ঝলক দেখেই চিনে ফেলার কথা নয়। এতগুলো বছর পর ওর সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে গেল হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের লাগেজ উত্তোলনের জায়গাতে। ঝিলমিল আমার পাশে দাঁড়িয়ে ওর লাগেজ খুঁজছিল। ওকে দেখেও চট করে চিনে ফেলতে পারি নি। একটা সময় ছিল প্রতিদিন ঝিলমিলকে দেখতাম। ওকে দেখার জন্য ওদের বাড়ির সামনে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতাম। একদিন ঝিলমিলের দেখা না পেলে মনে হতো পৃথিবীটা ভীষণ ফাঁকা, বিষাদে স্তব্ধ। ওই দিনের রাতকে অনেক দীর্ঘ মনে হতো। ভোর যেন হতেই চাইত না! কখন ভোর হবে, সকালের রোদ ওদের বাড়ির চারপাশে মায়াজাল ছড়িয়ে রাখবে, আর আমরা কলেজে যাবার পথে ওকে একবার বারান্দায় দেখে অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারব, এই দহন নিয়েই রাতভর ছটফট করতাম। সদ্য তরুণ বয়সের মাদকতা বড্ড তীব্র হয়। বিরহ যন্ত্রণাও হয় নীলকণ্ঠের বিষ! ওই বিষ পরে স্থায়ীভাবে কণ্ঠে ধারণ করতে হয়েছে।
ঝিলমিল ছিল আমাদের পাড়ার পরীর মতো একটা মেয়ে। রাজকন্যাও বলা যায়। পরী এ কারণে যে, ওর সৌন্দর্যের সামনে আমরা সম্মোহিত হয়ে পড়তাম। আর রাজকন্যা বলছি এই জন্য যে, সুরম্য অট্টালিকার ভেতরে ছিল ওর আলো ঝলমলে জীবন। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে ওদের বাড়ি। আমরা ছিলাম ওদের বাড়ির সামনে মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি ফেলা রাখা দর্শকমাত্র। আমরা বলছি, আমি বাপ্পী আর রিফাত একসঙ্গে ঝিলমিলকে দেখতাম। মানে আমরা তিনজনই ওকে ভালোবাসতাম। আমাদের একতরফা প্রেম আমাদের তিনজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করেছিল। তিনজন বন্ধু একই পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে ভালোবেসে ফেলার গল্প খুব যে এলেবেলে, তা নয়। আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে ঝিলমিলকে দেখি এবং ওইদিন থেকে ওর প্রেমে পড়ে যাই। দেখামাত্র প্রেম! এই প্রেমের কোনো সত্যানুন্ধান হয় নি, কোনো ব্যাঞ্জনাও পায় নি বা প্রেমের ব্যর্থতারও কোনো সাড়াশব্দ জগতে সৃষ্টি হয় নি।
আমাদের সাদামাটা প্রেম রঙ ছড়ায় নি যেমন, তেমনি কোনো গল্পের উপজীব্যও হয় নি। জলের স্ত্রোতে খড়কূটো-শ্যাওলা যেমন ভেসে যায়, আমাদের প্রেমও তেমনি ভেসে গেছে। তবে বাপ্পী বেশ কয়েকবার জানান দিতে চেষ্টা করেছে। সুযোগ পেলেই ঝিলমিলের পথের সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে গেছে ও। একদিন একটা গোলাপও ছুঁড়ে মেরেছিল বাপ্পী। ও খুব সাহসী ছিল। পাড়ার মারামারি হলে বাপ্পী রণমূর্তি ধারণ করত। আমি বরাবরই ভীতু। রিফাত এক পা এগুলে দু’পা পিছিয়ে আসা টাইপের ছেলে। ঝিলমিলকে দেখলে আমি সবসময় দৃষ্টি সরিয়ে নিতাম। ওর দিকে তাকিয়ে থাকা যেত না। মনে হতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলব বা চোখের মনি গলে যাবে! লজ্জাও লাগত। মেয়েটিকে ভালোবাসি, অথচ সামনে পড়ে গেলে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলি। রিফাত ঝিলমিলকে সাহায্য করা যায় কিনা, এমন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেত, কিন্তু ঝিলমিলের আগুন চোখ দেখলেই উল্টোদিকে হাঁটা দিত। বাপ্পী ছিল আমাদের হিরো। ওর বুক ভরা সাহস। ও ঝিলমিলের অহংকারকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইত। একদিন ঝিলমিল রিকশায় উঠতে যাবে, বাপ্পী ওর সামনে গিয়ে ‘আই লাভ ইউ!’ বলে গান গাইতে চেষ্টা করে ফেলল। ঝিলমিল চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘হাউ ডেয়ার!’
বাপ্পী ওর চিৎকারকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে বলেছিল, ‘গানের কথাটা অনেক সুন্দর। তাই গাইতে চেষ্টা করলাম। তোমাকে কি গালি দিয়েছি? চিৎকার করলে কেন? গান শুনে কেউ চিৎকার করে নাকি! সুন্দরী মেয়েরা এত বোকা হয়!’
বাপ্পীর পাল্টা জবাব আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি কিছু বলতে পারি না, তবে বাপ্পী যে ঝিলমিলকে ভড়কে দিতে পেরেছিল, এটা ছিল আমাদের বন্ধুর সফলতার গল্প। আমরা তিন বন্ধুর মধ্যে ঝিলমিলকে পৃথক পৃথকভাবে ভালোবাসাবাসির বাজি চলছিল। বাজির বিষয় ছিল, আমরা তিনজনই নিজ নিজ প্রচেষ্টা বা কৌশলে চেষ্টা করে যাব। ঝিলমিল যার প্রেমে সাড়া দেবে, তখন থেকে অপর দু’জন আর প্রেম করার চেষ্টা করবে না। এরপর থেকে ঝিলমিলকে সম্মানের চোখে দেখবে। মন থেকে প্রেম মুছে ফেলতে হবে।
বাপ্পী যেদিন পথে ঝিলমিলকে গানের সুরে ‘আই লাভ ইউ’ বলে ফেলল, সেদিন থেকে আমি আর রিফাত হার মানতে শুরু করি। সবশেষে আমরা তিনজনের কেউ জিততে পারি নি। প্রায় চার বছর আমরা এই প্রতিযোগিতায় ছিলাম। আমাদের কারো কোনো কৌশল কাজে লাগে নি। সুরম্য প্রাসাদের পাষাণ দেয়ালে জলের ঢেউ যেমন আছড়ে পড়ে ফিরে আসে, আমরাও ফিরেফিরে এসেছি।
একদিন আমাদের চোখের সামনে মহা ধুমধামে ঝিলমিলের বিয়ে হয়ে গেল। সেদিন পুরো পাড়ায় ছিল আলোর বন্যা, আর আমাদের চোখের জলের চেয়ে বুকের মিহিন ভাঙন ছিল সবচেয়ে কষ্টদায়ক। ঝিলমিল স্বামীর সঙ্গে উড়োজাহাজে চড়ে সাতসমুদ্র পাড়িও দিয়ে ফেলল। সেই থেকে আমরা ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ কথাটা বিশ্বাস করে ফেললাম। এরপর থেকে অসমাপ্ত প্রেমের দহনে পুড়ছি। একটা সময় আমাদের তিন বন্ধুর জীবনের বাঁকও পাল্টে গেল। বাপ্পী জড়িয়ে পড়ল অপরাধীদের জগতে, রিফাত ভাগ্যান্বেষণে ব্যাংকক হয়ে কোরিয়ায় গিয়ে থিতু হলো। আমি লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পৈত্রিক ব্যবসায় ঢুকে পড়লাম।
আমি এখন ব্যস্ত ও সফল একজন ব্যবসায়ী। প্রায় পনের বছর পর ঝিলমিলের সঙ্গে বিমানবন্দরে দেখা হওয়ায় কথাগুলো মনে পেখম ছড়িয়ে পড়ল। পনের বছরে ঝিলমিলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ওর মধ্যে মাতৃত্বের সৌন্দর্য এসেছে। ভারিক্কী হয়েছে শরীর। লাবণ্য ঝরা সৌন্দর্য আরো যেন নান্দনিক হয়েছে। বিমান বন্দরে ও আমার একটা লাগেজ নিজের মনে টেনে নামিয়েছিল। আমি ওর ভুল শুধরে দিয়ে লাগেজটা ফেরত নিলাম এবং ভদ্রতাবশত ওর লাগেজ খুঁজে বের করে দিলাম। ওর লাগেজটিও আমার লাগেজের মতো। হুবুহু এক। আমার সহযোগিতায় ভীষণ খুশি হলো ও। আমি তখনো ওকে চিনতে পারি নি। আমি এসেছি সিঙ্গাপুর থেকে। আমাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে ঝিলমিল জানালো ও এসেছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থাকে। স্বামী আর দু’কন্যাকে রেখে দেশে এসেছে জরুরি কাজে, একথাও বলে ফেলল।
‘একা একজন নারীকে বিমান বন্দর থেকে বের হওয়া অব্দি সঙ্গে থাকি’ এই ভাবনায় ওর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আকস্মিক ঝিলমিল দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও দাঁড়ালাম। ঝিলমিল আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বলল, ‘আচ্ছা, আপনি কি মোহাম্মদপুর থাকেন? বা থাকতেন?’
ওর এই প্রশ্নে আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম, ‘হঠাৎ কেন এই প্রশ্ন করছেন আপনি?’
‘না। মানে আপনার নাম কি রোমেল?’
এবার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আমি মোহাম্মদপুর থাকি এবং আমার নাম রোমেল, তা এই নারী জানেন কী করে? কে তিনি? আমি অজানা ভয়ে আমতা-আমতা করে মিথ্যা কথা বলি, ‘না, আমার নাম রোমেল নয়। আমার নাম শাকিল। আমার নাম জানতে চাইছেন কেন বলুন তো?’
‘না, মানে, আপনার চেহারার সঙ্গে অনেক মিল আছে, এমন একজনকে আমি চিনতাম। তার নাম রোমেল। দেখতে ঠিক আপনার মতো! আশ্চর্য! অবশ্য প্রায় পনের বছর হলো তাকে দেখি নি।’
এ কথাটা শোনার পরপরই ঝিলমিল আমার মনে ঝলমলিয়ে উঠল। ওকে চিনে ফেললাম। বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হলো। একইসঙ্গে জীবনে হেরে যাওয়ার একটা শোক চাঙা হতে লাগল। আমার নাম মনে রাখার মতো কোনো ঘটনার জন্ম দিতে পারি নি আমি। আমি ছিলাম দূরের ছায়ার মতো। অথচ পনের বছর পর ঝিলমিল আমার নাম বলছে। ওহ, কী যাতনার বিষয়! কথাটা ভেবে একটু যেন বিষন্নকাতর হয়ে গেলাম।
ঝিলমিল বলল, ‘ওরা আমাকে খুব জ্বালাতো, জানেন? পাড়ার বখাটে ছেলে ছিল ওরা!’
এবার এ কথায় প্রেমের পরাজয়টাই হেসে উঠলে যেন। আমি চুপসে যাই। বলি, ‘মানুষ জ্ঞানী-গুণীদের নাম, কথা মনে রাখে। আপনি দেখছি, পাড়ার বখাটে ছেলেদের কথা বেশ মনে রেখেছেন! তারা কি খুব বজ্জাত ছিল? মানে ঐ রোমেল?’
‘না। রোমেল বাউ-ুলে টাইপ ছেলে ছিল। তবে আরেকটা ছিল বজ্জাত-বখাটে! ওর নাম ছিল বাপ্পী বা ঝাপ্পী। বিড়ালের মতো মিউমিউ স্বভাবেরও একটা ছেলে ছিল। ওর নাম মনে করতে পারছি না। ওদের যন্ত্রণায় বাসা থেকে বের হতে পারতাম না। বারান্দায় দাঁড়াতে পারতাম না। জানালার পর্দা সরাতে পারতাম না। ওরা আমাদের বাড়ির চারপাশে অষ্টপ্রহর দাঁড়িয়ে থাকত।’
‘ওরা আপনাকে পছন্দ করত হয়ত।’
আমার কথা শুনে সপাং করে উঠলো ঝিলমিলের চোখের দৃষ্টি। বলল, ‘পছন্দ করলেই হলো? পছন্দ করলে তো সরাসরি এসে বলতে পারত। আর নিজেকে যোগ্য করার চেষ্টা করতে পারত। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো যোগ্যতা, বলুন, আপনি?’
আমি এ কথার কোনো জবাব দিতে পারি না। কয়েক সেকেন্ড ঝিলমিলের মুখের দিকে চেয়ে থাকি। এরপর গলা নামিয়ে বলি, ‘তা আপনিই বা ওদের কথা মনে রেখেছেন কেন? পছন্দ যখন করতেন না..!’
‘নষ্টালজিয়া! কোনো প্রেম থেকে নয়, ওদের জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করি এখন। আমিও অনেক সময় তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। এখন দেশে আসলে মনে হয়, তারা কে কোথায় আছে? কী করছে? ভালোবাসি না, অথচ একটা টান অনুভব করি। এটাকে আপনি কী বলবেন?’
ঝিলমিলের কথাগুলো কি সুরেলা মনে হলো আমার? আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আমি ঠিক জানি না। আমার এমন অভিজ্ঞতা হয় নি। বইয়েও পড়ি নি। কী বলব, বুঝতে পারছি না।
‘ঠিক আছে, বাদ দিন। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার সঙ্গে রোমেলের মুখের খুব মিল। তাই..।’ বলল ঝিলমিল।
আমি কৌতুহল প্রকাশ করে বলি, ‘বাপ্পী বা ঝাপ্পীর কথা বলছিলেন, তার কোনো খবর পান নি?’
‘না। তবে একবার শুনেছিলাম কারাগারে আছে। ছেলেটা বখাটে ছিল। মারামারি করত খুব। বড় ধরনের অপরাধ করেছিল মনে হয়। এর বেশি কিছু জানি না। এবার আমি খোঁজ করব। মন চাইছে, তাদের খোঁজ নিই।’
‘আপনি সত্যি বলছেন, ওদের কারো প্রতি বা কোনো ঘটনার প্রতি আপনার দুর্বলতা নেই?’
‘না, ছিল না। তবে একটা প্রেমপত্র আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল। নিচে নাম লিখা ছিল না। দারোয়ানের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে প্রেমপত্রটা রেখে গিয়েছিল। এই ঘটনায় দারোয়ানের চাকুরি চলে গিয়েছিল। জানেন, এখন ওই দারোয়ানের জন্যও এখন আফসোস হয়। মায়া লাগে। বলুন তো, বয়সে কি এত কিছু বুঝতাম?’
ঝিলমিল যে এত কথা বলতে পারে, জানতাম না। ওর সঙ্গে কোনোদিন কথাই বলা হয় নি। দেখে মনে হতো, অহংকারী টাইপ একটা মেয়ে। পরীর মতো সুন্দরী মেয়েরা যা হয় আরকি! ওদের তো মাটিতে পা পড়তে চায় না!
আমি কথা বাড়াতে বলি, ‘চিঠিটার কী অবস্থা করেছিলেন? ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, তাই না?’
‘না। কী যে বলেন! অনেক চমৎকার কথার চিঠি ছিল ওটা। এছাড়া আমাকে প্রথম কেউ প্রেমপত্র লিখেছিল। আমি ওটা রেখে দিয়েছি। এখনও আছে ওটা। ওটা আমার কাছে গুপ্তধনের মতো!’
এমন কথা শোনার পর আমার খুব কান্না পেয়ে গেল। আমি চোখের জল সামলে নিলাম। ঝিলমিলের সামনে কেঁদে ফেললে বড্ড বেমানান হবে। আমি বিস্মিত কণ্ঠে বলি, ‘বলেন কি!’
‘চিঠিটিতে এত সুন্দর সুন্দর কথা লেখা ছিল যে, আমি সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম। চিঠিটি পরে, আর কেঁদেছি।’
‘কেন?’
‘ওই যে বললাম অসাধারণ। প্রেম প্রত্যাখান করা যায়, এমন চিঠিকে প্রত্যাখান করা যায় না। মানে, চিঠি প্রত্যাখানে পড়েনি। আমি ওটা যতœ করে রেখে দিয়েছি। আমার জীবনের প্রথম পাওয়া প্রেমপত্র, ফেলি কী করে, বলুন তো!’
ঝিলমিলের কথার জবাবে আমি কী বলব? চিঠি তো আমিই লিখেছিলাম। পনের বছর পর পত্রটির প্রশংসা পাচ্ছি। অথচ প্রেমপত্র লেখার উদ্দেশ্য সফল হয় নি। প্রেমিকের বরাতে লবডঙ্কা, আর চিঠি পেয়েছে গুপ্তধনের সম্মান! ঝিলমিলের কথাগুলো আমার মধ্যে ঘোর সৃষ্টি করছে। আমি বলি, ‘কে চিঠিটি লিখেছিল, জানতেন? মানে অকালকুষ্মা-টা কে ছিল?’
‘দারোয়ান বলেছিল নাম। যে রোমেল। মিচকা শয়তান একটা! দাঁড়িয়ে থাকত দূরে, আমার সামনে মাথা নিচু করে থাকত। আবার দেখুন, গুছিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েও দিয়েছিল। ভীতু কোথাকার!’
‘ভীতু বলছেন কেন? চিঠি লেখা কি সাহসের বিষয় নয়?’
‘আরে, ভালোবাসলে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে হবে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলে ওরা হয় মিচকা শয়তান টাইপ প্রেমিক! বুঝলেন?’
‘হা হা হা। আজ আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলে, এ কথাটা জানা হতো না। আপনার বিচারে বাপ্পী বা ঝাপ্পী নামের ছেলেরা পছন্দের ছিল, তাই না?’
‘না। ওটাও ঠিক নয়। অমন বখাটে ছেলেরা ঝড়ো হাওয়ার মতো। জীবনে আসবে, আবার ল-ভ- করে দিয়ে চলে যাবে। অমন চরিত্র খুব বিপদজনক!’
‘তাহলে আপনার জীবনে ওরা ঝড়ো হাওয়া, তাই তো?’
‘ওরা হচ্ছে ঝরাপাতার মতো। তবে পত্রলেখককে আমি আলাদাভাবে ভাবি।’
‘কী ভাবেন, বলবেন? আপনার জীবনের টুকরো গল্প শুনে কেমন কৌতুহল বাড়ছে। কিছু মনে করবেন না।’
আমার কথার জবাবে ঝিলমিল বলল, ‘না, মনে করার কী আছে। আমি নিজেই তো কথাটা তুললাম। আপনার সঙ্গে রোমেলের চেহারার মিল না থাকলে, এসব কথা বলতামও না। কী জানতে চাইছিলেন? পত্র লেখক রোমেলকে কীভাবে ভাবি, এই তো? বলছি, আমার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার চরিত্র সে নয়।
তবে একটি অসাধারণ চিঠি লিখে আমার জীবনের গোপন গল্পের একটি পার্শ্বচরিত্র সে। চিঠিটি যখন দেখি, তখন তার মুখটি ভেসে উঠে। এই অর্থে বলতে পারেন, জীবন চলার পথে তাকে মুছে ফেলতে পারি নি। সে আছে, আলোছায়ার মতো।’
‘বেশ বলেছেন। তা রোমেল এখন কী করছেন, জানেন?’
‘না। কিছুই জানি না। মনে হয়, বিয়েশাদি করে সংসারী হয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিশ্চয়ই ভালো আছেন। এবার চেষ্টা করব, তার খবরাখবর জানার। আমার ভাইয়াকে বলব। ভাইয়া ওদের চিনত। ভাইয়াকে বললে হয়ত খোঁজখবর এনে দিতে পারবে। আবার খোঁজ নাও পেতে পারে।’
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনি। ঝিলমিলের ভাই রোমিও আমাকে চেনে। রোমিও বাবা-মা এবং স্ত্রী নিয়ে ওদের তাজমহল রোডের বাড়িতেই থাকে। আমাদের বাড়ি হুমায়ুন রোডে। আমাদের খুব একটা দেখা না হলেও কাঁচাবাজার, শপিংমল বা পথে কদাচিৎ দেখা হয়ে যায়। রোমিওকে বললে ঝিলমিল আমার খবর পেয়ে যাবে। এটাও জানতে পারবে আমি এখনও বিয়ে করি নি। বাবা-মার সঙ্গে একা আছি। আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা’র দুঃশ্চিন্তাও বাড়ছে। কী করব, কোনো মেয়ে দেখলে ঝিলমিলের মুখটা ভেসে ওঠে। একতরফা প্রেমের অনুচ্চারিত ট্র্যাজেডি! ঝিলমিলের সঙ্গে ধীর পায়ে হাঁটছিলাম। এক সময় আমিও থেমে গেলাম। ঝিলমিলও থামল।
ও বলল, ‘কী হলো, থেমে গেলেন যে!’
আমি বললাম, ‘আপনি কীভাবে যাবেন? গাড়ি আসবে আপনার?’
‘হুম। আমার ভাইয়া আসছেন। যানজটে আটকে আছেন। যে কোনো সময় চলে আসবে। আপনার গাড়ি এসে গেছে?’
‘হুম। ড্রাইভার বাইরে অপেক্ষা করছে। আপনার গাড়ি এলে আমি যাব।’
‘আপনি চলে যান। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন কেন? এই স্বল্প সময়ের পরিচয়ে অনেক কথা বলে ফেলেছি আপনাকে। কিছু মনে করবেন না।’
আমি মনে মনে বলি, কত বড় এক ঘটনার জন্ম হলো আমার জীবনে, তা তুমি বুঝতে পারছ না। আমি তো যতক্ষণ পারব, তোমার সঙ্গে আছি। কোনোদিন তোমার এতটা কাছে যেতে পারি নি।
ঝিলমিল বলল, ‘চুপ করে আছেন যে! কিছু ভাবছেন?’
‘হুম। ভাবছি কিছু মানুষ হেরে গিয়েও যেন পরাজিত নয়। এই যে রোমেলের কথা আজ জানলাম। সে হয়ত নিজের কাছে একজন ব্যর্থ প্রেমিক। কিন্তু দেখুন, সে ব্যর্থ হয় নি।’
‘হা হা হা’।
ঝিলমিলের হাসির মধ্যে ঝরণার চপলতা। ও খুব মিষ্টি করে হাসে। হাসি থামিয়ে বলল, ‘কী যে বলছেন আপনি! এখানে প্রেম আসছে কীভাবে? আমি তো তাকে ভালোবাসি নি।’
‘তাহলে এই যে তাকে খুঁজবেন বললেন। ওটা কী কারণে? এটা কি এক ধরনের প্রেম নয়?’
‘না, প্রেম নয়। ওটা হচ্ছে মায়া।’
‘মায়া?’
‘হুম, মায়া।’
‘তাহলে বলতে হয় পাশ্বচরিত্র পায় মায়া, নায়ক পায় প্রেম। কী বলেন?’
‘আপনি দেখছি আমার জীবনের ছেঁড়া এক গল্প নিয়ে ডুবে যাচ্ছেন! প্রেম খুঁজছেন! হা হা হা।’
আমিও হাসি। ঝিলমিলের ফোন বেজে উঠল। ফোনে কথা বলা শেষ হলে বলল, ‘আমি তাহলে যাই। আমার গাড়ি এসে গেছে।’
‘ঠিক আছে, যান। ভালো থাকবেন।’
‘আপনিও। আর হ্যাঁ, সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ।’
‘ওয়েলকাম।’
ঝিলমিল চলে যাচ্ছে, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো পনের বছর আগে দেখা ঝিলমিলের নানা ছবি ও টুকরো ঘটনা। স্মৃতিগুলো মনে মায়া হয়ে ভাসছে।
নিউইয়র্ক থেকে।
দর্পণ কবীর একজন প্রেমের কবি। তার অধিকাংশ কবিতার উপজীব্য বিষয়- প্রেম। জন্ম বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ শহরে। ছড়া ও কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যচর্চার শুরু। এরপর গল্প, উপন্যাস ও গান লিখে চলেছেন। ১৯৯১ সালে তার প্রথম ছড়ার বই ‘ধপাস’ প্রকাশিত হয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কষ্টের ধারাপাত’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। এরপর ক্রমান্বয়ে কাব্যগ্রন্থ ‘আকাশ আয়না’ (২০১২), ‘বসন্ত নয় অবহেলা’ (২০১৬), ‘গল্পটার নাম নেই’ (২০২০), ‘আশ্চর্য দুঃখগুলো কষ্ট হয়নি’ (২০২২) প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে দর্পণ কবীর সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে বসবাস করছেন। পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক।