পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২৯ জেলার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আমূল বদলেই দেবে না, বদলে দেবে সেখানের অর্থনীতির গতি। পদ্মা সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইকোনমিক জোন, পর্যটন, ইকোপার্কসহ হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে। পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগসহ পদ্মা সেতুর কারণে দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরও সহজ হবে। বিভিন্ন ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার কারণে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চালু হতে যাওয়া এসব ইকোনমি জোনের মধ্যে বর্তমান কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জেলা সমূহে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতে গোনা। বিভিন্ন জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষের বসবাস দারিদ্র্যসীমার নীচে আর কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। কর্মসংস্থানই এখানকার বড় সংকট। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে কৃষিপণ্য পরিবহনে ইতিবাচক পরিবর্তন তো আসবেই, এর পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হলে পদ্মা সেতুর সুবিধা নিয়ে বদলে যাবে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা। কেননা কোনও দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।
যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আবর্তিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্য সামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য পদ্মা সেতুর মতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত সেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও উন্নত। কৃষি পণ্যের এবং শিল্পজাত পণ্যের বাজারজাতকরণ, শ্রমিকদের চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। পল্লী থেকে শহরের যোগাযোগের জন্য অন্য যে কোনও মাধ্যমের চেয়ে সড়ক যোগাযোগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগে, দুর্যোগ মোকাবেলা, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং রাজস্ব আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এছাড়াও সংবাদপত্র আদান-প্রদান, প্রশাসনিক কাজ এবং দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বও কম নয়। পদ্মা সেতু মহাপ্রকল্প এ ক্ষেত্রে রাখতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
চলমান বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে দারির্দ্যের হ্রাসমান হার, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষাসহ সামাজিক নানা সূচকের সাফল্যে রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, সেতু যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর অনবদ্য অবদান। যেসব এলাকায় সড়ক যোগাযোগ উন্নত হয়েছে, সেখানে দারিদ্র্যতা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, বেড়েছে জীবন-জীবিকার মান, নানা সুবিধা পৌঁছেছে। মহাসড়ক নির্মাণের ফলে গ্রামে শিক্ষার হার বেড়েছে, ঝরে পড়া কমেছে। সড়কের সুবিধা পাওয়া গ্রামে সুবিধাহীন গ্রামের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার তিন ভাগ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাত ভাগ বেশি। আবার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার কমে গেছে ১৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে মানুষের সক্ষমতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয় ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অকৃষি খাতের অবদানও তথ্য পরিসংখ্যানে মিলছে। আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য মতে, গ্রামীণ জনগণের আয়ের খাতভিত্তিক অবস্থান ছিল কৃষি (শস্য) ২৭.৮%, কৃষি (অন্যান্য) ৫.৬%, শিল্প উৎপাদন ৮.৯%, নির্মাণ ৩.০%, বাণিজ্য ১১.২%, যাতায়াত ৫.৫%, সেবা ৭.২%, রেমিট্যান্স ১৬.৯%, অন্যান্য ১৩.৯% মোট ১০০ শতক। গ্রামে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। পরিবহন কাজের সুবিধা বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। হাট-বাজারের উন্নতি হয়েছে ৬১ শতাংশ। নারীদের কাজের সুযোগ বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। হাঁস-মুরগির খামার ৪১ শতাংশ বেড়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটেছে ৪০ শতাংশ। একই সঙ্গে মাছ চাষ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এসবের সুত্র ধরে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতুর কারণে জিডিপিতে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে, যা সেতুটির ব্যয়ের প্রায় তিনগুণ বেশি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এডিবি প্রকাশিত এবং সেতু বিভাগের তথ্য অনুসারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে। আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশউৎপাদনের উপকরণের সুষম বণ্টন, উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ, দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং দ্রুত শিল্পায়নের জন্য একটি সুসমন্বিত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অত্যাবশ্যকীয় ভৌত অবকাঠামো হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হিসাবে যমুনা সেতু, রূপসা সেতু, মেঘনা সেতু, বুড়িগঙ্গা সেতু, ধরলা সেতু প্রভৃতির কল্যাণে বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পদ্মা সেতুও একই ভুমিকা রাখবে সুবিশাল একটি অঞ্চল জুড়ে। সড়ক, নৌ ও রেল ত্রিমূখী সংযোগ তৈরির ফলে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামের সঙ্গেও যোগাযোগ সহজ হয়ে হওয়ায়, সরাসরি যোগাযোগ সুবিধা পাবে যশোর বিমানবন্দর, মোংলা সমুদ্র বন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল ও দর্শনা স্থলবন্দর। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের-খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া। বরিশাল বিভাগের- বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের-গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। এর বাইরে খুলনা বিভাগের মেহেরপুর ও চুয়াডাঙাও সেতুর যোগাযোগ সুবিধার আওতায় চলে আসবে।
অর্থনীতির উন্নয়নই যে কোনও দেশের জাতীয় উন্নয়নের মূল সুচক আর পরিবহন ব্যবস্থা জাতীয় অর্থনীতিকে বিভিন্ন ধাপে উন্নয়নে সহযোগিতা করে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে। রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পায়ন সহজতর করতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ মানুষ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাস করে। আবার এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় খাদ্যভাণ্ডার। পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে সামাজিকতাসহ পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, তথ্য প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের ওপর। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই নয়, বৈচিত্র্য আসবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধক যমুনা নদী আর দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে প্রতিবন্ধক পদ্মা নদী। যমুনা নদীর ওপর যখন যমুনা সেতু নির্মিত হলো, পাল্টে যেতে শুরু করল উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির গতিপথ। এ সেতুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ নানাভাবেই লাভবান হয়েছে। সচ্ছল হয়েছেন অনেকে। পদ্মা সেতুও দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে একই ভুমিকা রাখবে। খুলনা অঞ্চলে তরমুজ, দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে নারিকেল ও সুপারি, সমতলের পান ও তেজপাতা, পটুয়াখালীতে মুগ ডাল, বৃহত্তর ফরিদপুরে পাট যশোরে ফুল চাষ হয় বাণিজ্যিকভাবে। চিংড়ি, কাঁকড়া ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে। পদ্মা সেতুর ফলে এসব পণ্য দেশের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে। মাদারীপুরের টেকেরহাট এখন দুগ্ধ উৎপাদনের পরিধি শরীয়তপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহনের অসুবিধাগুলো দূর হবে। এখানকার প্রান্তিক চাষী হতে রপ্তানিকারক সবাই লাভবান হবেন। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া হচ্ছে দেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা। আর কুয়াকাটা পটুয়াখালীর শেষ সীমানায়, সাগরকূলে। যেখানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত রয়েছে। তেঁতুলিয়া থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। যমুনা নদীতে আর পদ্মা নদীতে সেতু হওয়ার ফলে যে কেউ তেঁতুলিয়া থেকে এই পথে যাত্রা করলে তার কোনও ফেরিই পাড়ি দিতে হবে না। একটানা সড়কপথে পৌঁছে যাওয়া যাবে তেঁতুলিয়া থেকে কুয়াকাটা।
পদ্মা সেতু ‘এশিয়ান হাইওয়ে টু’-এর সঙ্গে সংযোগ হয়েছে। বর্তমান বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দ্রুত গমনাগমন ও পণ্য পরিবহনের আদর্শ মাধ্যম হচ্ছে সড়ক পথ। আন্তর্জাতিক পরিবহন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ স্থাপন একান্ত জরুরি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাল মিলিয়ে চলতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের বিকল্প নেই। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি দক্ষ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হলো। যমুনা সেতুর মাধ্যমে দেশের উত্তরাংশে পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ হয়েছিল। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাংশে পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ হলো।
পদ্মা সেতু যোগাযোগ উন্নয়নে সক্ষমতা ও স্বস্তির গল্প। বাংলাদেশের আবেগ-আনন্দ, আত্মমর্যাদা, সম্মান ও মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্প। পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন জনপদে মানুষজন প্রতিনিয়ত যে উপাখ্যান তৈরি করছে তার সমষ্টিগত রূপ পদ্মা সেতুর মহাকাব্য। পদ্মা সেতু যানজটমুক্ত, ঝামেলাবিহীন সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগে দক্ষিণবঙ্গসহ সারা দেশের মানুষের ভালোলাগা ও ভালোবাসার প্রতীক এবং প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞার মেলবন্ধন।
লেখক: গবেষক ও প্রশিক্ষক