ঘরে ফিরতে কবিরুলের পা জড়িয়ে আসছিল। কবিরুল চাকরি করে একটা বেসরকারি ব্যাংকে। মতিঝিলে অফিস। বেতন ভালো। বেতন ভালো বলে এখনো সে নিজের জন্য ভালো একটা বাসা ভাড়া নেয় নি। দেশে বাড়িঘরের চেহারা আগে পাল্টাতে হবে। বাড়ির ছেলে পাস করে চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে গ্রামের মানুষ আগে তাদের ঘরখানার জৌলুস দেখতে চায়। এটা বাদ রেখে আর কোনো কিছুর উন্নতি তাদের চোখে ধরে না। আর সেইসব মানুষের চোখ ছানাবড়া করে দিতে মা-বাবাও ছেলের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে।
সব ধকলের চাপই তো শেকড়ে পৌঁছে। অর্থাৎ যে পাশ করল মাত্র। চাকরি তার হোক না-ই হোক। বছর তিনেক আগে এমএ পাস করে হল ছেড়ে এখানেই কবিরুলরা চার বন্ধু মিলে একসঙ্গে উঠেছিল। একটা ছ’তলা বাড়ির নিচতলার দু’টি রুম এখানে। রাস্তার ওপর দরজা বলে দিব্যি কেটে যাচ্ছে। আসলে এখানে রুমটি ছিল দারোয়ানের জন্য করা। তার সঙ্গে আরেকটির দেয়াল তোলা আর কি। আর এই জন্যই বাড়ির অন্য মানুষজনের সঙ্গে গেটের ভিতর তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাই তাদের চারজনের সঙ্গে আরো চারজন এসে থাকলেও বাড়িওয়ালা কেন, তারা নিজেরা ছাড়া আর কেউ টের পায় না। তাই চারজনের তিন বছরের জীবনে বইছিল অবিচ্ছিন্ন সুখ। এখান থেকেই তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দড়ির মতো পাক খায় একজনের মাথা থেকে আরেকজনের মনে, কারো বা মননে।
কবিরুল রিকশা থেকে নেমে কোনোভাবে ঘরে ফিরে সেই যে বিছানায় ওপর উপুড় হয়ে পড়ল, পা থেকে জুতোও খোলা হয় নি। সে এভাবে ঘুমিয়ে গেছে, না জেগে আছে কামাল ঠিক বুঝতে পারছে না। এ সময়টা সাধারণত কোনো কাজ না থাকলে তারা সবাই মেসেই থাকে। কামালের আঙুলের গুঁতো খেয়ে কবিরুল কাইকুই করলেও আরো শক্ত হয়ে পড়ে থাকল। কামাল কবিরুলের গোষ্ঠী তুলে বকাবকি করতে করতে পা থেকে জুতোমোজা খুলে এদিক-সেদিক ছুঁড়ে মারল। সেগুলো গুছিয়ে না রেখেই তার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ঘর থেকে রাস্তা পর্যন্ত প্রতিদিন কত ধরনের ফকির এসে হাত পাতে। জ্যামে পড়লে তো কথাই নেই। একেবারে ফকিরের কব্জায় ধরা পড়া যাকে বলে। কিন্তু আজ জ্যামে নয়, কবিরুল রিকশা ধরার জন্য ধীরে ধীরে হেঁটে এগোচ্ছিল। বেশ কিছুদূর এসে ফাঁকা জায়গায় একটা ভাঙা থালা সামনে বসে থাকা এক বৃদ্ধকে দেখে চমকে ওঠে। সে প্রাণপণে চেয়েছিল তার ধারণা ভুল হোক। না হলেও সে পালিয়ে বাঁচতে পারত। কিন্তু সে তা করে নি। এ যেন প্রায়শ্চিত্ত। রেহাই ছিল না।
কবিরুল নিজের অজান্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। নিভে আসা চোখের ওপর নিজের চোখের আলো ফেলে জানতে চায়, আপনি ডুমদিয়ার দাদাভাই না, জমির আলি আপনার নাম?
-তুমি কেডা? বৃদ্ধ নিরুত্তাপ কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করে।
-আমি কবিরুল!
-কোন্ কবিরুল?
-মোতালেব মোল্লার ছাওয়াল কবিরুল!
-মোতালেব মোল্লার ছাওয়াল…’ জমির আলি বড় করে চোখ খুলতে চায় কবিরুলকে চেনার জন্য। কিন্তু কোঁচকানো পাতা টেনে তুলতে পারে না।
-হ দাদাবাই! আপনি বাঁইচা আছেন? কবিরুল ব্যগ্র হয়ে ওঠে।
-হ, বাঁচনের থেইকা রেহাই পাইলাম কই?
-দাদাবাই আপনি আমার সাতে চলেন!
-কই?
-আমি যিহানে থাহি!
-না রে বাই, এই দুনিয়াডারেই আমার এহন একখান গর মনে অয়। মনে অয় গরেই তো আছি! গর আর গরের মানুষ আরাইয়া এহন গর দেখলিই মনে অয় বাঁশ, বেড়া, টিন, কাঠ… মনে অয় এইসব একত্র কইরা মানুষ গর বানায়। আর তোমার দাদি মরার পর থেইকা আমার চোখের সামনে সব বান্দন খুইলা গরের মানেডা অর্থহীন, খড়কুটা অইয়া গেছে। এই জীবনেই আমার বালো। যেহানে যতুক্ষণ বালো নাগে বইসে থাহি। খালি বিষ্টিফিষ্টি আসলি অসুবিধা।
-আপনি আমার সাতে চলেন দাদাবাই… তার সঙ্গে কবিরুলের কণ্ঠও পারিপার্শ্ব ভুলে গিয়ে সেই তার শৈশবের দিনগুলোতে নামে। সে আরো কতক্ষণ বৃদ্ধকে তোষামোদ করে। কিন্তু ক্রমেই বৃদ্ধের ধোঁয়াটে চোখ দু’টি একরোখা হয়ে ওঠে। তাতে কবিরুল বেশ ভয়ও পায়। এখন ফিরে গেলেও ভয়ের কারণটি অক্ষুণ্নই থেকে যাবে। কবিরুলের তাই কথা থামে না।
অসম দু’টি মানুষের ঘনিষ্ঠ আলোচনা আরো দু-চারজন পথযাত্রীর কৌতূহল উদ্রেক করে। তারা দাঁড়িয়ে পড়ে অনড় হয়ে যায়। কবিরুল এতে ব্যর্থ মনোরথে ধীরে ধীরে উঠে সামনের দিকে পা বাড়ায়। পিছনে তাকাতে তার আর সাহস হয় না।
কবিরুলের যখন দশ-এগারো বছর বয়স বাড়িতে তখন কিছুদিনের জন্য একটা বিষয় সবার মাথা খুব উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল। বাবাসহ চাচারা সবাই ক’বারই গিয়ে গিয়ে ঘরখানা দেখে এসেছে। ঘরখানা নেওয়ার বন্দোবস্ত যার সঙ্গে হবে, সে যেন কিছুতেই ঠকে না যায়। অবশেষে কবিরুলের বাবাই মনোনীত হলো। কারণ ভাইদের মধ্যে সে বড়। আর তার চুলোয় হাড়িও অন্য তিন ভাইয়ের চেয়ে বেশি ওঠে। তাই মোহর দাদি যতদিন বাঁচবে ততদিন সে কবিরুলদের কাছে থাকবে। মানে তার যাবতীয় ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব কবিরুলের বাবার। মোহর দাদির কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। সবাই তার প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে বলত, ‘বাঁজা’। মোহর দাদির স্বামী, এই জমির আলি দাদাভাই যখন আর কাজকর্ম করতে পারত না, ক’দিন একনাগাড়ে পেটে কিছু না পড়ায়, তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিল, দুইডা প্যাট কেউ একসাতে চালাতি পারবি না। গরখান তোরে দিই। তুই তোর বাইয়ের বেটাগে কারো সাতে গিয়া থাইকগে। আর আমি বিটের জাগাটুকু আমার বাইরবেটা কেউরে লেইহে দিই, সে আমারে দেখফে।
কবিরুল হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে বসে। মাথাটা জোরে ঝাঁকি দেয়। দু’হাতে কপালের রগ ডলে। ততক্ষণে একে একে আরো তিনজন এসে গেছে। কিন্তু কবিরুল যেন কোনো গভীর খাদে পড়ে আছে। অসহ্য সে খাদ থেকে ওঠার চেষ্টায় নিজেই নিজের মাথার চুল দু’হাতে টানতে থাকে। পাশের বিছানা থেকে শফিক এসে তাকে ধাতস্থ করতে গুঁতো মারে। বলে, শালা মালটাল টেনে আসিস নি তো?
-মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত শিরা কেটে পূর্বপুরুষের রক্ত নিঃশেষ করে দিই।’ নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো শুনে শফিক চমকে ওঠে। বজ্রের মতো প্রশ্ন করে, কেন?
-আসলে আমার শরীরের রক্ত দূষিত। তোদের মতো নির্ভেজাল মানসিকতার মানুষ আমি নই…। বড় বাজে একটা পরিবারে আমি মানুষ।
-কে নির্ভেজাল, কে ভেজাল সেটা আসলে এমনিতে বোঝা যায় না। এই যে আমরা চারজন একবাড়িতে আছি। যে যার যতটুকু জানি, সেটুকুই সব নয়…। কথাগুলো বলতে বলতে শফিকের মনে হলো কবিরুল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ওকে আর কেউ জাগানোর চেষ্টা না করে অন্য তিনজন রাতের খাবার খেয়ে নেয়।
মোহর দাদি আগে যখন কবিরুলদের বাড়ি বেড়াতে আসতো, তখন তাকে নিয়ে বাবা-চাচা মিলে তাদের পাঁচ ভাইয়ের ঘরেই টানাটানি পড়ে যেত। কিন্তু যাদের রান্না আগে হতো, মোহর দাদি তাদের ঘরে খেতে বাধ্য হতো। খাওয়া শেষ হতে হতে এ ঘর সে ঘর থেকে বাটি ভরে তরকারি যেতে থাকত তার নামে। বাবার ফুপু বলে কথা। কী একটা টান জড়িয়ে ছিল মোহর দাদির জন্য ওদের চাচাত ভাইবোনসহ সবার। দাদি যদি তার বাবার বাড়ি দুয়েকদিন থাকত, তাহলে সবার মন রক্ষা করার অবকাশ পেত। দাদাসহ এলে আরো খুশির ধুম পড়ে যেত। কিন্তু ঘরের বিনিময়ে যখন থেকে মোহর দাদির খাবারের চুক্তি হলো, তখন থেকেই দাদির পাতে ভাত বাড়তে কবিরুলের মায়ের যেন গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেল। প্রতিবেলা মাকে সে বলতে শুনেছেÑ‘জরজরে একখান গর। এ আরেক গেরামে আনতি, আর ইহানে উটোতি যা গেছে তাতে নতুন গর অইয়ে যাতো। খালিখালি লোব কইরে এহন লুকশানের উপর লুকশান।’
প্রতিবেলা মার এমন কথা শুনতে শুনতে কবিরুলের বুকের ভিতর হিম হয়ে আসতো। বড়রা এমন নিষ্ঠুর, রুচিহীন হয় কী করে? কিন্তু ভয়ে-দ্বিধায় কখনো মা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয় নি। বাবারও ওই একই হিসাব ছিল। না হলে বাবা কেন মাকে অন্য অনেক বিষয়ে ধমক দিলেও এ বিষয়ে কখনো কিছু বলে নি। মোহর দাদির ঘর বাড়িতে এনে তোলার পর দাদিসহ কবিরুল আর তার ভাই আমিরুল ওই ঘরেই থাকত। দাদি থাকত নিচে আর ওরা দু’ভাই নড়বড়ে একটা চৌকিতে।
জমির আলি দাদা এলে তাকে কোনোমতে একবেলা খাইয়ে বিদায় করার পাঁয়তারা চলত। দাদা তাই খুব কম আসত। বংশের নাম ছিল দাদার। আর তা বোঝা যেত, বেলা পড়তে না পড়ত জমির আলি দাদা যখন সবাইকে শুনিয়ে বলত, ও মোহর আইজকা যাই। আসফানি আরেকদিন।’
দাদা বেলা পড়ার অনেক আগে থেকে ওরকম বলত, কারণ বাড়ির মানুষ যেন ভেবে শঙ্কিত না হয়, যে রাতটা আবার বুড়ো থাকে নাকি। বিকেল পার হতে মোহর দাদি বাড়ির ঢালু পথটুকু দাদার একটি বাহুতে দু’হাতে শক্ত করে ধরে নামিয়ে দিয়ে আরো কতটুকু পথ ধীর পায়ে দু’জন একসঙ্গে এগোত। তারপর একজন থেমে যেত। আর একজন কাছিমের মতো গুটিগুটি পায়ে এগোত। ফিরে তাকাতে তাকাতে সূর্য দু’জনার ওইটুকু পথের মধ্যেই অস্তমিত হতো। অন্ধকারে বাড়ির সে ঢালটুকু বেয়ে দাদি আর উঠতেই পারত না। কবিরুল কদিন ওরকম টেনে তুলতে গিয়ে দাদির চেপে রাখা যে প্রচ- ফোঁপানি টের পেয়েছে, তাতে তারই পাঁজর ভেঙে আসতে চাইত। প্রতিবেলা ভাত মুখে দিয়ে দাদির চোখ কেমন গোলগোল হয়ে যেত।
একদিন দাদি বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, বাইয়ের কত আহ্লাদের বুন ছিলাম, এহন বাইও আমারে মিসকিনির মতো দ্যাহে। বাই’র বিয়ার সুমায় গলার হারডা আমি দিছিলাম। আইজ সেই বাবিসাপও আমারে একবার ডাহে না। ছেলেমেয়ে নেই বলে সরাসরি স্বামীর নাম ধরে বলেছিল, ওই জমির আলি যহন এ বাড়ি আসত রুই-কাতলা মাছ কান্দে হইরে আনতো। আমার মা-বাপরে সে জামাই অইয়া যা খাওয়াইছে, তা বাই ছাওয়াল অইয়াও কোনোদিন খাওয়াতি পারে নি…।
কবিরুল এখন বোঝে দাদির কাছে ও ভাত আসলে জীবনের সবকিছুর মূল্যে ছিল বলে দাদির চোখ ওরকম হয়ে যেত। তারপর এক দুপুরে নাকের পানি, চোখের পানি এক হওয়া একটি মাত্র নলা বুকে বিঁধে দাদি ঢলে পড়ে। জমির দাদাও স্ত্রী’র লাশের ওপর যায় যায় অবস্থা থেকে বেঁচে যায় কবিরুলদের পরিবারটিকে আরো ক’দিন আতঙ্কে রাখতে। ঘর আনার ছ’মাসের মধ্যে বুড়ি মরে যা-ও বাঁচিয়ে গেছে, শেষে বুড়ো আবার সেই ভাগ উসুল করতে শালিস না ডাকে। আর এতে মদতদাতাদের তালিকায় রেখেছিল বাবা তার নিজের আপন তিন ভাইকেই। ভাইবউরা ছিল তালিকার আরো একধাপ এগিয়ে। আর এই গুঞ্জন যখন চলছিল তখন কবিরুলের আপন দাদা-দাদি বেঁচে ছিল। কিন্তু টায় টায় হিসাব খুলে তারাও এই ভাবনার বাইরে ছিল না। কবিরুল তখনই নিজেদের ক’ভাইবোনের সঙ্গে দাদা আর তার আপন বোনটির ভূমিকা কল্পনা করে শিউরে উঠত। জমির আলি দাদা মাঝে মাঝে এসে মোহর দাদির কবর জিয়ারত করে যেত। কিন্তু তাকে দেখে কবিরুলের মতো ভাইবোনেরা ভিড় করলেও বড়রা কেউ ডেকে বাড়ি তোলে নি। বড়দের অনুমতি ছাড়া তাকে ডেকে আনতে ওদের কারো সাহস হতো না। অথচ তিনবেলা বাড়িতে ঠিকই হাঁড়ি চড়ছে। দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। শুধু একটা মানুষের পাতে চারটে ভাত ছিটিয়ে দিতেই যেন সব অনর্থ হয়ে যায়। শৈশবের এইসব স্মৃতি কবিরুলের কুঁরেকুঁরে খেলেও সময়ের ধুলোয় তারও সব ঝাপসা হয়ে আসছিল।
বাতাসে রটে যাওয়া খবরের মতো একদিন ওরা জেনেছিল, জমির আলি দাদার বাড়ি নদীতে মিশে গেছে। ভাঙনটা কাছাকাছি থাকলেও ভিটের মায়ায় কেউ শুধু প্রাণ নিয়ে পালায় না। তাই হঠাৎই এক গর্জনে কখনো সব বিলীন হয়ে পড়ে। কাউকে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। না পাওয়ার দলে জমির আলি দাদাও ছিল কি না, খবরটার সত্যতা যাচাই ভিত্তিহীন ছিল।
তবু সেই দাদাকে আজ এত বছর পরে কবিরুল দেখবে ভাবতেই পারে নি। কবিরুল পারলে তার সমস্ত পৃথিবীর বিনিময়ে জমির আলি দাদাকে ওর কাছে এনে রাখে। প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া তার মুক্তি নেই। এটুকুতেই জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বুড়ো ওই মানুষটা ওর সব মিথ্যে করে দিল। যাকে চারটে খেতে দিতে হবে বলে বড়রা সবাই না দেখার ভান করেছে। আজ তাদের কাছে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হওয়া একমাত্র মানুষটি জোড়হাতে ক্ষমা চেয়েও রাস্তা থেকে তুলে আনতে পারল না সেই অনাহুত মানুষটিকে।
জমির আলি দাদার মানস যেন আয়নায় মতো স্বচ্ছ। যেন কেউ তার প্রতি লাঞ্ছনা দেয় নি। ঠকায় নি। নিষ্ঠুর আচরণ করে নি। কী প্রশান্ত, কী নিশ্চিন্ত তার মুখাবয়ব। নাকি নিভে শেষ হয়ে গেছে তার পোড়ার বাকি দাহ্যটুকু, এখন পৃথিবীর ঐশ্বর্যে তার আর প্রয়োজন নেই। নেই যে এটা ঠিক। কিন্তু কবিরুল কী করে ভুলে যাবে, সে চাকরি পাওয়ার পর মাসে মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠানো সত্ত্বেও বাবাকে সেদিন আরো বাড়তি দু লক্ষ দিয়েছে। কষ্ট করে হলেও টাকাটা দিতে হয়েছে বড় করে একখানা ঘর তুলতে। আর সে ঘরের পিছন দিকের বেড়ায় জমির দাদার মজবুত টিনের ব্যবহার করা হয়েছে খুব দাপটের সাথে।
‘বৃটিশ আমলের টিন। এহনো গরু দিয়ে পাড়ালিও ট্যাপ খায় না’ কবিরুলের বাবা-মায়ের সে কী উচ্ছ্বাস। অথচ কখনো মোহর দাদির কথা তারা ভুলেও সম্মানের সাথে উচ্চারণ করে না। দাদা মরল কি বেঁচে আছে সে খবরটা পর্যন্ত নিল না। কিন্তু কবিরুলের টান ছিল ওদের দু’জনের জন্যেই। প্রতিকূলতার সে টান আজও মানবিকতার পক্ষে তাকে জোরালো রেখেছে।
ছোটবেলায় সে মনে মনে মোহর দাদি আর জমির আলি দাদাকে একটা সুখের সংসার গড়ে দিত। সেখানে কেউ ওদের অসম্মান করত না। বাড়ির পাশের সে রাজ্যে কবিরুল যখন তখন ওদের দু’জনকে দেখতে যেত। আপন দাদা-দাদিকেও পাঠাত। মা-বাবা, চাচা-চাচি, ফুফু সবাইকে পাঠাত। যেন সবাই তাদের খোঁজ-খবর করছে। সেখানে ওদের কোনো অভাব নেই। কোনো কষ্ট নেই। অসম্মান নেই।
নিজেদের মতো অবস্থার পরিবার ও পরিবেশকে কবিরুল খুব সাবধানে এড়িয়ে চলে। সে যখন মফস্বল থেকে ইন্টার পাশ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্সে ভর্তি হলো, তখন তার বাবার সামনে বড় বড় টোপ এসে পড়তে লাগল। কিন্তু একসময় নীতিহীনতার বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্চ করতে পারে নি বলে বড় হয়ে নিজের জীবন নিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, কবিরুল সে রকম থাকে নি। বরং অনেক ক্ষোভই অব্যক্ত থাকায় তা দানা বেঁধে তাকে বড়দের মূর্খ আচরণের প্রতি কিছুটা বেয়াড়া করে ফেলেছে। আর স্বয়ং বাবাই ওরকম দুয়েকটা প্রস্তাব ছেলের কাছে পড়তে এসে উত্তর শুনে নাজেহাল হয়ে যায়। মা কেঁদে বলেÑয়্যাঁ, অ্যাতো কষ্ট হইরে মানুষ হরছি…। কবিরুল মিষ্টিস্বরে রূঢ় কথাটি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেÑমা, কাউকে মানুষ করতে যেমন কারো ভূমিকা থাকে, তেমনি যে মানুষ হয়, মানে মানুষ কেন, যে কোনো কিছু হতেও তার একটা নিজস্ব ভূমিকা থাকতে হয়। আমাকে তোমাদের নীতি মাথায় চাপিয়ে দিও না! আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও।
কবিরুলের কথা মা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তাই আর মনস্তাপের ফিরিস্তি ও ছেলেকে শুনতে হয় না। বাবারও ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অবস্থা। অন্য ভাইবোনগুলোর জন্য ঠিকমতো টাকা পাঠানো, লেখাপড়ার পরামর্শ, ব্যবস্থা যা করার, সব ঠিকঠাক মতো করলেও ওদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতে সে চায় না। তবে বড়ভাই হিসাবে সবার একটা বলয় সে গড়ে দিতে চায়। সেখানে পারিবারিক মূল্যবোধে কলুর বলদ না হয়ে যে যার মতো দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে নেবে। সে শুধু সে মূল্যবোধটুকু শুভ ও শক্তিশালী হওয়ার পক্ষে ভূমিকাটুকুই রাখবে। এভাবে গভীর গলদটুকু কবিরুল নিজের বুক পেতে ঠেকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
ইনভার্সিটিতে বন্ধুদের অনেককে দেখেই সে বিমোহিত হয়েছিল। আসলে এখানে এসেই তার ধ্যান-ধারণাটা একটা স্বচ্ছ আদল পায়। সে বুঝতে পারে হাবড়া চৈতন্য জারিত জীবনটির স্বপ্নের ঠিকানা অন্য কোনো পৃথিবীতে নয়। অনেক বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেয়া বন্ধুর বাড়ি গিয়েও নিজেদের পরিবারের শঠতা-সংকীর্ণতা তার নিজের কাছে প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেক অসচ্ছল পরিবারেও সে ভিড়ে দেখেছে, সেখানেও কোথাও কোথাও জেগে থাকা আদর্শ মনে শ্রদ্ধা জাগায়।
কেয়ার সঙ্গে সম্পর্কটি কেমন করে হয়ে উঠল, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কবিরুল। দেখতে কেয়া আহামরি কেউ নয়। অর্থ-বিত্তের জৌলুসও নেই ওদের। তবে ওকে দেখলে যথার্থই প্রতিপত্তিশীল মনে হয় কবিরুলের। কবিরুল এইটুকুই চাইত। বাড়িতেও মা-বাবার কাছেও ওর সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলে রেখেছে।
মা জানতে চায়, ডাকায় মাইয়ার বাপের কয়তলা বাড়ি? মানুষের কাছে কী কবো? বাবা বলে, তোমারে কী দেবে?
কবিরুল এপাশ ওপাশ করে ক’রাত বাড়িতে কাটিয়ে যখন নিজের পরিম-লে ফিরে আসে, তখনো তার এঁদো টান কণ্ঠনালি চিপে রাখে। নিজের অসহায় ভাবটি রুখতে হাঁসফাঁস করতে হয় ক’দিন। কেয়া মাত্র চাকরি পেয়েছে। সংসারের প্রতি ওরও দায়-দায়িত্ব আছে। বাবা রিটায়ার করেছেন। ভদ্রলোক সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। এতদিন সরকারি কোয়ার্টারে ছিলেন। এখনো শহরে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা হয় নি। চাকরির সঙ্গে গাড়িটিও রেখে আসতে হয়েছে। কেয়ার ছোটভাই দু’টির এখনো লেখাপড়া শেষ হয় নি। তবু কেউ তার বিয়েতে বাধ সাধছে না। কেয়ার বাবা বলেছেন, তোমার বাবাকে নিয়ে এসো পাকা কথা সারি।
প্রতিদিন একসঙ্গে মেসের চারজনের অফিসে যাওয়ার তোড়জোড় চললেও পরদিন সকালে ওরা তিনজন অবাক চোখে দেখল কবিরুল আগেই বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় একে একে তিনজন ফিরেও চতুর্থজনের কোনো হদিস পায় না। এভাবে দু’দিন কেটে গেল। এর মধ্যে কেয়াও এসে জেনে গেছে কবিরুলের আচরণে গড়মিল দেখা দেওয়ার ঘটনাটি। মোবাইল ফোনটি ঘরে পড়ে ছিল। তাই অফিসে গিয়ে জানতে হয়েছে, কবিরুল এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে।
কেয়া প্রমাদ গোনে মাত্র একটি তো সপ্তাহ! সপ্তাহ পুরো হওয়ার অর্ধেক আগেই কবিরুল খুব প্রসন্ন চেহারায় মেসে এসে সবাইকে চমকে দিল। তার খবরটি আরো রমরমা, আমি একটি বাসা নিয়েছি। আমার এক দাদাসহ থাকব…
-দাদাসহ থাকবি, কেয়ার কী হবে? সমস্বরে মেসমেট তিনজনই একই প্রশ্নে যেন চেঁচিয়ে উঠল।
-কেয়ার সঙ্গে আবার নতুন করে বোঝাপড়া করে নিতে হবে। কবিরুলকে ওদের তিনজনেরই আগের চেয়ে প্রত্যয়ে দীপ্ত মনে হয়। যেন সকালের রোদ পড়েছে নবীন ধানের ছড়ায়। হঠাৎ অবদমিত হওয়া তার ভাবটিও, শোধের পরে ঋণ রুক্ষ শব্দে যেমন আর বাজে না, ঠিক তেমনিভাবে কেটে গেছে বলে ওদের মনে হয়। শফিক, কামাল, বদরুদ্দোজা ওরা তিনজনই তাই ওকে নিয়ে সোরগোলে মেতে যার যার অফিসে একঘণ্টা দেরি করে ফেলল।
অস্ট্রেলিয়া থেকে