বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতুটির নাম পদ্মা সেতু। এ সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে।
দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এই সেতুটির ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নীচের স্তরে একটি একক রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার আর প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।
দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজনের পর পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী হলো পদ্মা। বিশ্বের এই বৃহত্তম ডেল্টার মাঝামাঝি এসে বিশাল যমুনা মিশেছে প্রমত্তা পদ্মার সঙ্গে। তৈরি করেছে স্রোতস্বিনী এক বিশাল জলরাশির যা দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে আলাদা করে রেখেছে এর উত্তর পূর্বে অবস্থিত রাজধানী ও প্রধান সমুদ্রবন্দর থেকে। সেকারণে সড়কপথে যাতায়াতে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে প্রতিনিয়ত নদী পাড়ি দিতে হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করতে কোটি জনতার সময়ের দাবি ছিল পদ্মার দুই পাড়ের সেতুবন্ধন। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পর সরকার সেতুর নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘মুনসেল এ কম জে ভি’-কে নিয়োগ দেয়। সেতু নকশা তৈরির ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর তিনটি বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সদা পরিবর্তিত পদ্মার মূল স্রোতধারা, প্রচুর পলিবাহিত পদ্মার তলদেশে তীব্র স্রোত এবং ভাঙন পদ্মার তীর।
একটি দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে ১০০ বছরের স্থায়িত্বের জন্য পদ্মা সেতুকে ডিজাইন করা হয়েছে। সে কারণে এ সেতুতে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের এ যাবতকালের সর্ব দীর্ঘ পাইল। সম্পাদিত হয়েছে তীর সংরক্ষণের জন্য নদী শাসন সংক্রান্ত সর্বোচ্চ মূল্যমানের একক চুক্তি এবং ভূমিকম্প ক্ষতি রোধে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং।
সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া
সংযোগ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে প্রকল্পের বাস্তব কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড এইচসিএম-জেভি’র স্বয়ংক্রিয় কংক্রিট মিক্সিং ইউনিট ও অ্যাশফ্যাল প্ল্যান্ট ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে মাওয়া প্রান্তে ১.৬৭ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১০.৫৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সংযোগ সড়ক। এটি মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর এবং শরীয়তপুর জেলার ওপর দিয়ে জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্ক এন-৮-এ যুক্ত হয়েছে পাশাপাশি এ প্রকল্পে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন তিনটি সার্ভিস এরিয়া।
সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজের সঙ্গেই শুরু হয় সেতুর ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কার্যক্রমের পাশাপাশি চলে পাইল তৈরির প্রস্তুতি। পাইল তৈরির জন্য চীন থেকে সমুদ্রপথে আনা স্টিল প্লেটগুলোকে রি-রোলিং মেশিনের সাহায্যে ৩ মিটার ব্যাসে মুড়িয়ে টিউব আকৃতি দেয়া হয়। ওয়েল্ডিংয়ের সাহায্যে এসব টিউব খণ্ডগুলোকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যের টিউব পাইল প্রস্তুত করা হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক টিউব পাইল প্রস্তুত হলে তা পাইল স্থাপনের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গাইডিং ফ্রেমের মধ্যে বসিয়ে শক্তিশালী হাতুড়ি দিয়ে তা ড্রাইভ করা হয়।
কিন্তু পাইল ড্রাইভের প্রক্রিয়াটি পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সহজসাধ্য ছিল না কারণ, ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য ডিজাইনকালে বিবেচিত তথ্যের চাইতে কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্নতর পাওয়া যায়। বিস্তারিত বিশ্লেষণ শেষে তদারকি পরামর্শকরা নদীর অভ্যন্তরের ৪০টি পিলারের মধ্যে ২২টি পিলারের পাইল পুনঃডিজাইনের পরামর্শ প্রদান করেন। স্কাওয়ারিং বিবেচনায় পদ্মা সেতুতে ১২২ মিটার গভীরতায় ৩ মিটার ব্যাসের যে পাইল দেয়া হয়েছে পৃথিবীতে এত গভীরে আর কোনও পাইল নির্মিত হয় নি। ট্যামডাক্ট প্রযুক্তিও পৃথিবীতে এবারই প্রথম যা পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হলো। পাইল ড্রাইভিং শেষ হলে পাইলের অভ্যন্তরের মাটি ও বালু সরিয়ে ১০ মিটার কংক্রিট বেজ গ্রাউটিং ও ৬০ মিটার কমপ্যাকটেড স্যান্ড ফিলিং সম্পন্ন করা হয়। পাইলের টপ সেকশনের অভ্যন্তরে ১৫ মিটার পর্যন্ত লোহার খাঁচা বসিয়ে অতি উন্নত মানের মিক্সচার দিয়ে করা হয় কংক্রিটিং যা পিলার নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে রড বাইন্ডিং, সাটারিং ও কংক্রিটিংয়ের মাধ্যমে শেষ হয় পূর্ণাঙ্গ পিলার নির্মাণ।
চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের নিজস্ব ওয়ার্কশপে তৈরি স্টিল ট্রাসের বিভিন্ন অংশ চীন থেকে মাওয়ায় এনে ওয়েল্ডিংয়ের মাধ্যমে জোড়া লাগিয়ে প্রস্তুত করা হয় সুপারস্ট্রাকচারের প্রতিটি স্প্যান। এসব স্প্যানের ওজন দাঁড়ায় ৩ হাজার ১০০ মেট্রিক টন, যা উত্তোলন করে পাশাপাশি দণ্ডায়মান দুটি পিলারের ওপর বসানোর জন্য চীন থেকে আনা হয় চার হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভাসমান ক্রেন ‘টিএনইহো’। এভাবে পিলারের ওপর পিলার সংযোগ করে ক্রমান্বয়ে চলে স্প্যান বসানোর কাজ।
শুরু হয় সেতুর রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে তৈরি করা রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্ল্যাবগুলো ক্রেনের সাহায্যে ট্রাসের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে পোস্ট টেনশনিংয়ের মাধ্যমে পর¯পর যুক্ত করা হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার ৯৩০টি স্ল্যাবে নির্মিত হয়েছে সেতুর ওপরের ডেকের রোডওয়ে এবং নিচের ডেকে রেলওয়ে। পাঁচটি লেয়ারে তৈরি হয়েছে সেতুর ২২ মিটার প্রস্থ চার লেনের সড়ক। মূল সেতুকে সংযোগ সড়কের সঙ্গে যুক্ত করতে মাওয়া প্রান্তে স্থলভাগে ৩৯টি পিলারের ওপর ১ হাজার ৪৭৮ মিটার এবং জাজিরা প্রান্তের স্থলভাগে ৪২টি পিলারের ওপর ১ হাজার ৬৭০ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি রোড ভায়াডাক্ট নির্মিত হয়েছে। মাওয়া এবং জাজিরা প্রান্তে মূল সেতুতে রেল চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে ১৪টি পিলারের ওপর ৫৩২ মিটার দীর্ঘ দুটি রেল ভায়াডাক্ট। পাশাপাশি ৭টি পিলারের মাধ্যমে নদীর অভ্যন্তরে আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে ৪০০ কিলো ভোল্ট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন।
দুর্নীতির অভিযোগ
২০১১ সালে সেতু নির্মাণের সব আয়োজন যখন শেষ তখনই আসে অপ্রত্যাশিত এক আঘাত। ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ তোলে প্রথমে বিশ্বব্যাংক এবং পর অন্যান্য উন্নয়নসহযোগী প্রকল্পটিতে অর্থায়ন স্থগিত করে। তবে কোনো কিছুই আর তখন স্বপ্নের সেতু নির্মাণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
নদীশাসন
সেতু নির্মাণের পাশাপাশি সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড মাওয়া ও জাজিরার উভয় তীরে শুরু করে নদীশাসনের কাজ। তিন স্তরের নদীশাসন কাজে ড্রেজিং করে নদীর তলদেশ প্রস্তুতের পর ডাম্পিং করা হয়েছে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ এবং পাথর। ইংল্যান্ড থেকে আনা একটি অত্যাধুনিক রিভার সার্ভে নৌকার মাধ্যমে ব্যাথিমেট্রিক সার্ভে সম্পন্ন করে ডাম্পিং প্রিজিশন নিশ্চিত করা হয়। আর নদী তীরে সিসি ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয় সুদৃশ্য সুরক্ষা বাধ। এভাবেই নদীর তীরঘেঁষে মাওয়ায় ৩.১৩৫ কিলোমিটার এবং জাজিরায় ১৩.০৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মিত হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণ
এ সেতুর জন্য মোট ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী, সেতুর স্থান অনুমোদিত হলে নদীর উভয় পাড়ের মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলায় এ কার্যক্রম চলে।
পুনর্বাসন
ভূমি অধিগ্রহণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন পরিকল্পনা অনুসারে নদীর দু পাড়ে সাতটি মডেল টাউন তৈরি করে দেয়া হয়। যেখানে ২ হাজার ৯৯২টি আবাসিক প্লটে ১৪ হাজার ৯৬০ জন মানুষ বসবাস শুরু করেছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে ১০০টি বাণিজ্যিক প্লট ও ১২০টি উন্মুক্ত বাণিজ্যিক স্থান বরাদ্দ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য দেয়া হয়েছে কর্মমুখী ও আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। সর্বমোট ১ হাজার ৫৮৭ জনকে এরূপ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুনর্বাসন এলাকায় চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম
প্রকল্প এলাকায় বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় নব্বইয়ের বেশি প্রজাতির প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজারের অধিক ফলজ ও বনজ বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প এলাকাকে সরকার থেকে পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস ও নমুনা সংরক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি অস্থায়ী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ প্রকল্পে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছে ‘এসডব্লিউও ওয়েস্ট বাংলাদেশ আওয়ামী ইন অ্যাসোসিয়েশন উইথ বুয়েট’ এবং কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন অ্যাসোসিয়েটস। ম্যানেজমেন্ট সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিল ‘রেন্ডাল লিমিটেড ইউকে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’। এছাড়া সেফটি টিম ছিল বাংলাদেশ আর্মি।
বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু এখন বাস্তব রূপ লাভ করেছে। ধীরে ধীরে এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে এ সেতু। ইতোমধ্যে পৌঁছুতে শুরুও করেছে। পরিবহন নেটওয়ার্ক, ব্লু-ইকোনোমি এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সূচিত হবে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। দেশের সামগ্রিক জিডিপিতে যুক্ত হবে আরও ১ দশমিক ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, হ্রাস পাবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য।
লেখক: সাংবাদিক