একজন ধর্মযাজক হিসেবেই উইলিয়াম কেরি বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। আর সেবছরই প্রবর্তিত হয়েছিল কর্নওআলিসীয় কুখ্যাত ভূমিব্যবস্থা যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। যাজকবৃত্তির কারণে এদেশে এসেও বাংলা ভাষা শিক্ষা, সংস্কৃত ও মারাঠা ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে কেরির সৃজনশীল মনন এবং আন্তরিকতা কেরিকে নিছক ধর্মপ্রচারের সংকীর্ণ সীমাক্ষেত্রে আবদ্ধ রাখতে পারে নি। তিনি বিশেষত বাংলা ভাষা চর্চা এবং তার প্রসারের চিন্তাশ্রয়িতায় যে অসামান্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অকৃত্রিম বন্ধু এবং বাংলা ভাষা ও গদ্যের আদি নির্মাতার ভগীরথ হয়ে উঠেছিলেন। ১৭৯৩ থেকে পরবর্তী দীর্ঘ একচল্লিশটি কর্মব্যস্ত বছর তিনি বাংলাদেশেই কাটিয়েছিলেন।
কেরির মৃত্যুর (১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ) মাত্র ছ’বছর পর ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আসেন আর একজন বিদেশি ধর্মপ্রচারক, নির্দিষ্ট করে বললে, খ্রিস্টান পাদ্রি যাঁর নাম জেমস্ লঙ্। তিনি পাদ্রি লঙ্ নামেই বেশি পরিচিত। ইংল্যান্ডের চার্চ অব মিশনারি সোসাইটির যাজক হিসেবেই তিনি কলকাতায় আসেন ১৮৪০-এ যখন তাঁর বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর। কলকাতায় আসার অনতিকাল পরে তিনি ঠাকুরপুকুরে বসবাস করতে শুরু করেন। ঠাকুরপুকুর তখন গ্রাম। সেই গ্রামেই লঙের মিশনারি কাজকর্ম শুরু হয়। এখান থেকেই তিনি তাঁর প্রচারক বৃত্তির লক্ষ্যে মফস্বলের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতেন। এইসব অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের উন্নতি কীভাবে সম্ভব সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। এই যাতায়াতের প্রক্রিয়ায় তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে নীলচাষিদের শোচনীয় জীবনাচরণ প্রত্যক্ষ করেন এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হন। কিন্তু নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত হয়েও তিনি সরাসরি তাঁদের বিরোধিতার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এদেশে শাসনক্ষমতায় আসীন বিদেশি ইংরেজরা লঙের স্বজাতীয়, স্বগোত্রীয়। তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ব্রতচর্চায় বাংলাদেশে আসেন। এদেশের গরিব মানুষজনের সান্নিধ্যে এসে তাঁদের বন্ধু হওয়ার মধ্যে দিয়ে ধর্মপ্রচারের মিশনই ছিল তার প্রথাগত কাজ। শ্রেণিগতভাবে তিনি এদেশে বিদেশি শাসকদের বন্ধু, মুক্তাকারী। এ বিষয়টি লঙ্ যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই বিবেচনা করেছিলেন।
সবদিক চিন্তাভাবনা করে লঙ্ তাঁর পূর্বসূরী উইলিয়াম কেরির প্রদর্শিত পথের অনুসারী হন। তিনি বাংলা ভাষা শিক্ষা শুরু করেন এবং কয়েক বছরের অনলস প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনে সমর্থ হন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় মিশনারিদের (ইংল্যান্ডের চার্চ অব মিশনারি সোসাইটির) বাংলা মুখপত্র ‘সত্যার্ণব’ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত হয় জুলাই মাসে। প্রসঙ্গত স্মরণ থাকতে পারে যে এদেশে মিশনারিদের হিন্দু ধর্মবিরোধী বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য এবং খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কারণে যথাসময়ে প্রকাশিত বাংলা পত্রপত্রিকায় এর বিরোধিতা প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘সম্বাদ প্রভাকর’-এ লিখেছিলেন:
‘আমরা বিপুল বিলাপ সাগরে নিমগ্ন হইয়া বলিতেছি সংপ্রতি ওলাউঠার হেঙ্গামা অপেক্ষা ‘ঈশু খ্রীষ্টী’ (অর্থাৎ যিশুখ্রিস্ট) হেঙ্গামা অতিশয় প্রবল হইয়া উঠিল…’
উমেশচন্দ্র সরকারের ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় দেবেন্দ্রীয় ব্রাহ্মধর্মের মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী‘তে লেখা হয় যে, খ্রিস্টানেরা আমাদের দেশের বুকের ওপর উঠে চোখ ঠোকরানোর মতো আমাদের ধর্মনাশের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে। সুতরাং ভয় পরিহার করে। ভারতবর্ষকে রক্ষা করার আহ্বান রাখা হয়েছে ‘তত্ত্ববোধিনী’-তে। এসব বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদ জানানোর লক্ষ্যেই ‘সত্যার্ণব’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইংলণ্ডের চার্চ অব মিশনারি সোসাইটির কলকাতা শাখার তরফে, আর পাদ্রি লগ্ন এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যার ‘উপক্রমণিকা’য় লেখা হয় ‘উক্ত পত্রের’ (অর্থাৎ ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘তত্ত্ববোধিনী’ প্রভৃতি) সম্পাদকেরা প্রায় সবাই ‘খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধ বিপক্ষ’। এঁরা সুযোগ পেলেই খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে সত্যাসত্য নির্বিশেষে ‘সারক্ষেপ’ করে থাকেন, যা মনে হয় তাইই লেখেন। স্বভাবতই এই সত্যাসত্য নির্বিশেষে যা মনে হয় তাই লেখার বিরুদ্ধে এবং খ্রিস্টধর্মের বিপক্ষতার বিরুদ্ধে কলম ধরতেই ‘সত্যার্ণব’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পত্রিকার নামটি সবিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ‘সত্যার্ণব’ পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায় লেখা হয়:
‘খ্রীষ্টিয় ধর্ম্মের প্রভাবে নারীগণের অবস্থা শোষন হইয়াছে। হিন্দু মোসলমান লোকেরা আপনারদের অজনাদিগকে দাসীর ন্যায় গৃহ শিক্ষরে বন্ধ রাখে। যদি কখন কোন স্ত্রী নিম্ন পুরুষের অনভিমত কার্যা করে তবে পুরুষ আর এক জনকে বিবাহ করিয়া তাহাকে শাস্তি দেয়। কিন্তু খ্রীষ্টীয় ধর্মের শাসনে এইরাপ অত্যাচার হইবার সম্ভাবনা নাই….সুতরাং স্ত্রী লোকের প্রতি কেহ নিষ্ঠুরাচরণ করিতে পারে না।’
বাস্তবিক পাদ্রি লঙ্ এভাবেই ‘সত্যার্ণব’ এর মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। ‘সত্যার্ণব’ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। মাত্র পাঁচ বছর প্রকাশিত হওয়ার পর এর প্রকাশ রহিত হয়।
‘সত্যার্ণব’ প্রকাশের আগে লঙ্ চার্চ অব ইংল্যান্ডের অধীনে এদেশে বিভিন্ন যাজক সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচার এবং জনহিতকর কাজকর্মের এবং সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে রীতিমত গবেষণা করে প্রকাশ করেন ‘আ হ্যান্ডবুক অব বেঙ্গল মিশনস….’। এই বইটির সাফল্য লেখককে আরও অনুসন্ধানমূলক কাজে উৎসাহিত করে। মনে রাখা দরকার লঙ্রে এধরনের কাজগুলির জন্য লঙ্ প্রথমদিকে সরকারি আনুকূল্য না পেলেও, পরবর্তীকালে সরকার যখন উপলব্ধি করে যে এসব কাজের মাধ্যমে সরকারেরই সুবিধে হচ্ছে, তখন সরকারের তরফে লড়কে নানারকমভাবে আনুকূল্য দেওয়া শুরু হয়।
এরপর লঙ্ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন । তিনি কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক প্যারীচাঁদ মিত্রকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন:
‘কলকাতা, আগরপাড়া, বর্ধমান, কৃষ্ণনগর, রতনপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ইংরেজি গ্রন্থাগার আছে। এছাড়া ঠাকুরপুকুর, সোনো, চাপড়া, বল্লভপুর ও কাপাসডাঙায় বাঙলা বইয়ের পাঠাগার আছে। কলকাতার বাঙলা বইয়ের পাঠাগারে ছ’শ বই ও পত্রপত্রিকা সংগৃহীত হয়েছে। যখনই নতুন বই প্রকাশিত হয় তা কিনে ঐসব পাঠাগারে পাঠানো হয়।’
লঙের এই চিঠির বক্তব্যও এই তথ্যকেই প্রতিষ্ঠা দেয় যে তিনি বিভিন্ন লাইব্রেরি-তা সে ইংরেজি বইয়ের পাঠাগার-ই হোক কিংবা বাংলা বইয়েরই হোক-এ সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ তথ্য আহরণ করেছিলেন।
‘১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষানুবাদক সমিতি গঠিত হওয়ার পর লঙ্ এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত হন। এই সমিতির লক্ষ্য ছিল ভালো ভালো ইংরেজি বইয়ের বঙ্গানুবাদ করে বাংলা সাহিত্যরসপিপাসুদের সমৃদ্ধ করা। এই সমিতির মুখপত্র হিসেবে রাজেন্দ্রনাথ মিত্র-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে লঙ্ এই মাসিক পত্রিকাটির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন। এই অনুবাদগ্রাহ্যতার বিষয়ে স্থিরীকৃত হয় যে প্রকাশের জন্য যদি কেউ কোনো বই রচনা করেন তবে তার আদর্শ’ নিরুপণ করবেন বিদ্যাসাগর এবং রবিনসন সাহেব। তাঁরা যদি রচনাটিকে প্রকাশযোগ্যতার ছাড়পত্র দেন তবে তা পাঠানো হবে লঙ্ সাহেবের কাছে। লঙ্ বিচার করে দেখবেন ওই রচনা ‘গ্রাম্য বালকদিগের বোধগম্য’ হবে কি না।’
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিষয়ে এইসব কাজকর্মে যুক্ত হয়ে লঙ্ নিজে গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে উৎসাহী হন। ইতোপূর্বে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্রগুলি থেকে একটি নির্বাচিত সংকলন করে তিন খণ্ডে তিনি তা ‘সংবাদসার’ শিরোনামায় প্রকাশ করেন। বাংলার ছোটোলাট স্যার হ্যালিডের নির্দেশে লঙ্ প্রকাশ করেন। ‘রিটার্ন অব অথরস অ্যান্ড ট্রান্সস্লেটস অব ভার্ণাকুলার লিটারেচার’ শীর্ষক একটি বই। হ্যালিডের নির্দেশ মতো বইটি ৮০০ কপি মুদ্রিত হয়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। ওই একই বছরে প্রকাশিত হয় লঙ্-এর ‘ক্লাসিফাইড ক্যাটালগ অব ১৪০০ বেঙ্গলি বুকস অ্যান্ড ট্রাক্টস’। এই দ্বিতীয় বইটি প্রকাশের পর সরকার তিনশ’ বই কিনে নেন। অর্থাৎ সরকার পাদ্রি লঙের কাজে রীতিমতো আনুকূল্য প্রদর্শনের নজির রাখতে থাকেন।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময় ইংরেজদের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানানোয় কয়েকটি পত্রিকাকে ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং কড়া সেন্সর প্রথা চালু করে। এবার লঙ্ এই সেন্সর প্রথার বিরোধিতা করে বলেন:
‘দেশীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত মতামত প্রকৃতপক্ষে সরকারকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। ১৮৫৭-র জানুয়ারিতে দিল্লির স্থানীয় সংবাদপত্রগুলি এভাবেই যুরোপীয় কর্তাদের সতর্ক করেছিল। এইসব সংবাদপত্র থেকেই জানা যায় যে বিদ্রোহের জন্য এদেশীয়রা কতটা প্রস্তুত, জানা যায় তারা পারস্য এবং রাশিয়া থেকে কোনোরকম সাহায্য পাচ্ছে কি না।’
এখানে লঙের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রশংসনীয়। তিনি দেশীয় সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরপ্রথা আরোপের বিরোধিতা করে একদিকে যেমন এদেশীয়দের প্রতি নিজেকে সহানুভূতিশীল বন্ধু হিসেবে সপ্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন, তেমনি অন্যদিকে একইসঙ্গে শাসক ইংরেজ কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছেন যে সেন্সর প্রথা আরোপ না করলে দেশীয় সংবাদপত্রের নানাবিধ সংবাদ ও লেখাপত্র থেকে সরকারবিরোধিতা এবং বিদ্রোহের প্রস্তুতি ও তারা তাদের বিদ্রোহে বিদেশি শক্তির মদত পাচ্ছে কিনা তা জানতে পারবেন। এভাবে তিনি এদেশে ব্রিটিশ শাসনের মঙ্গলাকাক্সক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেন। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডের রানির স্বহস্তে এদেশের শাসনভার গ্রহণ করে এদেশকে সরাসরি ব্রিটিশের উপনিবেশ বানানোর ঘটনার মধ্যে লঙ্ ভারতবাসীর ‘মঙ্গল’ আবিষ্কার করেছিলেন।
লঙ্ তাঁর এক পঠিত প্রবন্ধে (জানুয়ারি ২১, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ) বলেছিলেন যে অবক্ষয় মানুষের মনে হতাশার জন্ম দেয়, আর হতাশাই মানুষকে বেপরোয়া করে ‘রক্তাক্ত বিপ্লবের’ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করায়। লঙ্ আরও বলেন:
‘ঔরঙ্গজেব শাসনকার্যে হিন্দুদের উপযুক্ত অংশ না দিয়ে মারাঠা শক্তিকে জাগরিত করেছিলেন, সেই মারাঠারা মুঘলদের ধ্বংস করেছে। আমরা যেন সেই পথের অনুসরণ না করি।’
এখানে লঙের ‘আমরা’ সম্বলিত বক্তব্যের নিহিতার্থ হলো: সরকার হিন্দুদের শাসনকার্যে ‘উপযুক্ত অংশ’ দিয়ে মুসলিমদের হতাশ করছেন। হিন্দুদের শাসনকার্যে যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে তাদের ‘শক্তিকে’ জাগিয়ে তুলছেন, এর পরিণতি মুঘলদের মতো হতে পারে। সরকার যেন সেইপথ অনুসরণ না করেন অর্থাৎ মুসলিমদের বঞ্চিত করে হিন্দুদের অধিক গুরুত্ব না দেন। এর পরিণতিতে একদিকে যেমন হতাশাগ্রস্ত মুসলমানরা রক্তাক্ত বিপ্লবে অংশ নিতে পারে তেমনি জাগ্রত শক্তি হিসেবে হিন্দুরা মুঘল-ধ্বংসে মারাঠাদের ভূমিকা নিতে পারে। লঙ্ সরকারকে আরও একবার সতর্ক করতে গিয়ে বলেছেন:
‘জনগণের অসন্তোষ একটি অনিবার্য ঘটনা; সুতরাং মুসলমানদের বাইরের সন্তোষ আগ্নেয়গিরির নিদ্রিত অবস্থা-নিস্তব্ধতা ঝড়ের পূর্বাভাস।’
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শক্তির ঐকা ভাঙতে সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছিলেন লঙ কি সেই ‘ডিভাইড এম্পারা’-তেই সিলমোহর দিতে চেয়েছিলেন? সরকারের মঙ্গলাকাক্সক্ষী হয়েই পাদ্রি লঙ্ তাঁর ‘রিটার্নস রিলেটিং টু পাবলিকেশনস ইন দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ, ইন ১৮৫৭…’ শীর্ষক পুস্তকে লিখেছেন:
বিগত সিপাহী বিদ্রোহের সময় দেখা গিয়েছে যে সরকার ও সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে যত আজগুবি সংবাদই না এ দেশীয় লোকেদের মধ্যে প্রচারিত হতে পারে। নানা সাহেবের মতো একজন শিক্ষিত লোকও যে কতদূর বানোয়াট কথায় পরিপূর্ণ একটি ঘোষণাপত্র রচনা করতে পারেন। তাও দেখা গিয়েছে। সরকার যদি গ্রামে গ্রামে সঠিক সংবাদ প্রচার করতে চান তা হলে তাকে অবশ্যই এ দেশীয় সংবাদপত্রগুলিকে কাজে লাগাতে হবে। ইংরেজ সরকারের দুশমনেরা নিষ্ক্রিয় বসে নেই। ইতিমধ্যেই এমন ধারণা প্রসার লাভ করেছে যে ইংরেজশক্তি এখন অস্তাচলগামী, শীঘ্রই রাশিয়ানরা ভারতবর্ষে আসবে এবং ইংরেজদের চেয়েও সুচারুরূপে শাসনকার্য পরিচালনা করবে।
লঙের পক্ষে তাঁর স্বদেশিহিতৈষিতার, সরকারের অকৃত্রিম বন্ধুতার নিদর্শন আর কীভাবে প্রশ্নাতীত করা সম্ভব ছিল?
দুঃখের বিষয়, এদেশে ব্রিটিশ শাসনের এমন হিতৈষীকেও কারাদণ্ড পেতে হয়েছিল, বিচারকের এজলাসে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। নীলকরদের অত্যাচার ও নীলচাষিদের দুর্দশরা কথা জানা সত্ত্বেও, প্রপীড়িত নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতি সত্ত্বেও যে লঙ্ একসময় প্রতিবাদে দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন, সেই লঙ্ দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে নীলকর ও সরকারের ধামাধরা ‘ইংলিশম্যান’ ও ‘বেঙ্গল হরকরা’ শীর্ষক দুটি পত্রিকার বিষনজরে পড়েন। ‘নীলদর্পণ’-এর ইংরেজি অনুবাদে লেখকের ভূমিকায় প্রথাগতভাবে লেখা হয়েছিল:
“The Editors of two daily newspapers are filling their columns will your praises… Since you knwo fully the reason of their so doing… what wonder…if the proprietors of two newspapers, becoming enslaved by the hope of gaining one thousand rupees, thrwo the poor helpless of this land into the terrible grasp of your mouths.”
এই ‘টু ডেইলিজ’ হলো ‘বেঙ্গল হরকরা’ এবং ‘ইংলিশম্যান’। নীলকর সাহেবদের সংগঠন ‘ল্যান্ড হোন্ডারস অ্যান্ড কমার্শিয়াল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ এবং এই দুটি ইংরেজি সংবাদপত্রের মালিকরা একসঙ্গে পাদ্রি লঙ্-কে অভিযুক্ত করে বিচারকের কাঠগড়ায় তোলে। লঙ্ আদালতে এক বিবৃতিতে জানান:
‘মি. পিটারসনের (বাদীপক্ষের কৌঁসুলি) বক্তব্য… তিনি বলেছেন নাটকটিতে বিদ্রোহের উস্কানি আছে-যদি তাঁর কথা সত্য হয় তবে সেই অগ্নিগর্ভ অবস্থায় য়ুরোপীয়দের কাছে তুলে ধরে আমি কি সমাজ সেবার কাজ করি নি? … সিপাহী বিদ্রোহের বিভীষিকা আজও কলকাতা ভুলে যায় নি। ঠগীদের অত্যাচার ও সাঁওতালদের বিদ্রোহ আজও মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। … সিপাহী বিদ্রোহের উপর কোন নাটক যদি রচিত হতো এবং আমি সেই নাটক যদি অনুবাদ করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতাম তবে, আমি অনেক রক্তপাত থেকে এদেশকে রক্ষা করতে পারতাম। নীলবিদ্রোহের রক্তাক্ত পরিণতি ঘটতে পারে আশংকা করে আমি অনূদিত নাটকটির প্রকাশক হয়েছি।’
অর্থাৎ লঙ্-এর বক্তব্য নীলদর্পণের অনুবাদ প্রকাশ করে তিনি বৃহত্তর অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে দেশ, জাতি এবং সরকারকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। নীলদর্পণে বিদ্রোহের ঘটনা থাকলে তিনি তা ইউরোপীয়দের কাছে প্রচারের মাধ্যমে তা নিবৃত্ত করতে চেয়েছেন। সোজা কথায় নীলকরদের দৌরাত্ম্য থেকে নীলচাষিদের মুক্ত করে এদেশে ব্রিটিশ শাসনকে গৌরবান্বিত এবং দীর্ঘস্থায়ী করার দীনবন্ধু মিত্রের যে মিশন নীলদর্পণে প্রতিফলিত হয়েছে, পাদ্রি লঙ্ তাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়ে এর ব্যাপক প্রচারের কাজে সক্রিয় অংশীদার হয়েছেন। কিন্তু বিচারক ওয়েলস যতখানি ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থের প্রতি অনুগত, ততধিক অনুগত নীলকরদের স্বার্থরক্ষায়। ফলে ব্রিটিশ শাসনের শুভাকাঙ্ক্ষী পাদ্রি লঙ-কে ভুলে গিয়ে তিনি নীলকরদের স্বার্থবিঘ্নকারী পাদ্রি লঙের বিচার করেছেন এবং বিচারে লঙকে সাধারণ কয়েদিদের মতো একমাস কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা করেন। এই ঐতিহাসিক মামলা ও তার রায়ের ফলে পাদ্রি লঙ্ বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও জমিদারদের কাছে হিরো হয়ে যান। কালীপ্রসন্ন সিংহ জরিমানার টাকা দেন এবং মামলার খরচ বহন করেন রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ। শুধু তাই নয় প্রতাপচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে ত্রিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি অভিনন্দনপত্র লঙকে দেওয়া হয়। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় এসময় আবেগভরে লেখা হয়েছিল: ‘মিশনারীদের এদেশে আগমনই ব্রিটিশ ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান।’
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে পাদ্রি লঙ্ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। চার বছর পর ১৮৬৭তে তিনি আবার বাংলাদেশে আসেন এবং একাদিক্রমে ছ’বছর অতিবাহিত করেন। এই সময় তিনি বাংলা সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এরপর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে পাবনা-সিরাজগঞ্জ প্রজাবিদ্রোহের বছরেই তিনি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যান।
লঙের পুরো নাম জেমস্ লঙ্। জন্ম ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে, আয়ারল্যান্ডের ব্যান্ডন শহরে। কৈশোরে তিনি কিছুকাল রাশিয়ায় অতিবাহিত করেন। নয়টি ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে লঙ ইংল্যান্ডের গির্জার অন্যতম যাজক নিযুক্ত হন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৪০-এ তিনি যাজকবৃত্তি নিয়েই কলকাতায় আসেন এবং লন্ডনের চার্চ মিশনারি সোসাইটির অন্তর্গত কলকাতায় মির্জাপুরের স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি ঠাকুরপুকুরে যান তাঁর মিশনারির দায়িত্ব নিয়ে। দু পর্যায়ে তিনি এদেশে কাটিয়েছেন মোট আটাশ বছর। প্রথম পর্যায়ে ১৮৪০ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত ২২ বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৮৬৬ থেকে ১৮৭২ পর্যন্ত মোট ৬ বছর। অর্থাৎ ২৮ বছর। প্রথম পর্যায়ের অন্তর্গত সময়েই সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৫-র সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ, ১৮৬০-র নীল আন্দোলন। সাঁওতাল বিদ্রোহে তিনি আতংকিত হয়েছিলেন, মহাবিদ্রোহের বিভীষিকা দেখে সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন। তাই এসব বিদ্রোহে তাঁর কোনও অনুমোদন ছিল না। সরাসরি বিদ্রোহের বিরোধিতায় না নামলেও তিনি মানসিকভাবে ইংরেজ সরকারের পক্ষেই অনড় অবস্থান নিয়েছিলেন। নীল আন্দোলন পূর্বেকার বিদ্রোহগুলোর মতো সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছিল না। এর অভিমুখে সরকার বিরোধিতা ও ব্রিটিশ শাসনের অবসানের চিন্তা ছিল না। এটা ছিল চরিত্রগতভাবে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলন । তাই এই আন্দোলনে বাংলা মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত প্রতিনিধিরা নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন, যা আগে কখনও হয় নি। জেমস্ লও এই দৃষ্টিকোণ থেকেই নীল আন্দোলনকে দেখেছিলেন এবং চাষিদের প্রতি সহমর্মিতার জায়গা থেকেই নীলদর্পণের অনুবাদ প্রকাশ করে এই আন্দোলনে একটি অন্য গতিময় মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। আর এর ফলে তিনি এদেশের মানুষের ‘অকৃত্রিম’ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে লঙ্ একটি বাংলা গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেন। মাত্র পঁচিশ পৃষ্ঠার মুদ্রিত এই তালিকাটিই ছিল বাংলাভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থতালিকা। এছাড়া তাঁর অন্যান্য কয়েকটি কাজ হল : ‘রিটার্নস রিলেটিং টু নেটিভ প্রিন্টিং প্রেসেজ অ্যান্ড পাবলিকেশানস ইন বেঙ্গলি, ১৮৫৩-৫৪’, ‘আ ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ অব বেঙ্গলি ওঅর্কস’, ‘থ্রি থাউজান্ড বেঙ্গলি প্রভার্বস অ্যান্ড প্রভার্বিয়ান সেইংস ইলাসট্রেটিং নেটিভ লাইফ অ্যান্ড ফিলিং অ্যামংস রায়তস অ্যান্ড উওমেন’, ‘সিলেকশানস ফ্রম আনপাবলিশড রেকর্ডস অব দ্য গভর্নমেন্ট ফর দ্য ইয়ার্স ১৭৪৮-১৭৬৭’ ইত্যাদি। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ তিয়াত্তর বছর বয়সে পাদ্রি লঙ্ প্রয়াত হন।
আমহার্স্ট, স্ট্রিটে সেন্ট পলস্ কলেজের সংলগ্নে যে গির্জা আছে সেই গির্জাটি লঙ্-এর গির্জা নামে পরিচিত।
এবছর জেমস্ লঙের দু’শ’দশতম জন্মবর্ষের সূচনা পর্ব। বিদেশ থেকে পাদ্রিরূপে এদেশে এসে এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির নিবিড় চর্চার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের মাহাত্ম্যই সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
সহায়ক গ্রন্থ:
১. বঙ্গীয় নবজাগরণের অগ্রপথিক। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ। কলকাতা। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ সংস্করণ।
২. যোগেশচন্দ্র বাগল : ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা। রঞ্জন পাবলিশিং হাউস। কলকাতা। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ সংস্করণ।
৩. অমর দত্ত : পাদরি লঙ্। কলকাতা। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ সংস্করণ।
৪. রেভারেন্ড জেমস্ লঙ্ : আদিপর্বে বাংলা প্রকাশনা ও সাংবাদিকতা (মহম্মদ হাবিবুর রশিদ অনূদিত)। বাংলা একাডেমী ঢাকা। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ সংস্করণ।
৫. ঘরষ উঁৎঢ়ধহ ড়ৎ ওহফরমড় চষধহঃরহম গরৎৎড়ৎ (ঞৎধহংষধঃবফ ভড়ৎ ইবহমধষর নু অ ঘধঃরাব) ঊফ. ঝঁফযর চৎধফযধহ. চধংপযরসনধহমধ ঘধঃুধ অশধফবসর.. কড়ষশধঃধ. ১৯৯৭ বফরঃরড়হ.
পশ্চিমবাংলা, কোলকাতা, ভারত থেকে