গল্প বানিয়ে লেখার চেয়ে স্মৃতিকথা সহজ হয় আমার কাছে। ধূলিধূসরিত গাঁয়ের না ফুরনো পথ, দু পাশে অতীব দৃষ্টি মনোহর ও নজরকাড়া বিস্তীর্ণ সবুজ বা বাদামী রঙের মাঠ, মৌসুম ভেদে। গরু বা মোষের গাড়িতে চলছি। ও কি গাড়িয়াল ভাইয়ের সুর ভেসে আসাও আশ্চর্য কিছু নয়। বালকের কাছে মাইল দুয়েকের রাস্তাকেও তো মনে হয় অনেক দূর। ওই অপু যেমন রেল রাস্তা দেখিয়ে দূর্গাকে বলত, অনেক দূর! তাই না দিদি। বোন বলত, তুই একটা পাগল। দূর কোথায়? কিন্তু নিজেই হয়ত ভাবত আসলেই তো ওর পরে কি আছে? এক মজুর, মৌসুমী কৃষি শ্রমিক ট্রেনে চড়ে রানাঘাট থেকে আর কয়েকটা পরের স্টেশনে নেমে ভাবছে, কত দূরেই না চলে এলাম! সে গল্পে পরে যাচ্ছি। আর আমি এখন বাড়ি থেকে কত দূরে থাকি সে বেশ বুঝতে পারি।
মানুষের এই স্মরণ শক্তি, আমি আরেকবার লিখেছিলাম, এ এক অদ্ভূত সংরক্ষণশালা। আমরা যত বয়সই হোক না কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সারা জীবনটাকে কিন্তু রিওয়াইন্ড করে ফেলতে পারি মনে মনে। আপনি পরীক্ষা করুন, সব মনে আছে, যদি না আলঝেইমার থাকে। প্রার্থনা করি, এই রোগ কারও না হোক। আর অস্বস্তিকর হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো মনে আছেই কারণ মস্তিষ্কের স্মৃতিকণা এগুলো শক্তভাবে লিখে রাখে। আমরা সেটা মুছে ফেলতে বেশি চেষ্টা করি তো!
এখনকার দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। এই করোনার সময়ে আমাদের ভিক্টোরিয়ার পর্যটন জনপ্রিয় গ্রাম্পিয়ন্স পাহাড় এলাকার এক রেঁস্তোরার দুটো রোবট অতিথিদের অর্ডার বুঝে নিয়ে আবার সার্ভ করছে। খবরে দেখালো, পাঞ্জাবি মালিক রোবট দেখিয়ে বলছে বাচ্চারা খুব মজা পাচ্ছে, বড়রাও।
চাষীরা যাতে তাদের ট্রাকটরগুলো ড্রাইভার ছাড়া চালাতে পারে সে বিষয়ে গাড়ি কোম্পানগুলো কাজ করছে। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের বিস্তীর্ণ ধান চাষ বা অন্য রাজ্যের গমক্ষেতগুলোতে চাষাবাদ প্রণালী দেখলে মনে হবে এই কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্র বা ট্রাক বা মেশিনারিজ কতটা অটোমেটেড হতে পারে। খনি শিল্পে গবেষণার সময়ে দেখেছি পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থ শহর থেকে কয়েকশ’ বা হাজার মাইল উত্তরে দূরে খোলা লোহা খনিতে চালকছাড়া ট্রাক ও বাহন চালিয়ে সব কোম্পানিই তাদের উৎপাদন খরচ তিনগুণ কমিয়েছে। অটোমেশনই বলছে ভবিষ্যৎ। ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর পরিবর্তিত তরল ও অনেক জিনিস যা পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু রোবট দিয়ে সরিয়ে সেগুলো কমানোর চেষ্টা চলেছে। রোবট ছোট বাচ্চাদের যাতে ঘুম পাড়াতে পারে, যত্ন করতে পারে তারও কাজ চলছে। এমনকি রোবট কিছুটা রোমান্টিক বা জটিল প্রশ্নের উত্তরও যাতে দিতে পারে সেরকম বুদ্ধিমত্তা তৈরির গবেষণা হচ্ছে।
এতকিছুর পরও, আমার বা যে কারও মনে একটু ক্ষুদ্র কি চিন্তা হচ্ছে ও মুহূর্তে বদলাচ্ছে তা নিশ্চয়ই কোনো যন্ত্র ধরতে পারবে না। আরও কিছু অসম্ভব জিনিস বিজ্ঞান অদূর ভবিষ্যতে পারলেও অনেক কিছুই আয়ত্তের বাইরে থাকবে সবসময়। ওই যে ওরকম, ‘একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভইরা চলতে আছে’। এ বুদ্ধি অন্য কোথাও, অন্য জগতে। ভাব ও ভক্তিবাদী বাঙালী মরমী কবি ও শিল্পীদের মতো মেধাবী মানুষ ও তাদের দর্শন আর অন্য কোথাও পাব বা দেখব বলে মনে হয় না।
তখন কেবল পিএইচডির গবেষণা শুরু করেছি, প্রায় চব্বিশ বছর আগে। হোবার্ট তাসমানিয়া দ্বীপের রাজধানী, অসম্ভব সুন্দর ছোট একটা সবুজের, পাহাড়ের ও বন্দর শহর। দ্বি বার্ষিক বনশিল্প বিষয়ক সম্মেলনে যাওয়ার সুযোগ হলো প্রথম। পরে ক্রুজে আরেকবার গিয়েছি ও আদিবাসীদের নিয়ে আর্ট দেখেছি অতীত কেমন ছিল অস্ট্রেলিয়ায় অংকন চিত্রগুলোতে। বোরাল নামে একটা বড় অস্ট্রেলিয়া তথা এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ওই সম্মেলনেরও স্পন্সর। আমিও ওদের দেওয়া অর্থে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত স্কলার তখন। যারা বাড়িঘর তৈরি করেছে এখানে বা বাড়ি তৈরির শিল্প জানে, তারা জানবে বোরালের ইট, টালি, কাঠ, সিমেন্ট ও কংক্রিট ছাড়া তা বানানো সম্ভব নয়। আর স্টক মার্কেটেও তারা বড় কোম্পানি।
যাহোক অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় বা এএনইউ- বেশ নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বনবিদ্যা বিভাগ ছিল খ্যাতনামা। সেখানে একজন অধ্যাপক উপস্থাপন করলেন আমরা বৃক্ষরোপন ও আচ্ছাদন দিয়ে কিভাবে একটা শহরে নাগরিকদের সুস্থতার জন্য বাতাস, ছায়া ও সৌন্দর্য তথা মানসিক শান্তি দিতে পারি। আবার উদাহরণ দিচ্ছিলেন, তার প্রকৌশলী বিভাগের সহকর্মী অধ্যাপকের উদ্ধৃতি টেনে বলেছিলেন, এই যে শহরের গাছের ব্যবস্থাপনা একটা চ্যালেঞ্জ, কারণ ঘরবাড়ি ও বৈদ্যুতিক সঞ্চালনা লাইন, পাতা পড়ে ড্রেনেজ ব্লক ইত্যাদি আরও সমস্যা, কেন তারা বিকল্প ভাবছে না? তা বিকল্প কি? সারা শহরে কৃত্রিম গাছ লাগিয়ে দেবে, সুন্দর পাতা থাকবে, এমনকি শীতে ঝরে যাওয়ার ভান করে আবার গ্রীষ্মে সবুজ হবে, চাইলে অক্সিজেন স্প্রে করবে বাতাসে, স্ব-আলোকিত হওয়ার ব্যবস্থাও হতে পারে। এসব করা যাবে একটা সুইচের অন বা অফের মাধ্যমেই। তাই বলে এমন কৃত্রিম সমাধান সবসময় সব জায়গায় কতটুকু সঠিক সে অন্য কথা।
কৃত্রিম বনে শহরের মানুষের কি আর তখন প্রাণ থাকবে? মানুষের বুদ্ধিমত্তা আর অনুভূতি থাকাই যত সমস্যার মূল। আমরা দুঃখ, কষ্ট ও ব্যথা পাই, ভয়ানক বেদনায় কুঁকড়ে যাই যখন সেগুলো নিকটজনদের কাছ থেকে আসে, আশাহত হই। হয়ত ভুল মানুষের সঙ্গে হা হুতাশ করতে থাকি। আবার ঘুরে দাঁড়াই, সুখের সন্ধান করি, আবার হোঁচট খাই। এভাবেই মসৃণ পথ এবরোথেবরো হয়, তা বেয়ে সমান করে নিয়ে জীবনের রাস্তায় পরিভ্রমণ করি। দুর্দান্ত রেজিলিয়েন্স বা সহনশীলতা নিয়ে মিটমাট করে করে চলতে থাকি। মানে বুঝতে, কতজনের সাথে বোঝাপড়া করতে করতে ও শিখতে শিখতে একটা জীবন কেটে যায়। তবুও বেঁচে থাকার চরম আকুতি। সম্পদ, ধন, মান, বাড়ি, গাড়ি সংগ্রহ করতেই হবে, তা যে মত বা পথেরই হই না কেন। অথচ যার একটি হাত বা পা বা চোখ নেই বা বধির তার কাছে সুস্থ একজন মানুষই স্বপ্ন। মানুষের ধী শক্তি আছে বলেই সে শক্তিশালী প্রাণী ঐরাবতকেও পোষ মানিয়ে মাহুতের নাই মতো চলতে বাধ্য করে। কিন্তু মানুষ যখন বিবেকহারা হয় সারাক্ষণ খবরে দেখি সেও তো দু পায়ে চলা, তখন করুণা আর তাদের জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর কি করার আছে?
যাহোক, আবার ফিরে যাই সেই মধ্য দুপুরবেলা চারিপাশে লোকালয় বিহীন ফাঁকা রাস্তায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ আলকাতরা দেওয়া কাঠের চাকার শব্দের ছন্দে এক আশ্চর্য দুলুনিতে চলার আনন্দে। যে গাড়িচালক তার বাড়ির কাছেই, আত্মীয়ের বাড়ি যেখানে আমাদের গন্তব্য। এলাকাটার বর্ণনা একটু দেওয়া যাক যারা এই এলাকার লোক নয় তাদের জন্য। ১৮০৬ সালে মিশনারীদের একটা গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয় কার্পাসডাঙ্গা। এটা আমার কথা নয়, নদীয়া জেলার গেজেটিয়ারে কার্পাসডাঙ্গা সেকশনে ইংরেজরা যে সুন্দর বর্ণনা দিয়েছে, যে কেউ এখনও পড়তে পারেন। আমাদের হয়ত গলার জোর, বাড়িয়ে বলতে পারি কিন্তু ঐ সময়ে আমরা ভারতে বা বাংলায় বেশ যে অনুন্নত ছিলাম ইংরেজদের তুলনায় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডাকাত সর্দারেরা অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত ও বাংলার অনেক গ্রামীণ জনপদে আইন শৃংখলা ও নিয়ম কানুন বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বলা হয়েছে সাধারণ মানুষেরা ছিল নিরীহ প্রকৃতির, গ্যাং লিডার ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ করে টেকা সহজ নয়। ইংরেজের শাসন তা কিছুটা নিয়মে এনেছিল। ওসব দস্যুবৃত্তি এখনও হয়ত আছে তবে সময়ের নিরিখে মানুষের সচেতনতা ও অধিকারবোধ বেড়েছে। আরও উন্নতি হবে শিক্ষার বিস্তার বাড়লে। জেলাশহর পর্যায়ে একজন বা কিছু মানুষ, পদ বা সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাব আরও কমবে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। কাজের কারণে সমাজে ভেদ ও সম্মান প্রাপ্তি যা এখনও আছে, তা পাশ্চাত্যের সমাজের মতো প্রায় বিলুপ্ত হবে। এখানে সামাজিক সম্মান ও কাজের পরিচয়ে কোনো সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এসব দেশে আইন ও নিয়ম সবার জন্যই সমান। তাই হবে আমাদের দেশেও।
বিলের পানি নিয়ন্ত্রণ করতে একটা ছোট সাঁকোয় খাল পার হলাম। ফকিরের খাল কেন নাম তা জানিনে তবে প্রচলিত ছিল বন্যার সময় এই বাধ ভাঙলে অনেক গায়েঁর মানুষ হতদরিদ্র বা ফকির হয়ে যাবে। তারপর বাটকেমারি, আমার স্মৃতিতে একটা বটগাছ থাকলেও নদীয়া জেলার ইতিহাসের পাতায় সে জায়গাটির নাম আছে। একটা রাস্তা কানাইডাঙ্গা ও ছাতিমতলার দিকে ও আরেকটি চন্দ্রবাস যাবে। গাঁয়ের নামগুলোতে বোঝা যায় এসব জায়গায় মিশ্র ধর্মের মানুষের বাস ছিল। এটি এখন গুগল ম্যাপে দর্শনা মুজিবনগর সড়ক বা আর-সেভেন ফোর নাইন জাতীয় সড়ক নামে দেখাবে।
আমার মাতামহীর ভ্রাতা ওই চন্দ্রবাস গ্রামের বাসিন্দা, আমার নানীর সাথে যার বাড়ি আমাদের গন্তব্য। আমার ওই নানা অতীতে নদীয়া এস্টেটের জমিদার নফর চন্দ্রপাল চৌধুরীর ওখানে গোমস্তার কাজ করতেন শুনেছি। নাটুদহে নফর পাল চৌধুরীর জমিদার বাড়ি পুকুর ঘেরা উচুঁ নারিকেল গাছের সারি, অনেক আম ও লিচু বাগানের কথা মনে আছে এখনও। নাটুদহ স্কুল ও ডিসপেনসারির কথা নদীয়া গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে। জমিদারিটি সে সময় শিবনগরের বৃহৎ এলাকা জুড়ে বিভিন্ন ফলের বাগান তৈরি করে। বাগানের প্রবেশ পথের দুই পাশে সারিবদ্ধ করে শত শত তালগাছও লাগানো হয়। ওই পথে যেতে সেই তালসারিটিও চোখে পড়বে। তখন এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো কেমন যেন ম্যাজিক্যাল একটা এলাকা মনে হতো সেসব নির্জন স্তব্ধ গ্রীষ্মের দুপুরের খাঁ খাঁ মাঠ। এখন শুনেছি সরকারি উদ্যোগে সেখানে ইকোপার্ক তৈরি হয়েছে।
যে মূল বিষয়টি নিয়ে শুরু করেছিলাম তা হলো গাড়ির চালক বাধা মাইনের শ্রম দিত আমার মামার বাড়িতে। কালো রঙের বিশের কোঠায় যুবক, সুঠাম বলিষ্ঠ দেহ, পাশেই মহাজনপুর গ্রামের। ওই যুবকের বর্ণনা জানতে হবে জসিমউদ্দীনের ‘রুপাই’ কবিতার রুপাকে দিয়ে। অথবা পল্লীকবির ধর্ম, সমাজ, প্রেম, মানুষত্ব, আনন্দ, বেদনা আর হাহাকারের উপন্যাস ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পড়ে। সোজন বাদিয়ার ঘাটে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধানোর চেয়ে বড় অপরাধ ছিল ছেলে ও মেয়েটির ভালোবাসা। আমাদের সমাজে ওই সময়ের প্রক্ষেপণে আমাদের সাহিত্যিকগণের তুলনা নেই। আবার এসব পড়ানো উচিত এখনকার ছেলেমেয়েদের।
সে নানীকে নানীর ভাইয়ের বাড়িতে রেখে আমাকে নিয়ে পায়ে হেঁটে তার গ্রামে নিয়ে গেল। মাঠের ফসলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা সরু পথ। মুগের বা মটরশুঁটির লতা ছোট্ট পা দুটি হয়ত কোথাও কোথাও জড়িয়ে ধরছে। যখন পৌঁছালাম, তাদের বাড়িতে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর, মাটিতে খেজুরপাতার বিছানা পাতা। মধ্যবয়সী মা ছাড়া তার আর আর কেউ নেই ওই বাড়িতে। অপ্রত্যাশিত একমাত্র বুকের ধনের আগমনে তাকে পেয়ে মায়ের কি যে তার উচ্ছ্বাস! সাথে সাথে মাটির চুলায় রান্না চাপালো। পোড়া মাটির থালায়, ও টিনের গ্লাসে পানি। আমি বেশ ছোট, তবুও সেই গরম গরম পাতলা ঝোলের টাটকা দেশী পটল, সজনেডাঁটা ও সবজির তরকারির স্বাদ মুখে লেগে আছে এখনও। প্রায়ান্ধকারে গা ছমছম করা ভয় নিয়ে আম, জাম, লিচু বাগানের ভেতর দিয়ে ফিরেছিলাম। তখন এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ নয়।
মায়ের এই যে বিশ্বজনীন আকুতি সন্তানের জন্য আরেকবার দেখেছি অন্য দেশে অন্য জাতে। আমি তখন নবীন গবেষক নিউজিল্যান্ডে, আমার সহকর্মী গবেষক মধ্যবয়সী, কাওরাও কাগজকলের মিটিং সেরে আসার পথে ছোট টকোরোয়া শহরে কোনো পূর্ব জানান দেওয়া ছাড়াই দরজায় কড়া নাড়লাম আমরা। ইয়ানের বৃদ্ধা মায়ের হাসি আমি জীবনেও ভুলব না। সেকি তাড়াহুড়ো তার! তিনি ভেবেছিলেন যিহোভাহ উইটনেসের কেউ। যিহোভাহ উইটনেসের ভলান্টিয়াররা এসব দেশে খৃস্ট ধর্ম প্রচার করে বেড়ায় অনেকটা আমাদের তাবলীগের সদস্যদের মতো দরজায় কড়া নেড়ে। তিনি আমাদের পরম মমতায় খাওয়ালেন। নিজের পিতামাতা ও আত্মীয় পরিবার থেকে অনেক অনেক দূরে করোনাকালেও অনিশ্চিত একটা অবস্থার মধ্যে সে আবেগ ও অনুভূতি মর্মে মর্মে যাপন করছি।
নদীয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমার জনসংখ্যা সেই ১৯০০ সালে ছিল মাত্র আড়াই লাখ। এখন তা একশ’ বছরের ব্যবধানে পাঁচগুণ হয়ত বেড়েছে। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ যে কমেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশের অবনতির একটা নির্দেশক ওই রাস্তার ধারে ধারে এখন ইটভাটার সংখ্যা গুণলেই হবে। অনেকের পাকা বাড়ি হয়েছে। কিন্তু যে অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে যে কোনো নগর বা গ্রামীণ পরিকল্পনাবিদের মাথাব্যথার কারণ হবে। স্য়ুারেজ ব্যবস্থা শূন্য বলতে হবে। আগের দিনের ও নতুন অসংখ্য পায়খানাগুলো থেকে ভারি ধাতুর দূষণ ও তা ভূগর্ভস্থ পানিতে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ কেবল পূর্ব বা পশ্চিম কিংবা সারা বাংলার শুধু নয়, ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র।
এখন চিন্তা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদি অনেক মানুষ বাস্তুহারা হয় তাদের কি হবে? প্রশ্ন ২০৫০ সালে আদৌ রাজনৈতিক সীমানা ও বর্ডার নিয়ন্ত্রণ কতটুকু কার্যকর রাখা যাবে। এখনই নিয়মতান্ত্রিক ভাবে মানুষের অভিবাসন ও ডেমোগ্রাফি যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, পরবর্তী পঞ্চাশ বছর নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করা ভারি কষ্টকর। উন্নত দেশে মানুষ ও জন্মহার ও কম। এশিয়ায় দেশগুলোতে অন্তত মানুষের অভাব নেই। এটা এসব দেশের বড় বোঝা আবার অন্যভাবে দেখলে মহাসুযোগ। কোনটা ও কিভাবে তা নেওয়া উচিত, প্রশ্ন সেটাই। শিক্ষা কি অস্ত্র হতে পারে?
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া থেকে