বাঙালী জাতির স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কালের সাক্ষী হয়ে থাকল মুন্সীগঞ্জবাসী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়ায় সর্বপ্রথম পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ক্ষমতার পালা বদলের ফলে সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে পুনরায় মাওয়া প্রান্তে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, দুর্নীতির অভিযোগ আর বিশ্ব ব্যাংকের অর্থপ্রদান থেকে সরে গেলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনও প্রতিবন্ধকতা বাধা হতে পারে নি।
এতদিন বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু ছিল যমুনা সেতু। বর্তমানে দীর্ঘতম সেতুর উপাধি পদ্মা সেতুর দখলে। শুধু তা-ই নয়, পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে পৃথিবীতে আমাজন নদীর পরই পদ্মার অবস্থান। অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন পিনাক-৬ লঞ্চের কথা। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট প্রমত্ত পদ্মার বুকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬। ডুবে যাওয়া সে লঞ্চটির হদিস মেলে নি আজও।
পদ্মা সেতু বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে এই সেতুর অবকাঠামো। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বে এটি এক অনন্য সংযোজন। প্রমত্ত পদ্মা নদীতে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় সাফল্য। এ সাফল্য দেশবাসীর সাফল্য।
মুন্সীগঞ্জ একটি নদীবেষ্টিত জেলা। প্রায় চতুর্দিকেই নদী। তাই অন্যান্য জেলার সাথে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নদীপথ। পদ্মা সেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে যুক্ত করার পাশাপাশি মুন্সীগঞ্জ জেলাকেও করবে সমৃদ্ধ। এ সমৃদ্ধির আলো দ্রুত ছড়াবে জেলার সিরাজদিখান, শ্রীনগর ও লৌহজং উপজেলায়। ফলে সামগ্রিকভাবে মুন্সীগঞ্জ একটি আধুনিক জেলায় পরিণত হবে। যা নিম্নোক্ত কারণে সহজেই অনুমেয়-
১. জমি অধিগ্রহণ পর্ব
আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের সবাইকেই জমি ও অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণ বাবদ কয়েকগুণ টাকা দিয়েছে সরকার। আর স্বপ্নের এই সেতুর জন্য যারা বাপ-দাদার ভিটেমাটি পুরোটাই হারিয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণের টাকার পাশাপাশি বসবাসের জন্য প্লটও করে দিয়েছে সরকার। পাঁচটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নামমাত্র মূল্যে আড়াই, পাঁচ ও সাত শতাংশের প্লট দেয়া হয়েছে তাদের। প্রায় সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সবুজে ঘেরা নান্দনিক এসব পুনর্বাসন কেন্দ্রে। মোট ৫টি পুনর্বাসন কেন্দ্রের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ে ২টি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে।
ক. কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্র। খ. যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্র।
২. জমির মূল্য ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় পোস্তগোলা থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কপথের বেশ উন্নতি হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। আশেপাশে বসতি বাড়ছে। গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, শিল্প-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটনকেন্দ্র। আর শিল্প-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটনকেন্দ্র বাড়লে তার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়বে। আর কর্মসংস্থান বাড়লে কম্বে বেকারত্ব। শুধু তা-ই নয়, মুন্সীগঞ্জ ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা হওয়াতে কেরানীগঞ্জের পাশাপাশি মুন্সীগঞ্জের তিনটি উপজেলাতেও ঢাকার কিছু চাপ কমানো সম্ভব। সরকার চাইলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানও এখানে স্থানান্তর করতে পারবে।
৩. কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়বে
পদ্মা সেতু কৃষিতে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর এ বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যোগ্য অংশীদার হতে পারবে মুন্সীগঞ্জ জেলাবাসীও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুন্সীগঞ্জ ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা হলেও এতদিন ছিল অবহেলিত। বলা যায়, বাতির নিচে অন্ধকার। মুন্সীগঞ্জবাসীরা মনে করেন, পদ্মা সেতুর কারণে সেই অন্ধকার কিছুটা হলেও ঘুচবে। মুন্সীগঞ্জে প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। এছাড়া আড়িয়াল বিলসহ জেলার নদীবেষ্টিত সব উপজেলায় ধান, পাটসহ নানা ফসল চাষ হয়। প্রচুর মাছও আছে এই জেলায়। এখন থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে এগুলো সহজেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। তৈরি হবে নতুন বাজার। অপরদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের টমেটো, কাঁচামরিচ, শসা, করলা, বেগুন, রসুন, পেঁয়াজ, ফুল, মসলা জাতীয় ফসল ও সবজি উৎপাদন হয়। যা পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সীগঞ্জসহ ঢাকার বাজারে বিক্রি করে বেশি লাভবান হবেন কৃষকরা।
সেটা মুন্সীগঞ্জবাসীর জন্যও শুভ ফলাফল বয়ে আনার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কেননা মুন্সীগঞ্জের আলু ইতোমধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে
মুন্সীগঞ্জকে আলু ও বালুর জন্য বিখ্যাত বলা হয়। কথাটা ভিত্তিহীন নয় একেবারেই, অবশ্যই অর্থবহ। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় কিছু শিল্প-কারখানা এবং সদরে বেশ কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা থাকলেও সমগ্র জেলায় শিল্প-কারখানা তুলনামূলকভাবে কমই। পদ্মা সেতু হওয়াতে সিরাজদিখান-শ্রীনগর-লৌহজং নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে দ্রুত। তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে মুন্সীগঞ্জ। আলু আর বালুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না মুন্সীগঞ্জবাসী।
৫. সড়কপথ
নান্দনিক ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের অর্ধেকেরও বেশি মুন্সীগঞ্জের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর কারণেই এই অঞ্চলের মানুষ এত সুন্দর একটি মহাসড়ক পেয়েছেন। এখন মাত্র আধঘণ্টা সময়ে এ অঞ্চলের মানুষ রাজধানীতে যাতায়াত করতে পারছেন। মুন্সীগঞ্জে নিজের বাড়িতে থেকেও অনেকে ঢাকা গিয়ে অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
৬. পর্যটনকেন্দ্র বাড়বে
ঢাকা ও আশেপাশের ভ্রমণপিপাসুদের প্রিয় গন্তব্য এখন পদ্মা সেতু। এ সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যে পর্যটনকেন্দ্রগুলো জমজমাট হয়ে উঠছে। আরও নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠবে দ্রুত। পর্যটনকেন্দ্রগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে-
ক. আড়িয়াল বিল: ঢাকার খুব কাছেই মুন্সীগঞ্জের এই ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। আড়িয়াল বিল নিয়ে মানুষের মধ্যে বেশ আগ্রহ। বিলের পানিতে পা ডুবিয়ে এবং প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখে চমৎকার একটা সময় পার করতে পারেন আপনিও।
খ. পদ্মা রিসোর্ট: লৌহজং থানা সংলগ্ন পদ্মার বিস্তৃত চর জুড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ নিদর্শন পদ্মা রিসোর্ট। এ রিসোর্টে দিন দিন পর্যটক বাড়ছে। সাড়ে তিনশ’ শতাংশ জমির বিশাল বিস্তৃত চরে অপার সৌন্দর্যে রিসোর্টগুলো (কুঁড়েঘর) নির্মাণ করা হয়েছে।
গ. হলিডে রিসোর্ট: সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরা এলাকার গ্রামের পথ পেরিয়ে পশ্চিম ইছাপুরা গ্রামে সাড়ে ৮ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে হলিডে রিসোর্ট। এই রিসোর্টটিও এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে আচ্ছন্ন।
৭. ইকোপার্ক
শিমুলিয়া-মাঝির হাট ঘাটকেন্দ্রিক হোটেল ব্যবসায়ী ও কয়েক হাজার কর্মজীবী মানুষ। সবার দুশ্চিন্তা ঘাট বন্ধ হলে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। এ জন্য সরকারের ঘোষণা মতো পদ্মার পাড়ে দ্রুত পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা। সেক্ষেত্রে পদ্মা নদীর তীরবর্তী শিমুলিয়ায় ইকোপার্ক নির্মাণে প্রকল্প হাতে নিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় রিভারক্রুজ (নদী ভ্রমণ), চরে অবকাশ যাপন কেন্দ্র, নৌ-জাদুঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তৈরি হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সেখানে বছরে ৬০ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম হবে- এমন প্রত্যাশা থেকে এই বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু আমাদের সাহসিকতার প্রতীক। পদ্মাসেতু আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক। বিশ্বাসের ভিত্তি। অনুপ্রেরণার শক্তি। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরই স্বপ্নের সেতু নয়, আমাদের মুন্সীগঞ্জসহ সারা দেশবাসীর স্বপ্নের সেতু। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আমাদের বড় অর্জন- আমরা পারি, আমরা পারব। জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটা অনেক বড় ব্যাপার!
লেখক: সাংবাদিক