আমার বয়স তখন পনের কি ষোল। হঠাৎ করে কি হলো, আমাদের বাড়ির পাশের বাড়ি একটি মেয়ে। নাম তার বাহার। গ্রামের সবুজ ক্ষেতের আল পথে এলো চুল দোলানো মেয়ে সে। ওর মা বিশ্ব সংসারে ওকে একা করে দিয়ে পটল তুললেন। তিনি তো পটল তুলতে চলেই গেলেন। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল বাহার কে ঘিরে। কারণ ওর মা মারা যাওয়ার সময় ওর বয়স ছিল দশ কি এগার। আমরা সমবয়সী। এই ইহ জগৎ জটিলতা বোঝার আগেই তার জীবন দূর্বিষহ যন্ত্রণায় ভরে গেল। যে জীবন আনন্দের, যে জীবন পাখির, ফড়িং এর সে জীবন আর তার রইল না। মা বেঁচে থাকতে বাপের খুব আদরের মেয়ে ছিল বাহার।
বাহারের রূপের বাহারের অন্ত ছিল না। দেখতে শ্যামবর্ণ, ঝরঝরে লম্বা চুল একেবারে পিঠ পর্যন্ত। লম্বা, পরিপুষ্ট মেয়েটির বড় বড় চোখের ঢলঢল চাহুনি যেন পৃথিবীর সমস্ত মায়া জড়ো করে বিধাতা সৃষ্টি করেছেন। দশ বছর বয়সেই সমস্ত লাবন্য, লালিত্য, যৌবনের কঠিন-কোমল পরিপূর্ণতা দেখা দিতে শুরু করেছে। একখ- হীরের মতো চারদিক থেকে সৌন্দর্য শরীর জুড়ে ঢেউ তুলতে শুরু করেছে। তার স্বভাব অনেকটা বর্ণচোরা আমের মতো। কিছু আম যেমন উপরে সবুজ কাঁচা কিন্তু ভেতরটা সুমিষ্ট তেমন মেয়েই বাহার। উপরে উপরে মেয়েটি শান্তশিষ্ট হলেও ভেতরে ভেতরে ছিল খুবই চঞ্চল এবং বন্যচারী স্বভাবের। এজন্য পাড়াময় তার দুর্নাম কম ছিল না। কলিকাল বলে কত দিন কত জন তার বাপের কাছে নালিশও করেছে।
একদিন বাহারের পাড়া স¤পর্কিত কাকিমা বাহারের বাবাকে ডেকে বলল, মেয়ে বড় হচ্ছে এ সময় বন জঙ্গলে ঘুরে তাল, বেল, বরই কুড়ানো শোভা পায় না।
বাহারের মা বাপ এগুলো কানে তুললেও খুব বেশি বকাঝকা করতেন এমনটা কখনো দেখি নি। পাছে মেয়ে যদি গোস্বা করে এই ভয়ে। বাবার বড় আদরের মেয়ে কিনা তাই।
খুব অবাক হলাম যখন দেখলাম তার মায়ের মৃত্যুর এক মাস যেতে না যেতেই বাপের ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবে যেতে শুরু করল। তখন বসন্তের বাতাস মজনু মিঞার মন-প্রাণে হাওয়া দিতে শুরু করেছে। উঞ্চ নিশীথের চন্দ্রালোক যখন তার বেড়ার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করে তখন ফলগুধারার ন্যায় কল্পনার আকাশ থেকে বৃষ্টির ধারা ঝরতে থাকে। মৃত স্ত্রীর জন্য শোক করা তো দূরে থাক, স্ত্রীর মৃত্যু তার জন্য আশির্বাদ হয়ে জীবনে এল। কতদিন আর একা থাকা যায়। কিন্তু কি করে বলবে বিয়ের কথা। তাও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কথাটা তার বড় ভাবিকে বলেই ফেলল। এটাও জানালো ভাবি স্ত্রীকে সে মনে মনে ঠিকও করে ফেলেছে। ওই পাড়ার নফেল মোল্যার বিধবা মেয়ে জাহেদাই হবে তার দ্বিতীয় স্ত্রী। মজুন যেন এটার জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল।
আগের স্বামী জাাহেদার বিয়ের ছয় মাস পর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকে বাপের বাড়িতেই আছে সে গ্রাম স¤পর্কে সে মজনুর চাচাত বোন । সুঢৌল, নিটোল গড়ন-গাড়নের জাহেদাকে তার আগে থেকেই মনে ধরেছিল। স্ত্রী মারা যাওয়ায় মজনুর মনস্কামনা পূরণ হতে যাচ্ছে ভেবে মনের ভেতর কেমন একটা গদগদ ভাব। বৃষ্টিবিহীন তরুলতা যেমন বৃষ্টি পেলে হঠাৎ বেড়ে ওঠে তেমনি মজনুর স্ত্রীর মৃত্যুতে দ্বিতীয় বিয়ের ভাবনাটা চারাগাছ থেকে যেন মহীরূহ রূপ ধারণ করল। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না মজনুকে। যে কথা সেই কাজ, লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত বৌ ঘরে এনে তুলল মজনু মিঞা।
সৎ মা ঘরে প্রবেশ করলে প্রথমে খুব খুশিই হয়েছিল বাহার। মায়ের কাছে যে ছিল সব থেকে দামি সোনার পুতলি। মা মারা যাওয়ার পরে সেই পুতলির সোনা তামায় পরিণত হলো। যেই লাবণ্য লালিত্য তার শরীরে দেখেছিলাম তা আর অবশেষ রইল না। কচি মন, মা মারা যাওয়ার পর কেউ ভালোবেসে আদর করে ভাত খাইয়ে দেয় নি কতদিন। বাপও আর আগের মতো খোঁজ খবর রাখে না। বাবা নামক সে প্রাণীটি দ্বিতীয় বিয়ের তোড়জোড় নিয়ে ব্যস্ত, সময় কই যে খবর নেবে?
‘মা মারা গেলে বাপ হয় তালই’, গ্রাম বাংলার এই প্রবাদ সত্যি হয়ে এল চির দুঃখী বাহারের ক্ষেত্রে।
বিয়ের ছয় মাস যেতে না যেতেই মেয়েটি নিজের জায়গা বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল এ নশ্বর জগতে সে একটা অচল পয়সা মাত্র। তাই তো একটু সহানুভূতি পাওয়ার আশায় মুখ লুকিয়ে বেড়াত ভিড়ের মাঝে। এপাড়া ওপাড়া বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। গ্রামের আঁটকুড়ে আইয়ুব আলী। যার কোনো সন্তান সন্ততি নেই। সন্তানের জন্য দরগায় সিন্নি মানলো। মাজারে মাজারে কত মানত করল। কুদ্দুছ হুজুরের তাবিজ গলায় ঝোলাল কিন্তু সন্তান আর হলো না। আইয়ুব আলীর স্ত্রী ছমিরন খুব ভালোবাসতো বাহারকে। নিজের সন্তানতুল্য মনে করত। মাঝে মাঝে ডেকে কাছে বসিয়ে খাওয়াত। টুকটাক গল্পসল্পও হতো।
বন্যচারী স্বভাবের বাহার মা হারিয়ে আরো বন্যচারী হয়ে উঠেছিল। তাকে মাঝে মাঝেই দেখতাম কেমন আনমনা হয়ে থাকতে। মায়ের জায়গাটি দখল করেছিল তার চারপাশের প্রকৃতি। সারা দিন বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আম, তাল, বেল কুড়িয়ে পরম আনন্দ খুঁজে নিতো সে। রাতের বেলা লম্বা বাঁশের পাতার ক¤পমান পাতার অন্তরালে একটা গোলগাল শুভ্র রুটির মতো চাঁদ উঠত। চাঁদের পানে তাকিয়ে খুঁজে ফিরত তার হারিয়ে যাওয়া মাকে।
অবশ্য ওর স্বভাবে দুরন্তপনা ছিল বরাবরই। এমনিতেই প্রকৃতিচারী, বন্যচারী তার ওপরে মা চলে যাওয়ার পর, বৈমাত্রেয়ের চোখ রাঙানি তাকে আরো বন্যচারী করে তুলেছিল। সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড়, পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে পড়েছে যে ঝর্ণাধারা, খরস্রোতা নদী, নীল আকাশ, সবুজ মাঠ এমন নিসর্গের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে না দিয়ে তার উপায় ছিল না। এর জন্য কত কটু কথা যে শুনতে হতো তাকে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
একদিন বাপ ধমক দিয়ে বলল, সারা দিন টইটই করে কোথায় ঘুরে বেড়াস। একটু মায়ের সাথে কাজ কামে হাত লাগাইতে তো পারিস্।
প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে নি বাহার। শুধু তাকিয়ে ছিল বাপের দিকে। এই বাপকে তো সে চেনে না। বড্ড অচেনা মনে হয়। যেন হাজার বছরের অচেনা কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে। সেই মায়াবী চাহুনির মাঝে কত যে অভিমান লুকিয়ে ছিল তা মজনুর এখন জানবার কথা নয়। মজনু তার নতুন স্ত্রীর প্রেমে গদগদ। একেবারে নব্য কপোত-কপোতী। তাই মেয়ের বিরুদ্ধে করা বৈমাত্রের সকল নালিশই বিশ্বাস করত। সে অনুযায়ী ভর্ৎসনা করতে ছাড়ত না মেয়েকে। সারাদিন পর সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরত তখনই নেমে আসত তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন। ছোট্ট বুকে কত ব্যথা যে লুকিয়ে রেখেছিল তার হিসেব রাখা দুঃসাধ্য।
এভাবেই চলছিল তার দিনগুলো। মা বেঁচে থাকলে তার জীবন হয়ত অন্য রকম হতে পারত। লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখলাম। তার সৎ মায়ের ঘর আলো করে একটি পুত্র সন্তান এল। যে দিন ছেলেটির জন্ম হল সেদিন তার বাবার আনন্দ আর ধরে না। কি যে খুশি, কত আদর যতœ নতুন মায়ের। শুধু এক জনের মনেই আনন্দ ছিল না সে হলো বাহার। কারণ সে এখন এই কয়েক বছরের ব্যবধানে অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। তার মাকে মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে অনেক, শারীরিক এবং মানুষিক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। বিষয়টি এমন ছিল যে, পুত্র সন্তান, ছেলের হাতের মোয়া চাইলেই বাহারের মা ছেলে সন্তান জন্ম দিতে পারত।
কত দিন বলতে শুনেছি বাহারের বাবাকে, আসলে তুই অলক্ষ্মী, অপয়া, নইলে কি পোলা না অইয়্যা তোর পেট তন ম্যায়া জন্মায়?
আহা বেচারী! মরণ তার হাড় জুড়িয়েছে। অযতœ অবহেলা মেয়ে জন্ম দেয়ার অপরাধবোধ থেকে কি মরণ ব্যাধি শরীরে বাসা বেঁধেছিল যা তাকে এ নশ্বর জগৎ থেকে টেনে নিয়ে গেল অসীমের পানে।
এমনি করে একদিন শৈশব পার করে কৈশোরে পা দিল বাহার। তার বয়স যখন ষোল। জীবনে ফাগুন আসার আগেই যে আগুন লেগেছিল, সে আগুন আরো দ্বিগুন হয়ে জ্বলল।
বাহারের মা একদিন মজনুকে বলল, ম্যায়া ডাঙ্গোর অইছে। এমনিতেও মায়ের মতো পাড়াবেড়ানি। কখন কোথায় কি ঘটায় তার ঠিক নাই। বসাই বসাই নবাবজাদিরে আর কত খাওয়াবা? বিয়ে সাদি দিতে হবে তো নাকি?
বৌয়ের কথা অনুযায়ী কোথা থেকে একটা ছেলে ধরে বিয়ে দিয়ে মজনু হাফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ বাহারই যে মজনু-জাহেদার নতুন সংসারে এক মাত্র গলার কাঁটা। বাহার ঘোমটা পরে কাজল বধূ সেজে দূরের কোনো গ্রামে চলে গেল। আকাশে ডানা মেলা উড়ে বেড়ানো পাখি শিকারীর খাচায় বন্দী হলে যে অবস্থা হয়। বাহারের অবস্থা হলো তাই। ছটফটিয়ে মরলেও খবর নিত না কেউ। শুনেছি সেখানে তারা কেউ বাহারকে ভালবাসতো না। যৌতুকের জন্য খুব মারধোর করত মাঝে মাঝেই।
পরগাছা স্বর্ণলতিকাকে গোড়া থেকে কেটে দিলে যে অবস্থা হয়, ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় তারপর শুধু অবশিষ্ট থাকে লতিকার মৃত কঙ্কাল তেমনি অবস্থা হলো বাহারের।
কিছুদিন পর খবর এল। ভবলীলা সাঙ্গ করে, শ্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে মায়ের কাছে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে বাহার। বসন্তের দখিন সমীরণ বইতে শুরু করলে অপেক্ষাকৃত রোগা পাতা গুলো যেমন অকালে ঝরে পড়ে তেমনি ঝরে পড়লো বাহার।
কে জানে সেখানে কোনো অবহেলা আছে কি-না!