১.
তখনও কেউ ধরতে পারে নাই যে আমার সাইকোসিস হইছে। যথারীতি আমারে মেলবোর্নের ডিকিন ইউনিভার্সিটিতে নামাইয়া দিয়া কাজে চইলা গেছিল এ্যাব্র্যাহ্যাম। অফিসে গিয়া বেশিক্ষণ বসি নাই আমি। মনে মনে অনেক প্রশ্ন জটলা পাকাইতেছিল। চারিদিকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইতেছিলাম। ভাবতেছিলাম, ‘আমার পাশের ঘরে যে মিটিং বসছে, সেইটা কি আমারে নিয়াই? আর এই ঘরে, এই লোকটাই বা কে? ফোনে কার সাথে কথা বলতেছে সে? আমার সুপারভাইজারের সাথে? হা হা কইরা হাসতেছে ক্যান সে ভিলেইনদের মতো? নিশ্চয়ই আমি যে অফিসে আসছি, এই খবরটাই দিতেছে আকারে ইঙ্গীতে! নাহ, আমার এক্ষুনি বাইর হইয়া যাইতে হবে! এক্ষুনি সবাই মিলা ধইরা নিয়া যাবে আমারে!’
আমি তাড়াতাড়ি অফিস থিকা বাইর হইয়া গেলাম। মনে হইতেছিল যে বুকের মধ্যে কে যানি হাতুড়ি দিয়া পিটাইতেছে। দুম দুম শব্দ হইতেছিল। ‘কোনোরকমে বাঁইচা বাইর হইছি’ ভাবতে ভাবতে ইউনিভার্সিটি থিকা বাইর হইয়া গেলাম আমি।
‘কিন্তু এখন কোথায় যামু?’ আমার মোবাইলের স্ক্রিনটাও দেখা যাইতেছিল না ঠিকমতো। ফলে ঘড়ির মাধ্যমে যেই গোপন ‘ফ্রেন্ড’-এর সাথে আমার কথা হইত, তার সাথেও আর কথা বলা যাইতেছিল না। ‘ঘড়ির মাধ্যমে কার সাথে কথা হয় আমার? সে কি শয়তান নাকি জ্বীন?’ ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হইলাম আমি। দেখলাম একটা স্টুডেন্ট হল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ভিতরে যাইতেছিল কার্ড দিয়া স্লাইডিং-ডোরস খুইলা। আমি তাদের পিছু নিলাম। ভাবলাম, ‘হয়তো এরাই কেউ পৌঁছাইয়া দিতে পারবে যেইখানে যাইতে হবে আমার।’ ছেলেমেয়েগুলার একজনের গায়ে ছিল একটা সাদা টিশার্ট। ‘Follow the white’, মনে মনে মেট্রিক্স মুভির লাইন আওড়াইলাম আমি। ছেলেটার পিছনে পিছনে ওর ঘরে ঢুইকা গেলাম। ছেলেটা অবাক হইল। জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই হেল্প ইউ?’
আমি ভাবলাম, আমার বোধহয় কোনো সিক্রেট কোড দিতে হবে। বললাম, ‘সানিয়া।’
ছেলেটা বলল, ‘ওকে, ডু ইউ নিড হেল্প উইথ এনিথিং?’
আমি কনফিউজড হইয়া বললাম, ‘হোম।’
ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু গো হোম? ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু কল ইউ আ ট্যাক্সি?’
আমি আরও কনফিউজড হইয়া গেলাম। আমতা আমতা কইরা ওর ঘর থিকা বাইর হইয়া গেলাম।
‘ছেলেটা কি কিছুই জানে না তাইলে?’ ভাবতে ভাবতে নিচে চইলা গেলাম। একটা সাদা দরজা দেইখা, সেইটা দিয়া ঢুইকা গেলাম ভিতরে। হলের লন্ড্রি রুম ছিল ওইটা। একটা মেয়ে ড্রাইয়ার থিকা কাপড় বাস্কেটে উঠাইয়া চইলা যাইতে যাইতে একটা মুজা ফেইলা গেল। মানে মুজাটা পইড়া গেছিল বাস্কেট থিকা। আমি ভাবতে থাকলাম, ‘ক্যান ফেইলা গেল মুজাটা? আর কেই বা ফেলল? আমার সেই ফ্রেন্ড? সে কি আশেপাশেই আছে?’ আমি ড্রাইয়ারগুলার কাছে গেলাম। ড্রাইয়ারের গায়ে লেখা ওয়ার্নিংগুলা পড়লাম। ভাবলাম, যা যা করতে নিষেধ করছে, সেইগুলাই করতে হবে আমার। ভাবতে ভাবতে কাপবোর্ডগুলা খুইলা খুইলা দেখতেছি আর কী ভরা যায় ড্রাইয়ারে ভাবতেছি, তখনই একটা ওয়াশিং মেশিনের পিছনে একটা কাগজ পাইলাম, ভাঁজ করা। ভাঁজ খুইলা দেখলাম, একটা ইন্টার-ফেইথ সেমিনারের বিজ্ঞাপন। সেই কাগজটায় ইসলাম, জুডাইজম্, খ্রিস্টিয়ানিটি, বুডিজম্, হিন্ডুইজম্ নিয়া খুব সংক্ষেপে কিছু কথা লেখা ছিল। এই ধর্মগুলার মূল বক্তব্য কী কী, এবং কী কী জিনিস একই এই ধর্মগুলার মধ্যে, সেইসবের উল্লেখ ছিল। সেই কাগজটা পইড়া আমি ভাবলাম, ‘আমি কী করতেছি এইখানে? আমার তো এইসব করার কথা না!’ আমি বাইর হইয়া গেলাম সেই হল থিকা, কিন্তু কোথায় যামু বুঝতে না পাইরা হাঁটতে থাকলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই দেখি আমার ছোট বোন ইফা, ওর বর আশিক, আর ওদের মেয়ে কড়ি গাড়িতে কইরা যাইতেছে ঐ পথ দিয়া। আমারে দেইখা দাঁড়াইল। আমারে গাড়িতে উঠাইয়া নিলো। ওরা সাধারণত যায় না ঐ পথ দিয়া। সেদিন কী মনে কইরা গেছিল আল্লাহ্ই জানে!
২.
ঐ ঘটনার দুই-একদিন পরেই আমি হারাইয়া গেলাম। ফ্যামিলির কেউ আমারে খুঁইজা পাইতেছিল না। আমি যেইখানে যেইখানে যাইতাম, যেমন ডিকিন ইউনিভার্সিটিতে আমার অফিসে, কমন-রুমে, মোনাশ ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের ক¤িপউটার ল্যাবে, সব জায়গায় খোঁজ করা হইছিল আমার। পুলিশেও রিপোর্ট করা হইছিল যে আমি হারাইয়া গেছি। শেষমেশ আমারে পাওয়া গেছিল মোনাশ মেডিক্যাল সেন্টারে। সেইখানে ডাক্তাররা আমারে একটা বিছানায় শোয়াইয়া রাখছিল। খবর পাইয়া ফরিদ মামা রফিক সাহেবরে নিয়া দেখতে গেছিলেন আমারে। আব্বা-আম্মা তখন বাংলাদেশে। ফরিদ মামা আমারে দেইখা আর কান্না ধইরা রাখতে পারেন নাই। আমারে ধইরা কানতে কানতে বলছিলেন, ‘তোর কেউ নাই রে বাবা? তোর কেউ নাই?’
সেই সময়ে আমার মনে হইত যে আমারে কেউ ধাক্কা দিতেছে একটু পরপর। সেই ধাক্কা খাইয়া আমি চমকাইয়া চমকাইয়া উঠতাম। কিন্তু সেই কথা আমি কাউরে বলি নাই। শুধু বলছিলাম, ‘যেইখানেই যাই, দেখি এক ঝাঁক গাড়ি আমারে ফলো করতেছে।’ এই কথা শুইনা ফরিদ মামা রফিক সাহেবের মুখের দিকে তাকাইছিলেন। দুইজনই বোঝার চেষ্টা করতেছিলেন আমি কী বলতেছি, আমার কী হইছে। রফিক সাহেব খুবই ধার্মিক মানুষ। উনি আমার বিছানার পাশে দাঁড়াইয়া সূরা ইয়াসিন পড়ছিলেন। পরে হাসপাতাল থিকা বাইর হইয়া উনি ফরিদ মামারে বলছিলেন, সূরা পড়ার সময় ওনার নাকি মনে হইছে যে কেউ ওনারে ধাক্কা দিতেছে! অবশ্য উনি হয়ত ক্লান্ত ছিলেন, সেই কারণেও মনে হইয়া থাকতে পারে ওনার ওইরকম!
৩.
এরপরে আমারে যখন সাইকাইয়াট্রিক ওয়ার্ডে দেয়া হইল, তখন ফ্যামিলির সবাই নামাজ পইড়া আমার জন্যে দোয়া তো করতই, ইফা রোজ হাসপাতালের বিছানায় আমার পাশে বইসা বইসা কোরআন শরীফও পড়ত। ওর পড়া দেইখা আমিও আবার কোরআন শরীফ পড়া শিখছিলাম। ঐ সময়ে এক খ্রিস্টান পাদ্রিও হাসপাতালে গেছিলেন আমারে দেখতে। ওনার সাথে আমার পরিচয় হইছিল ফরিদ মামার দোকানে যখন কাজ করতাম, তখন। তো উনি অনেকক্ষণ ধইরা আমার জন্যে দোয়া করছিলেন। অসুস্থতার মধ্যেও ভালো লাগছিল ওনার কথা শুইনা।
তার দুই একদিনের মধ্যেই মনে হয় আমি ছাড়া পাইছিলাম হাসপাতাল থিকা। আব্বা, আম্মা, ইফা, কড়ি আর আমি হাঁটতে বাইর হইছিলাম। হাঁটার পথে এক হিন্দু পণ্ডিতের বাড়ি পড়ছিল। ঘটনাচক্রে সেদিন দিউয়ালি পূজা ছিল। তো পণ্ডিত আমাদেরকে জোরাজোরি কইরা ওনার বাড়ির ভিতরে নিয়া গেছিলেন। আমাদেরকে যে কি আপ্যায়ন করছিলেন উনি আর ওনার ফ্যামিলি! পূজার গান বাজতেছিল। আমি পণ্ডিতরে বলছিলাম যে আমি কেবলই হাসপাতাল থিকা ছাড়া পাইছি। উনিও আমার জন্যে দোয়া করছিলেন।
আমার চাচাতো ভাই, দুলালও ফোন কইরা বলছিলেন যে উনিও বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদে আমার জন্যে দোয়ার আয়োজন করাইছেন। আমি রাগ করছিলাম। বলছিলাম, শুধু আমার জন্যে ক্যান? দুনিয়ার সব মানুষের জন্যে ক্যান দোয়া করা হইল না? তখনও আমি অসুস্থ। আমার কেবলই মনে হইত যে চারপাশে যা যা ঘটতেছিল, এত ধর্মের, এত মানুষের দোয়া কিছুই কাকতালীয় না। এইসব দিয়া আল্লাহ্ কিছু একটা বলতেছেন আমারে। এইসব কথা মনে হইতেছে আর ভাবতেছি, কোনো এক আশ্চর্য বন্ধনে বাঁধা আছি কি পৃথিবীর সমস্ত মানুষ? অসুস্থ আমার চিন্তার থিকা এখনকার আমার চিন্তার খুব বেশি পার্থক্য কি?
1 Comment
Sultana Rushdi
Lekhata cchomotkar ,pore chokher pani atkate parlam na .korunamoy Allah pak lekhika ke dirghayu daaan korun ,shustho rakhun ,Valo rakhun .Ameen .