জী নজরুলকে নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। তার কবিতা, গান, একাধিক বিয়ে এমন কী তার চুল নিয়েও আমরা চিন্তিত থাকি। আর তাই তার চুল বিষয়ক কবিতা বের হয় এমন— নজরুল তুমি করিয়াছ ভুল/রাখো নাই দাড়ি,রাখিয়াছ চুল! অবশ্য কাজী নজরুল নিজেও জানতেন না যে তার চুল নিয়ে এমন ছড়া কবিতা লেখা হবে! যারা ডারউইনের বিবর্তনে বিশ্বাস করেন চুলের বিবর্তনের প্রসঙ্গটা আসলেই তারা প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে চান। কারণ যখন মাথায় থাকে তখন সেটাকে আমরা বলি চুল। কিন্তু বুক,বগল কিংবা আরো নীচে নামলে সেটার কী রূপ বা নাম হয় আমরা সে প্রসঙ্গে আর না যাই। শুধু এইটুকু ভেবে আপ্লুুত হই যে একেবারে আদিকাল থেকেই মানুষ তার চুলের প্রতি যত্নশীল ছিল। ক্লিওপেট্রার চুলের বিবরণ ও তার যত্নআত্তির নিয়ে বিস্তর লেখালেখি কিংবা ছবিও তৈরি হযেছে। রূপকথা গল্পে রাজকন্যার বড় চুলের বিবরণ আমরা প্রচুর পড়েছি। রাজকন্যার প্রেমিক চুল বেয়ে উঠে রাজকন্যার ঘরে আসতো আবার চুল বেয়ে নেমে পালিয়েও যেত। তেলের বিজ্ঞাপনেও আমরা দেখেছি ঘোড়ায় করে ছুটে আসতে থাকা রাজকুমার ঘোড়া থামিয়ে রাজকন্যার লম্বা চুলের প্রেমে পরে গেছে! কথায় আছে পানিতে চুন তাজা আর তেলে চুল তাজা। অবশ্য চুল নিয়ে কবিরাও কম যান নি। জীবনানন্দের কবিতার সেই অমর লাইন নিশ্চয়ই সবার মনে আছে— চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য!
এদেশের ক্যাডার বা মাস্তানদের মজার মজার নামে ডাকা হয়। যেমন, মাউছ্যা কাদের, ছিড়া (তার ছেঁড়া) আকবর, কালা জাহাঙ্গীর, মুরগী মিলন ইত্যাদি। এমন এক ক্যাডারের নাম হচ্ছে চুইল্যা বাবু। মাথার অস্বাভাবিক লম্বা চুলের কারণেই তার এই নাম। চুলের কারণে এদেশের একজন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অন্যরকম পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার নাম লুৎফুজ্জামান বাবর। বাংলাদেশে একজন আছেন, আছেন বহু দেশের বহু মানুষ যারা চুল দিয়ে গাড়ি কিংবা ট্রাক টানতে পারেন, করতে পারেন আরো অনেক ভারি কাজ, চুলের জন্যই অনেকে করেছেন বিশ্ব রেকর্ড। গানেও চুলের ব্যবহারের কমতি নেই। যেমন, ‘তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে ভাঙলো কাচের আয়না’ কিংবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী/দেবো খোপায় তারার ফুল। বাংলা ছবির হিট গান হচ্ছে, ‘খায়রুন লো, তোর লম্বা মাথার কেশ’ কিংবা ‘কন্যার চিরল বিরল চুল, কন্যার কেশে জবা ফুল/সেই ফুল পানিতে ফেইলা কন্যা করল ভুল/কন্যা ভুল করিস না/আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না!’
তবে ভুল করা দুই কন্যা নিজেরা কথা বলতে বাধ্য না হলেও আমরা তাদের দেশে আমরা বাস করতে বাধ্য হই। এই ভুল করা কন্যাদের চুল আছে, তারা এমনিতেই বিখ্যাত এবং নতুন করে তুমুল আলোচিত হয়েছেন চুল বিষয়ক তত্ত্বের জন্য! রাজনৈতিক চুলে যাবার আগে চুল বিষয়ক আরো কিছু তত্ত্ব!
এক. স্যার আইজাক নিউটন কিংবা আলবার্ট আইনস্টাইন আজীবন চুল নিয়ে ভাবার কোনো সময়ই যেন পান নি। তবুও তাদের চুল ছিল দেখার মতো। অন্যদিকে বিখ্যাত অভিনেতা অনুপম খের তার জীবনের একটা বড় সময় এবং টাকাপয়সা ব্যয় করেছেন যেটুকু চুল ছিল সেটুকু ধরে রাখার জন্য। ফলাফল ভালো হয় নি। সময়, টাকাপয়সা এবং চুল একই সাথে জলে গেছে! বাংলাদেশের আবুল হায়াতকে এ ব্যাপারে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে!
দুই. বিখ্যাত অভিনেতা ওমর শরীফ এবং গ্রেগরী পেগের পরচুলার ভালো কালেকশন ছিল। জীবনে পরচুলা পরেন নি, তবে মাথা ন্যাড়া করে অভিনয়ে এসেও মানুষের বুকে স্থান করে নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মানের অন্তত দু’জন অভিনেতা। এদের একজন কোজাক খ্যাত টেলি স্যাভালাস, অন্যজন ডেথ রেজ ছবির নায়ক ইয়োল ব্রাইনার। এদেশের নায়ক নায়িকারা পরচুলা ছাড়া যেন এক চুল নড়তেও পারেন না! ববিতা, জসীম, ওয়াসিম, সোহেল রানাকে পরচুলা ছাড়া কখনো প্রকাশ্যে দেখতে পাওয়া যায় নি!
তিন. রাজনীতিবিদদের পরচুলা পরতে দেখা যায় খুব কম। তবে আওয়ামী লীগের নেতা মন্ত্রীদের কথা শুনে মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া এটা ব্যবহার করেন এবং সবসময়ে সেটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাখেন। আইয়ুব বাচ্চু পরচুলা না পরে বিকল্প হিসেবে বাহারি ক্যাপের ব্যবহার দেখিয়েছেন। মাইলস খ্যাত হামিন ও শাফিন আহমেদেরও স্টাইল এক। তবে ক্যাপ ছাড়া মাত্র একবার আইয়ুব বাচ্চু তার ন্যাড়া মাথা নিয়ে দর্শকদের মাঝে হাজির হয়েছিলেন। একদা শেখ হাসিনা বলেছিলেন তিনি সংবিধানের বাইরে এক চুল নড়বেন না। পাল্টা জবাব হিসেবে খালেদা জিয়ার চুল তত্ত্ব ছিল এমন— ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনের বাতাসে চুল তো থাকবেই না, বরং চুল উড়ে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। আন্দোলনের বাতাসে দিশেহারা হয়ে যাবেন, আপনাদের অস্তিত্ব নিয়েও টানাটানি পড়বে’!
মাথায় পরচুলা পরে গান গাইতেন বাংলাদেশের এক গায়ক। কোনো একটি আসরে গান গাইবার আগে তুমুল বাতাসে তার চুল উড়ে যেয়ে পুকুরে পরেছিল। দর্শক চুল উড়ে যাওয়া শিল্পীকে তখন আর চিনতে পারেন নি। কী আর করা! শিল্পী তার জনপ্রিয় গান— কি ছিলে আমার বলো না তুমি, ‘আছি তো আগের মতো এখনো আমি’Ñ গানটি না গেয়েই সঙ্গীতের মঞ্চ থেকে নেমে আসেন!
একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ন্যাড়া মাথাকে তাও অনেকে ফ্যাশন মনে করে, কিন্তু টাক মাথাকে মানুষ কেন যেন নিতে পারে না। টেকোদের দুঃখ তাই বারো মাস! এর ভেতরে যদি চুল উড়ে যাবার ঘটনা ঘটে তাহলে তো আর রক্ষাই নেই!
যদি চুল নিয়ে মাপামাপি হয় তাহলে কম চুলওয়ালা মানুষ তোফায়েল আহমেদ, ড. মোশাররফ, মির্জা আব্বাস খানিকটা অ্যাডভানটেজ পাবেন কিন্তু ড. মঈন আহমেদের মতো মানুষ বিপদে পড়তে পারেন। কারণ এই বয়সেও তার মাথায় চুলের অভাব নেই! প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেতেন, এখন চুলাচুলির দরকার নেই, দরকার গলাগলির! সম্ভবত চুলোচুলি দেখাই আমাদের নিয়তি, হাসিনা খালেদার গলাগলি দেখাটা ভাগ্যের ব্যাপার! গড়পরতা আমরা সবাই দুর্ভাগ্যের শিকার!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিয়ম আছে কিনা জানি না, এক সাইকেলে নাকি তিনজন চড়া যায় না। কলেজে উঠে তিনজন এক সাইকেল চড়ার অপরাধে আমাদের পথ আটকে দাড়িয়েছিল সামরিক বাহিনীর লোকজন। দেশে তখন এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। শাস্তি পেতে হয় নি আমাদের। কারণ আমি ক্যাডেট কলেজে পড়তাম, নিয়মিত বাটি ছাট দিতে হতো আমাকে। আমার মাথার চুল দেখে একই রকম চুল কাটিয়েদের সম্ভবত মায়া হয়েছিল! এখন মাথায় আর বাটি ছাট নেই বরং ন্যাড়া হয়ে কেন ঘুরে বেড়াই সে গল্প পরে বলা যাবে।
দুঃখ শুধু এই, আমাদের দেশে চুলোচুলির ব্যাপারটাই প্রবল। গলাগলি বা কোলাকুলির দিন মিস করি আমরা।
লেখক: রম্য লেখক ও হেড অব প্রোগ্রাম, বৈশাখী টেলিভিশন।