১৯৭১। বাংলাদেশ তখন উত্তাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পরই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয় প্রায় এক কোটি মানুষ। এত শরণার্থী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল ভারত সরকার। শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার জন্য আরো টাকার দরকার। এগিয়ে এলেন বিশ্বখ্যাত বাঙালি সেতারবাদক রবিশঙ্কর। তিনি বন্ধু দ্য বিটলসের গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনকে বললেন সাহায্য করতে।
তখন জুন মাস। নিজের অ্যালবামের জন্যে লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করছিলেন জর্জ হ্যারিসন। রবিশঙ্কর হ্যারিসনকে জানালেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য একটা কনসার্ট করতে চান। এরপর মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্রিকা ও খবর পাঠিয়ে দেন হ্যারিসনের কাছে। জর্জ হ্যারিসন ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি রবিশঙ্করের কাছে সেতারবাদন শিখতেন।
জর্জ হ্যারিসন তখন তৈরি করলেন ‘বাংলাদেশ’ গানটি। ঠিক করলেন বাংলাদেশের জন্য রবিশঙ্করের ‘জয় বাংলা’র সঙ্গে একটি অ্যালবাম করবেন।
রবিশঙ্কর তখন বললেন, ‘ছোট একটা কনসার্ট করলে কেমন হয়?’ হ্যারিসন বললেন, কনসার্টই যখন হবে, তখন আর ছোট করে কী লাভ? করলে একেবারে বড় একটা কনসার্টই করা যাক।
এভাবে নির্মাণ হলো ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ আয়োজনের জন্যে বেছে নেয়া হলো নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার। ঐতিহাসিক সে দিনটি ছিল রোববার, ১ আগস্ট ১৯৭১।
জর্জ তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে ‘আই মি মাইন’-এ লিখেছেন, ‘বিষয়টা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, এ ব্যাপারে আমার তাকে সাহায্য করা উচিত এভাবেই জড়িয়ে গেলাম। পরে যা ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠে।’ ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থী মানুষকে সাহয্য করতেই রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন করতে তাঁদের সময়
লেগেছিল পাঁচ সপ্তাহ। সে আয়োজনে আরো যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা কেউই কোনো টাকাপয়সা নেন নি।
‘আই মি মাইন’ বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, ‘মূল কথা হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশে ঘটতে থাকা বাস্তবতার দিকে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে পেরেছিলাম। আমরা যখন কনসার্ট করছি, আমেরিকা তখন পাকিস্তানকে অস্ত্র, যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে। সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, ‘ও হ্যাঁ, ওটা এখনো চলছে’! এভাবে দায় সারা হচ্ছে। আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম।
বিশ্বসঙ্গীতের ইতিহাসে জর্জ হ্যারিসন একটি সুপরিচিত ও বিখ্যাত নাম। আমেরিকার কালজয়ী ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’-এর অন্যতম সদস্য। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ করার ব্যাপারে তিনিই যোগাযোগ করেন বাকি শিল্পীদের সঙ্গে। জন লেনন রাজি ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে সন্তান সংক্রান্ত আইনি জটিলতায় শেষ পর্যন্ত আসতে পারেন নি।
দ্য রোলিং স্টোনসের মিক জ্যাগারও বাংলাদেশের জন্যে করা ওই কনসার্টে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখন ফ্রান্সে। সময়মত ভিসা না পাওয়ার ফলে আসতে পারলেন না।
অংশ নিয়েছেন বিটলস তারকা রিঙ্গো স্টার। কনসার্টে রাজি এরিক ক্ল্যাপ্টনও। কিন্তু তখন তিনি ভয়ংকরভাবে হেরোইনে আসক্ত। রোজ নিউ ইয়র্কের প্লেনে র টিকিট কেনেন। তবে কিনে ফেলা পর্যন্তই। প্লেনে উঠে আর বসা হয়ে ওঠে না। আয়োজকরা এরিক ক্ল্যাপ্টনের আশা ছেড়ে দু’জন ব্যাকআপ গিটারিস্ট ঠিক করলেন। ক্ল্যাপ্টনকে জানিয়ে দেয়া হলো তার আসবার দরকার নেই। কিন্তু কনসার্টের আগের দিন হঠাৎ হাজির হয়ে গেলেন এরিক। মাত্র একবার রিহার্সাল করেই উঠে পড়লেন স্টেজে ‘অসাধারণ পারফর্ম করেছিলেন সেদিন’।
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আরেক আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান। হ্যারিসনের ডাকে তিনিও সেদিন এসেছিলেন বাংলাদেশের জন্য গান গাইতে।
আরো এসেছিলেন লিওন রাসেল, বিটলসের এক সময়ের বেসিস্ট ক্লাউস ভরম্যান, বিলি প্রিস্টন, জিম কেল্টনার, জেস ডেভিস, ডন প্রিস্টন ও কার্ল র্যাডলি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ব্যাডফিঙ্গার আর দ্য হলিউড হর্নস ব্যান্ড ছাড়াও ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ডন নিক্স, জো গ্রিন, জেনি গ্রিন, মার্লিন গ্রিন, ডলরেস হল ও ক্লডিয়া লিনিয়ার। ছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের দুই মহীরূহ— সেতার সম্রাট পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর সরোদ সম্রাট ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। তাঁদের সঙ্গে তবলায় যোগ দেন আল্লারা খাঁ ও তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট, সন্ধ্যা ৭টা। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে শুরু হলো বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কনসার্ট। বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলতে থাকা পাকবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে গর্জে উঠলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পীরা। তাঁরা আপনআপন সুরে সাহায্যের আহ্বান জানালেন, নয়ন ভরা বিষন্নতায়/ মাতৃভূমি বিপন্ন প্রায়/… বাংলাদেশ বাংলাদেশ/ মরছে মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে/ ঠিক যেন এক ধ্বংসাবশেষ/… বাড়িয়ে দাও হাতটা তোমার/ বাঁচাও মানুষ বাংলাদেশের/ দেবে নাকি কিছু অন্ন ক্ষুধার/ বাঁচাতে মানুষ বাংলাদেশের।
বাংলাদেশকে সমর্থন করে গাইতে লাগলেন বিশ্ব সঙ্গীতের কিংবদন্তীরা। জানিয়ে দিলেন, পৃথিবীর বুকে জন্ম নিচ্ছে একটি নতুন ভূখণ্ড– বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এখন সাহায্য দরকার। তাঁরা বাড়িয়ে দিলেন তাঁদের হাত। সে হাতে হাত রাখবার ঘোষণা দিলেন কনসার্টে জড়ো হওয়া চল্লিশ হাজার মানুষ।
সেদিন দুটি কনসার্ট হয়েছিল। বিকেলে, আর সন্ধ্যায়। চারটি গান বাদে সকল গানই দু কনসার্টে গাওয়া হলো। কনসার্টকে সঙ্গীতের ভিত্তিতে দু অংশে ভাগ করা হয়— একটি হলো রবিশংকর আর ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ পরিবেশনায় ভারতীয় সঙ্গীত। তাঁরা পরিবেশন করেন বাংলাদেশি একটি লোকসঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা একটি বাংলা ধুন। কনসার্টের দু অংশই ওই বাংলা ধুন দিয়ে আরম্ভ করা হয়। দ্বিতীয় অংশটি পশ্চিমা সঙ্গীত। দু কনসার্টের শেষেই জর্জ হ্যারিসন গাইলেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘বাংলা দেশ’ সে গানে তিনি বললেন বাংলাদেশের মানুষের কথা, জানালেন বাংলাদেশে পাকবাহিনীর বর্বরতার কথা, সকলকে বললেন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে।
কনসার্টের পরপরই জর্জ হ্যারিসন ও ফিল স্পেক্টরের প্রযোজনায় গ্রামোফোন রেকর্ড বাজারে ছাড়ে অ্যাপল রেকর্ডস। অন্যদিকে ক্যাসেট আর টেপ বাজারজাত করে কলম্বিয়া মিউজিক। ১৯৭২ সালে কনসার্ট দুটা নিয়ে নির্মাণ করা হয় চলচ্চিত্র—দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।
কনসার্ট থেকে মোট আয় হয় প্রায় দু লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার চারশ’ আঠারো দশমিক পঞ্চাশ ইউএস ডলার। পুরো অর্থই বাংলাদেশকে সাহায্য করতে জমা দেয়া হয় ইউনিসেফের ফান্ডে। ইউনিসেফের মাধ্যমে দেয়া হয় বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের। ইউনিসেফ জর্জ হ্যারিসনের সেই অবদানের স্মরণে একটি বিশেষ ফান্ড তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্য জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ।’
জর্জ হ্যারিসনকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, পৃথিবীতে তো কতই সমস্যা আছে। সব বাদ দিয়ে আপনি কেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের ব্যাপারে কাজ করতে আগ্রহী হলেন? হ্যারিসন রবিশঙ্করকে দেখিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘কারণ আমার বন্ধু এ বিষয়ে আমার সহায়তা চেয়েছে।’
জর্জ হ্যারিসন সেতারবাদন ছেড়ে দিলেও রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব শেষ জীবন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।❐
সাংবাদিক ও লেখক শাহ্ জে. চৌধুরী আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। নিউ ইয়র্কের রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রধান ব্যক্তি। এছাড়া তিনি অধীনে রয়েছে নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলার সম্পাদক এবং নিউ ইয়র্কের অন্যতম বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা চ্যানেল’-এর চেয়ারম্যান।