একটি জাতির জন্ম, বিকাশ, ও জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশে ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য। ভাষা ছাড়া আমরা আমাদের অনুভুতির স্ফুরণ ঘটাতে পারি না। যে কোন দেশ ভ্রমণে সে দেশের ভাষা জানাটা জরুরি। ভাষা না জানলে সে দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি জানা আমাদের জন্যে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। তাই মনের কথা প্রকাশে ভাষার ব্যবহার অপরিসীম। আর সেই ভাষাকে আপন করতে গিয়ে বাঙালি জাতিকে এক নিদারুণ পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আর মানুষের মুখের ভাষা ইথারের সাথে মিলে যায়।
নারীরা ভাষার বিষয়ে বেশ আবেগী। কারণ মায়ের মুখের বাণী সন্তান প্রথম শুনে রপ্ত করে। তারপর শিশুর মুখে ফুটে ওঠে ভাষা। তাই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।
মহান ভাষা আন্দোলনে নারীর উলেখযোগ্য অবদান থাকলেও ভাষা সৈনিকদের তালিকায় নারীর অবদান সেভাবে উঠে আসে নি ইতিহাসের পাতায়! যার জন্য ভাষাসৈনিক নারীদের অবদান বাংলার সিংহভাগ মানুষের কাছে অজানা। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষা করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও রয়েছে অসামান্য অবদান। ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে নারীরা ছিলেন সামনের কাতারে। ১৯৪৭-১৯৫১ মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ৮০-৮৫ জন। এবং এই ছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৫০-১৯৫১তে ড. সাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওমেন হল ইউনিয়নের জিএস ছিলেন, ৫১’-৫২’তে ছিলেন ভিপি। তাকে দিয়ে ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা প্রথম পর্ব শুরু হয়। বলা যায় তিনি ছিলেন তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
বাংলার সর্বস্তরের জনগণের কাছে যে ইতিহাস জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চোখের সামনে; সেদিনের পুলিশ আর্মিদের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফির, শফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা অসংখ্য ভাষাসৈনিক। ৫০-এর দশকে বাংলার নারীরা ছিল অনেকটা শৃঙ্খলিত, তবুও তারা রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার দাবিতে ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসেন সমান তালে মিছিলে, মিটিংয়ে। রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলনে সংগ্রামে সভা-সমাবেশে সমান তালে সোচ্চার ছিলেন বাংলার ভাষাকন্যারা। ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যারা তমদ্দুন মজলিসের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আনোয়ারা খাতুন। তিনি ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং ৫২’র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। গাইবান্ধার বেগম দৌলতুন্নেছা ও অগ্রণী ভ‚মিকা রেখেছিলেন। তিনিও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন ১৯৫৪ সালে। নাদেরা বেগম ও লিলি হকের নামও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হামিদা খাতুন, নুরজাহান মুরশিদ, আফসারী খানম, রানু মুখার্জী প্রমুখ মহিলারাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে নৃশংসতার প্রতিবাদে অভয়দাশ লেনে এক সভায় নেতৃত্ব দেন বেগম সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান মুরশিদ। ধর্মঘট উপলক্ষে প্রচুর পোস্টার ও ব্যানার লেখার দায়িত্ব পালন করেন ড.সাফিয়া খাতুন ও নাদিরা চৌধুরী।
সেই দিনগুলোতে পাকিস্তানি আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নল উপেক্ষা করে ভাষার দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে মিছিলগুলোতে নারীরা ছিলেন সামনের সারিতে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি নারীরাই সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস দেখান।
তৎকালীন দৈনিক আজাদসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদে ভাষাসৈনিক নারীদের স্মৃতিচারণ এবং দলিল দস্তাবেজে ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার চিত্র ভেসে ওঠে। নারীদের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলে। পুলিশের টিয়ারসেল, লাঠিচার্জ এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মুখোমুখি হন ভাষাসৈনিক অসংখ্য নারী। মিছিল, মিটিং, পোস্টারিং থেকে শুরু করে পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেফতারও হতে হয়েছে নারীদের; বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে।
১৯৪৮ সালের ঘটনা স ম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ১১ মার্চ ভোর বেলা থেকে শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সকাল ৮টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হলো। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। আনোয়ারা খাতুন ও অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে (অধিবেশনে) ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর ৪টায় শেষ করত। ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না এমন নানা ধরনের স্লোগান।
এরপর জিন্নাহর ঘোষণা-পরবর্তী সব কর্মসূচিতে নারীরা সরব ছিলেন। পরে বায়ান্নর ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক জিন্নাহর ঘোষণা পুনরাবৃত্তি হলে মহান একুশের মূল ক্ষেত্র তৈরিতে ছাত্রীরা সাহসী ভূমিকা রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন চাঙ্গা করতে অর্থ সংগ্রহ ও রাতভর পোস্টার লেখার কাজ করে।
২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মূল কাজটা রওশন আরা বাচ্চুসহ আরো কয়েকজন ছাত্রীরা দ্বারাই হয়। কারণ ১০ জন করে বের হওয়া প্রথম দুটি দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। ছাত্ররা ব্যারিকেডের ওপর ও নীচ দিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। পরে তৃতীয় দলে বেরিয়ে ব্যারিকেড ধরে টানাটানির কাজ শুরু করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। এরমধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুফিয়া ইব্রাহীম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যা ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিধান পরিষদে বলেন- ‘মিস্টার স্পিকার! ঘটনা দেখে মনে হয় আসলে আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাই নি। তার প্রমাণ এ পুলিশি জুলুম। পুলিশ, আর্মির অত্যাচার থেকে আমাদের মেয়েরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। যে জাতি মাতৃজাতির সম্মান দিতে জানে না সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য।’
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এই আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছিল। কথিত আছে, আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে অর্থের যোগান দিতে আজিমপুর কলোনির মেয়েরা এগিয়ে এসেছিল নিজের টাকা, খুচরো পয়সা, স্বর্নালংকার, সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বিপ্লবী নারীদের।
ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রণে সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে লায়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, রওশন আরা বেনু, ফরিদা বারি, জহরত আরা, কামরুন নাহার লাইলি, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার ও তালেয়া রহমান অন্যতম।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে এবং প্রক্টরের সামনে পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে হতো। ‘সানসেট ল’ নামে একটি আইন ছিল। যে আইনের অধীনে বিশ্ব বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নারীদের সাথে কথা বলা নিষেধ ছিল। এবং সূর্যাস্তের আগে নারীকে হোস্টেলে ফিরতে হবে। যত কাজই থাকুক না কেন নারী আর পুরুষের জন্যে আলাদা আইন ছিল। সেই আইনের বিরুদ্ধে প্রথমে নারীরাই আওয়াজ তোলেন।
গ্রামের নারীরা তো ছিল পর্দাপ্রথার আড়ালে বন্দি। এমন সময় সামাজিক, ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বাধা-বিপত্তি ঠেলে বাংলাভাষার দাবিতে নারীদের রাজপথে নেমে আসা- এটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। পুলিশি বাধা ছাড়া ছাত্রদের তো আর তেমন কোনো বাধা ছিল না। আন্দোলনে অংশ নিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটাই নিয়েছে নারীরা। ’৯০ এর গণ অভ্যুত্থানেও কারফিউয়ের মধ্যে মৌন মিছিলে বেগম সুফিয়া কামাল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যেটি তার সংগ্রামী জীবনের উলেখযোগ্য ঘটনা। বাংলার সর্বস্তরের আন্দোলনে নারীর ভুমিকা অপরিসীম।
বাঙালি নারীর অগ্রগতির বড় ধাপ ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া। এই নারীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বের সাহসী অংশীদার- জাতীয় বীর। ❐
লেখক: কথাসাহিত্যিক