প্রিয় বঙ্গবন্ধু
আপনাকে নিয়ে তেমন করে লিখি নি কখনো। আপনাকে নিয়ে লিখলে দলভূক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল,এখনো আছে। দলের বাইরে যেয়ে আমরা যেন এখন আর কিছু ভাবতে পারি না! যত দিন যাচ্ছে আমরা খুব বেশি আওয়ামী লীগ আর বিএনপিতে বিভাজিত হচ্ছি! মানুষ থাকছি না। বাংলাদেশের জন্য এখন খুব বেশি মানুষ প্রয়োজন!
কাদা মাটির গন্ধ মাখা এই বাংলার খুব প্রয়োজনীয় মানুষ ছিলেন আপনি। আমাদের সৌভাগ্য খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আপনাকে আমরা পেয়েছিলাম। আপনার সময়ে আমরা জন্মেছিলাম! সক্রেটিস বলতেন-নিজেকে জানো। ছোটকাল থেকেই আপনি আপনার সম্পর্কে জানতেন, সঠিক ধারনাই পোষণ করতেন! স্কুল পড়ুয়া আপনি সোহরাওয়ার্দীর সামনে দাঁড়িয়ে অবলীলায় বলতে পেরেছিলেন-স্কুলের ছাদ থেকে পানি পড়ে! ছোট্ট আপনার সাহস দেখে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুগ্ধ হয়েছিলেন, বলা যায় আপনার রাজনীতির শুরু সেখান থেকেই। বাংলাদেশের জন্য আপনার এই সাহসটা খুব দরকার ছিল!
সাহসী ছিলেন কলেজ জীবনেও। ভালো ফুটবল খেলতেন। ফুটবল টিমের সাথে আপনার ছবি দেখেও আমাদের চোখ আটকে যেত। মনে হতো বাংলাদেশের অনেকেই ফুটবল খেলতেন আপনার অনুপ্রেরণাতেই! বেঁচে থাকলে হয়ত বা বদলে যাওয়া সময়ের হাত ধরে একালের ক্রিকেটার সাকিব, তামিম, মুশফিক কিংবা মাশরাফিদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করতেন। জানি না ওদের বলতেন কিনা কলকাতার সেই ইসলামিয়া কলেজের স্মৃতির কথা। আপনার প্রিয় শিক্ষক সাইদুর রহমান (বিখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমানের বাবা) আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন সবাই একজনের খাবার খায় হোস্টেলে। তুমি কেন দুইজনেরটা খাবে? আপনি সাহস নিয়ে বলতে পেরেছিলেন আপনি অন্য সবার মত না। আপনি ব্যতিক্রম। ফুটবল খেলা ও বাড়তি পরিশ্রমের কারণে আপনার বাড়তি খাবার প্রয়োজন! সাইদুর রহমান স্যার সেটা মেনে নিযেছিলেন। স্বাধীনতার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখন ছিল জগন্নাথ কলেজ) যেয়ে আপনি নিজে স্যারের সাথে দেখা করেছিলেন। তার পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন। মানুষকে ভালোবাসা কিংবা মানুষের ভালোবাসার বাইরে আপনি যেতে চান নি। তাই স্বাধীনতার পরপর এক বিদেশী সাংবাদিক যখন জানতে চান আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী? আপনি তখন অবলীলায় বলতে পারেন-আমি বাংলার মানুষকে ভালোবাসি এটাই আমার বড় শক্তি! সেই সাংবাদিক যখন জানতে চান আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন-আমি বাংলার মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি!! সম্ভবত একারণেই গান লেখা হয়-ভালোবাসা বেশি হলে খুন হয়ে যেতে হয়!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেও আপনি তেমন ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের দাবী দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। পুরষ্কার স্বরূপ আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নটা ধুলিস্যাত হয়েছিল আপনার। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই সারা বাংলার মানুষকে সাথে নিয়ে আপনার নাম দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু! আপনার অনেক স্বপ্ন হয়ত ধুলিস্যাত হয়েছে আগে পরে,অথচ বাংলার মানুষের হাজার বছরের লালিত স্বপ্নটা আপনি এনে দিয়েছিলেন আমাদের হাতের মুঠোয়। যে যাই বলুক আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই বাংলার কোটি মানুষ আপনার জন্য প্রার্থনা করেছে, আপনার মুক্তির জন্য কোটি মানুষের কান্না সেদিন শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হয়ে গেলেও মানুষের আঙিনাতেই ছিল আপনার স্থায়ী ঠিকানা। এর মাঝে অল্প কিছুদিন, যখন আপনি টগবগে যুবক তখন কিছুদিন (যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর) মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তার আগেও আপনি জেলে গিয়েছেন, মন্ত্রীত্ব হারানোর পর আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা দেয়া হয়েছিল। আপনাকে আবারো জেলে যেতে হয়েছিল। পাকিস্তান জান্তার অনুগামী আদালত শুধু আপনাকে জেলে নিতে পেরেছিল.আর কিছু পারে নি। আপনি নিষ্পাপ হয়ে মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন! জীবন বাচাতে আপনাকে ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কাজ নিতে হয়েছিল। তবু মানুষের আঙিনা ছেড়ে কোথাও যান নি!
সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর। এই চব্বিশ বছরের পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস,পাকিস্তানি শাসকদের কাছে শোষিত হবার ইতিহাস। এই যন্ত্রণাকাতর সময়ে যখন একটি জাতি ক্রমশ তার স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে হাঁটছিল সে সময়ে ক্রমশ আপনি এদেশের মানুষের স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উঠছিলেন। পশ্চিমারা বাঙালির সমান ভয় পেত আপনাকে আর তাই চব্বিশ বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় আপনাকে তারা জেলে থাকতে বাধ্য করেছিল। আপনার পরিবারের প্রথম উত্সব আপনার বড় কন্যা শেখ হাসিনার বিয়ের সময়েও আপনি ছিলেন জেলে। বিয়ের পরপরই আপনার জামাতা ওয়াজেদ আলী মিঞা জেলে যখন আপনার সাথে দেখা করতে যান তখন জেলে জমা থাকা আপনার প্রিয় রোলেক্স ঘড়িটা খুলে দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে! আপনার পুরো জীবনটা এভাবে আপনি উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের!
তারপরও কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে আপনাকে নিয়ে যাকে বলা হচ্ছে মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। কোটি টাকা দামের এই প্রশ্ন আসলে আপনাকে ছোট করার জন্যই। আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল আপনি নাকি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশটাকে (পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন) স্বাধীন করতে চাচ্ছেন! সেই আপনার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ আনা হয় মূলত আপনার মৃত্যুর পরে, বলা হয় আপনি নাকি স্বাধীনতা চান নি, চেয়েছিলেন অখন্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে! কোটি টাকা দামের আরেক প্রশ্ন হচ্ছে কেন ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ আপনি গ্রেফতার বরণ করেছিলেন? কেন সামনে থেকে আপনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন নি? ছোট প্রশ্ন আরো আছে। মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল আপনি ভালো রাজনীতিবিদ ছিলেন, প্রশাসক ছিলেন না! মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল আপনার পরিবারের দুর্নীতির কারণেই নাকি আপনার এমন পরিণতি হয়েছিল! শেখ কামাল নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করেছিলেন। সোনার মুকুট পরিয়ে নাকি ছেলেদের বিয়ে দিয়েছিলেন! আপনার বাসা থেকে নাকি কোটি কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছিল!
শেক্সপীয়র বলেছিলেন কাউকে খুন করতে চাও তো বদনাম রটিয়ে দাও। খুনকে জাস্টিফাই করা সহজ হবে! আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবেই বদনাম রটানো হয়েছিল। গোয়েবলসিয় কায়দায় আপনাকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল আপনার মৃত্যুর পরে কেউ কাঁদে নি, কোনো প্রতিবাদ হয় নি। আপনাকে নৃশংসভাবে খুন করার পর মৃত আপনাকে নিয়েও ছিল খন্দকার মোশতাক (বাংলার মীরজাফর) কিংবা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানদের দারুণ ভয়। শুধুমাত্র আপনার মৃতদেহটাই তারা সবার সাথে বনানীতে কবর দিতে দেয় নি। আপনাকে কবর দেয়া হয়েছিল আপনার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়াতেই! মনে করা হয়েছিল আপাত দুর্গম এই এলাকায় কেউ আপনার জন্য সামান্য প্রার্থনাও করতে যাবে না! আইন করা হয়েছিল যেন আপনার হত্যাকা–ের কোন বিচার না হয়! যে দেশের স্বাধীনতার সমার্থক ছিলেন আপনি সেই দেশেই আপনার বিচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেউ কেউ ভেবেছিল আপনার হত্যাকান্ডের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। বিশ্বাসঘাতক আর সামরিক শাসকদের পথ ধরে হাটবে বাংলাদেশ।
আপনার মৃত্যুর পরে যতদিন গেছে তত বেশি উজ্জ্বল হয়েছেন আপনি। ছড়ানো বদনাম আর রাষ্ট্রীয় উপহাসের হাত ধরে হাঁটে নি মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করা যায় না সেটাও বুঝেছে তারা। ছায়ানটে ক্লাশ করা, আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আবাহনী ক্লাব প্রতিষ্ঠা কিংবা স্পন্দন শিল্প গোষ্ঠী তৈরি করার ভেতরেই বেঁচে আছেন শেখ কামাল। আপনার দুই ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের নামেও ফুটবল ক্লাব হয়েছে। আপনাকে পরিবারসহ হত্যা করার পর আপনার ৩২ নম্বরের বাসাটা লুট হয়েছিল। আপনার শত্রুরাও পরে আর আপনার বাসায় কোটি টাকা পাওয়ার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে নি। পাওয়া যায় নি কোন সোনার মুকুট!
আপনার মৃত্যুর পর ক্রমশ দেশি বিদেশী ষড়যন্ত্রের অনেক তথ্য আমরা জানতে পারি। বুঝতে পারি যারা আস্ফাালন করে বলেছিল উই কিল্ড শেখ মুজিব, (ফারুক, রশীদ, শাহরিয়ার, হুদা, নূর ও ডালিম গং) এই রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা তাদেরই মেনে নিয়েছিল। সে সময়কার নতজানু তিনবাহিনী প্রধান,আনসার বা বিডিআর প্রধানরা মোশতাকের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। অনেকেই বত্রিশ নম্বরে আপনার মৃতদেহ পরে থাকা অবস্থাতেই রাজনৈতিক ভোল পাল্টে মোশতাকের মন্ত্রী সভায় যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল! যারা তারপরও আপনাকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছিলেন , তাদের ভেতর জাতীয় চারনেতাকে মোশতাকের নির্দেশে জেলের ভেতরেই হত্যা করা হয়। অনেকে নিক্ষিপ্ত হন জেলে। কাদের সিদ্দীকিরা সশস্ত্র প্রতিবাদ করতে যেয়ে দেশছাড়া হন, অনেকেই নিহত হন সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে। তবু যারা বলে কেউ প্রতিবাদ করেনি,কেউ কাঁদে নি আপনার জন্য তারা আসলে আপনাকেই ভালোবাসেনি কখনো!
২৫ মার্চের কালো রাতে যদি আপনি গ্রেফতার বরণ না করতেন হয়ত আরো কয়েক লক্ষ লোকের প্রাণ যেত! আপনার বিশ্বাস ছিল, যে বিশ্বাসের বজ্রকন্ঠ আমরা শুনেছিলাম সাতই মার্চের ভাষণে,সেই বিশ্বাসের সূত্র ধরেই জাগবে মানুষ,বাংলাকে স্বাধীন না করে ফিরবে না! আপনার বিশ্বাসই জয়ী হয়েছিল। বিপরীতে আপনাকে পাকিস্তানের জেলে আটকে রাখা হয়েছিল,বিচারে ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল পাকিস্তান জান্তা, প্রস্তুত ছিল ফাঁসির মঞ্চও! শুধু আপনার অনুরোধ ছিল আপনার লাশটা যেন আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়!
নিয়তি এই যে শেষমেশ আপনাকে আপনার স্বপ্নের দেশেই হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পয়তাল্লিশ বছর পরেও জঙ্গী বা আইএস সিনড্রোমে ভুগছে বাংলাদেশ। দেশ যদি পৌছে যায় বিভেদের শেষ সীমানায়,দেশি বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে দেশটা যদি ক্রমশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া বা সিরিয়ার দিকেই হাঁটা শুরু করে,আমরা বিশ্বাস করি তখনও আপনি হয়ে উঠবেন আসল অনুপ্রেরণা দাতা। আমাদের কানে বাজবে সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা-আর আমি যদি আদেশ দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলবা। মনে রাখবা বাঙালিদের কেউ দাবায়ে রাখবার পারবে না!
মানুষ জাগবে ফের। নব্য পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের সামনে,মেশিন গান আর বোমা গ্রেনেডের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে একালের ফারুক আর তসলিমরা। বুলেট কিংবা গ্রেনেড ভালোবাসা বুকে নিয়ে পড়ে থাকবে নতুন কোনো মৌচাকের মোড়ে। গনগনে রোদের কোনো এক দুপুরে বুকের তাজারক্ত দিয়ে পীচঢালা রাস্তায় লিখে যাবে -জয় বাংলা! নতুন সেই মৌচাকের মোড়ে আমরা তাদের কবর দিয়ে আসবো পরম মমতায়!
তারপর কখনো কোনো এক শান্তির বিকেলে শেখ কামালের সেই কথাটাই মনে করব। কামাল দেখতেন তার বাবা বাসাতে থাকে না। তাকে জেলে থাকতে হয়। শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতেন। কামাল শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, বড় আপা তোমার বাবাকে একটু বাবা ডাকতে দেবে আমায়?
প্রিয়তম পিতা বাংলাদেশ ডাকছে আপনাকে। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
লেখক: লেখক, নাট্যকার ও কলামিস্ট, হেড অব প্রোগ্রাম বৈশাখী টেলিভিশন