলছুট একটি অংশ হলেও পরে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে। আইএস ইরাক ও প্রতিবেশী সিরিয়ার বিশাল অংশ দখল করে সেখানে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর আইএস পিছু হটতে শুরু করে আর ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ইরাকি বাহিনীগুলো টানা কয়েক বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আইএসকে পরাজিত করে। পরাজিত হলেও আইএস পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয় নি আর এখনও তাদের যোদ্ধারা মাঝে মধ্যেই প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে থাকে। এই গোষ্ঠীটির আদর্শ ও হামলা চালানোর সক্ষমতা এখনও বিশ্বের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে আছে।
এই যুদ্ধের ফলাফল মধ্যপ্রাচ্যকে এখনও অস্থিতিশীল করে রেখেছে। মার্কিন বাহিনী এখনও ইরাক ও প্রতিবেশী সিরিয়ায় অবস্থান করে কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে আইএসের উপদলগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরাকি বাহিনী, কুর্দি পেশমার্গা বাহিনীকেও অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
সিরিয়ায় এখন ১৫০০ মার্কিন সৈন্য তৎপর রয়েছে। এরা সিরিয়ান ডেমোর্ক্যাটিক ফোর্স, এসডিএফকে নানা ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে, এসব সাহায্যের মধ্যে রয়েছে বোমা বর্ষণ করা, স্থানীয় বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা এবং অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
কৌশলগত দিক থেকে ৯/১১ হামলার মধ্য দিয়ে এমন এক পর্বের সূচনা হয় যেখানে সন্ত্রাসবাদকে কোনও ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আটকে না রেখে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা বিশ্বে। এ হামলার পর থেকে সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয় এমন গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে (আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট) সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়টি মেনে নেয়।
অনেক সরকার এ বিষয়েও সম্মতি দেয় যে, হুমকির মুখে থাকা দেশগুলো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ও সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের দমনে তৃতীয় কোনও রাষ্ট্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই সন্ত্রাসী লক্ষ্যগুলোতে হামলা চালাতে পারবে- যদি সেই রাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের দমনে ‘অনিচ্ছুক বা অসম্মত থাকে’ তাহলে। পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেন ও সম্প্রতি আফগানিস্তানে আয়মান আল জাওয়াহিরিকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে।
৯/১১ হামলা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন একটি মন্ত্রণালয়ের জন্ম দিয়েছে। এ দিনটির প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার ডিপার্টমেন্টে অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইবএস) নামের মন্ত্রণালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। যাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পরের দুই দশকেরও বেশি সময়জুড়ে এ মন্ত্রণালয়টি দেশটিকে আরও বেশি সুরক্ষিত রাখতে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। কারণ এ সময়ে দেশটিতে ৯/১১-এর মতো বড় ও প্রাণঘাতী আর কোনও হামলা হয় নি।
১১ সেপ্টেম্বরের হামলার ঘটনার পর থেকে বিশ্বজুড়ে বিমান ভ্রমণের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেদিন ছিনতাইকারীরা যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছিল সেরকম কিছু নিয়ে কেউ যেন আর বিমানে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা তল্লাশির ধরণ অত্যন্ত কঠোর করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিমানবন্দর ও বিমানের ভেতরে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে পরিবহন নিরাপত্তা প্রশাসন গঠন করে।
৯/১১-এর ঘটনায় উৎসাহিত সন্ত্রাসীরা ইন্দোনেশিয়ার বালি, তিউনিসিয়ার সেরবা, লন্ডন, মাদ্রিদসহ আরও বহু জায়গায় হামলা চালায়। এ হামলা যে আতঙ্ক তৈরি করে তা সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করার উদ্যোগে বিশ্বকে একত্রিত হতে সহায়তা করে। সাধারণ হুমকি মোকাবেলা ও এসব হুমকি চিহ্নিত করতে সামরিক বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কমন ডেটাবেজ গড়ে তোলে, কর্মী বিনিময়, যৌথ প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও যৌথ অভিযান, গোয়েন্দা তথ্য, প্রযুক্তি, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করা শুরু করে। এসব উদ্যোগের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। সন্ত্রাসীদের আস্তানার সন্ধান ও তাদের ওপর নজরদারি, হামলায় ইত্যাদিতে নতুন যন্ত্র ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ইন্টারনেটে নজরদারি বৃদ্ধি পায় এবং ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করা শুরু হয়।
এ হামলার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা নতুন নতুন সন্ত্রাসবিরোধী আইন করে তাদের শাসন আরও নৃশংস করে তোলে। আফগানিস্তান, ইরাক ও পাকিস্তানে সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়, গুম করে ফেলা হয়। মিশর, জর্ডান, মরক্কো ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সহযোগিতার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রগুলোর দীর্ঘ সময় ধরে জরুরি অবস্থা জারি করে রাখা ও বিশেষ ট্রাইবুনালে সন্ত্রাসবাদের দুর্বল অভিযোগের শুনানি ও শাস্তির মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন মেনে নেয়। মিশরে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী বিভিন্ন আইন, পদক্ষেপ ও নজরদারির মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়। নাগরিক অসন্তোষে ২০১১ সালে আরব দেশগুলোতে দেখা দেওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন ‘আরব বসন্তের’ কারণে কিছু শাসকের পতন হয়, কিন্তু তাতে অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থায় উন্নতি না হয়ে আরও অবনতি হয়।
লেখক: সাংবাদিক, পরিবেশ ও সমাজকর্মী।