গুলশানের হলি আর্টিজেন মনে আছে? জাপান ইটালিসহ আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিল। আমাদের কাগজে ওই সময়ের ভিকটিমদের ছবি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু ছাপা হলেও জাপানি নাগরিকদের ছবি সেখানে ছিল না, ছিল শুধুই বক্স। তাদের রীতি অনুযায়ী জাপান দূতাবাস জানিয়েছিল তাদের নাগরিকদের ছবি যেন না ছাপার হয়। তারা এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছিল। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিল। আমরা তখন দেখেছি। রাষ্ট্র কি রকম তৎপর হয়ে ওঠে তার নাগরিকদের নিয়ে। ঘটনাটা খুব সামান্য বলতে পারেন কিন্তু এটা কোনো সামান্য ঘটনা নয়। আমাদের দেশের নাগরিকরা যখন কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশগমন করে আমাদের দূতাবাসগুলো কতটুকু দায়িত্ব নেয়? এই প্রশ্নটি তুমুলভাবে তোলা দরকার। কারণ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে ক’দিন পরপর পুরনো রেকর্ড ভাঙার গল্প শুনি, এই গল্পের পরতে পরতে আমার দেশের শ্রমিকের গুমরে মরাকান্না আমরা কী শুনতে পাই! প্রশ্নটি জরুরি হয়ে ওঠে যখন একের পর এক লাশ হয়ে এরা দেশে ফেরে। প্রশ্ন ওঠে যেখানে তাদের শ্রম বিকোবে সেখানে আদৌ কাজের কোনো পরিবেশ আছে নাকি নেই? রিক্রুটিং এজেন্ট এবং অপরাপর সরকারি সংস্থাগুলো এই দায়িত্ব নিচ্ছে নাকি প্রতিনিয়ত অস্বীকার করে যাচ্ছে! আসুন আমরা কিছু তথ্যের দিকে তাকাই—
১. ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আট লাখেরও বেশি নারী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অর্থাৎ তিন লাখই গেছেন সৌদি আরবে। তারা কেমন ছিলেন? বলাই বাহুল্য। তখন এ নিয়ে লেখালেখিও কম হয় নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে এই দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী পাঠানো হচ্ছে সৌদিতে।
২. সৌদি আরব নারী গৃহকর্মী না পাঠালে কোনো পুরুষ কর্মীকে নেবে না বলে দেয়। ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছয় বছর সৌদি আরবের শ্রমবাজার বন্ধ ছিল বাংলাদেশের জন্য।। ২০১৫ সালে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর শর্তে সৌদী আরব সেই বাজার খুলেছিল। সে সময়ের চুক্তির পর চার বছরে প্রায় তিন লাখ গৃহকর্মী সৌদি আরবে গেছে (২০২০-এর পরিসংখ্যানটা এখনও জানি না)। তাদের মধ্যে ১৩ হাজার দেশে ফিরে এসেছেন।
৩. বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চার বছরে বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া ৪১০ নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই প্রাণ হারিয়েছেন ১৫৩ জন। এছাড়া জর্ডানে ৬৪ জন, লেবাননে ৫২ জন, ওমানে ৩৮ জন, দুবাইয়ে ২৩ জন এবং কুয়েতে ২০ জন মারা গেছেন। অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে ৬০ নারীর মরদেহ। এই ৪১০ জনের মধ্যে ৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু সৌদি আরবেই আত্মহত্যা করেছেন ৩৯ জন। আত্মহত্যা ছাড়াও গত চার বছরে ৬৯ নারী দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে নথিতে বলে হয়েছে। যার মধ্যে সৌদি আরবেই মারা গেছে ২৯ জন।
প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু আমাদের গা সওয়া গয়ে গেছে, এ যেন হরহামেশাই ঘটবে। সম্প্রতি গৃহ শ্রমিকের কাজে নদী নামে একটি মেয়েকে তার মায়ের সাথে পাঠানো হয়েছিল। নদীর মাকে রিক্রুটিং এজেন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আপনি এবং আপনার মেয়ে একই বাড়িতে কাজ করবেন। কারসাজি করে নাবালিকা নদীর বয়স বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। যখন তারা সৌদি পৌঁছালো তখন নদীর মাকে এয়ারপোর্ট আটকে দেয়। এবং সে দেশে ফিরে আসে। নদী কর্মস্থলে যোগ দেয়। যোগদানের পর তার ওপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের কাহিনি সে তার পরিবারকে জানায়। এর ক’দিন বাদে তারা জানতে পারে নদীর মৃত্যু সংবাদ। এক পর্যায়ে তার লাশ আসে মৃত্যু সনদে লেখা নদী আত্মহত্যা করেছে। নদীর পরিবারের দৃঢ় বিশ্বাস এটা আত্মহত্যা নয় কারণ মৃত্যুর আগের রাতেও নদী তাদের সাথে কথা বলেছে। বলেছে সে বাঁচতে চায়। আমাদের সংবিধান যদি প্রতিটি নাগরিকের ন্যায় বিচার নিশ্চিতের কথা বলে— তাহলে উচিত ছিল বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করা। ভিকটিমের পক্ষ নিয়ে আইনি সহায়তা দেওয়া কিন্তু এখানে রাষ্ট্র কোথায়? নদীর বাবা-মায়ের পক্ষে এই আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব? ন্যায় বিচার গরিবের দুয়ার কী পৌঁছবে? হলি আর্টিজেন ঘটনায় আমরা অপরারাপর রাষ্ট্রের তৎপরতা দেখেছি। আমাদের রাষ্ট্র তাঁর নাগরিকের জানমাল রক্ষায় তৎপর হবে কবে? দায় নেবে কবে? ❐