২০২১ সালে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার লড়াইয়ে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম। ২০২০ সালে ছিল ১১৭টি দেশের মধ্যে ৮৮তম। এর আগের পরপর তিন বছরে যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০তম অবস্থানে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে, ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়বার যে লড়াই পৃথিবী জুড়ে চলছে তাতে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশটা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়েই চলেছে। আর বাংলাদেশের পক্ষে এই লড়াইয়ের সৈনিক যারা- তাঁরা হলেন এই দেশটির কৃষক সমাজ। বাংলাদেশের কৃষকরা ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়ে তাঁদের দেশের মানুষদেরকে কি অদ্ভুতভাবেই বছরের পর বছর ধরে না জিতিয়েই চলেছে!
ছেলেবেলাতেই আমাদের পাঠ্যবই আমাদেরকে শিখিয়েছিল বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। পাঠ্যবই এই তথ্যটি এখনো জানাচ্ছে। এই দেশের সকল মানুষই কোনো না কোনোভাবে কৃষকের সন্তান। বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষের জীবিকা কৃষি। দেশের খাদ্য সরবরাহের প্রধান উৎসও কৃষি। শিল্পোন্নয়নসহ নানান ক্ষেত্রে কৃষির ভূমিকা অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য। খাদ্য উৎপাদনের প্রধান ভূমিকাটি কৃষকই পালন করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য যত খাদ্য তার সবই আসে কৃষি থেকে, আর সেসব উৎপাদন করে কৃষক।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মোটে চাষযাগ্যে জমির পরিমাণ প্রায় ২.২০ কোটি একর। এর ৯০ শতাংশ জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়। প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করা হয়। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার বিপরীতে চাষযোগ্যে জমির পরিমাণ যথেষ্ট কম। তাছাড়া কৃষিতে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি বা কৃষি উপকরণ সুবিধা থেকে এখনো প্রান্তিক চাষিরা বহু বহু দূর অবস্থানে। এইত গেল বছরের মে মাসে খবরের কাগজে খবর এল, এক জোড়া গরুর অভাবে বাপ-ছেলের কাঁধে উঠেছে জোয়াল! অন্য ছেলে ধরেছেন হাল। হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার শিবপাশা গ্রামে এ দৃশ্যই দেখা গেছে। গরুর অভাবে একটি ফসলি জমিতে বাবা আর দুই পুত্র মিলে হালচাষ করছেন। কখনো বাপ-ছেলে জোয়াল বইছেন, অন্য ছেলে ধরছেন হাল। আবার কখনো বাবা ধরছেন হাল, দুই পুত্রের কাঁধে উঠছে জোয়াল। এমন খবর দেশের খবরের কাগজগুলো প্রথম ছেপেছে তা নয়। আগেও এসেছে এমন খবর। আমরা পড়েছি। এর সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব। আর এমন বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করেই আমাদের কৃষকরা বিশাল জনসংখ্যার দেশটির ৮০ আশি ভাগ খাদ্য চাহিদা পূরণ করে চলেছে।
অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতেও প্রধান ভূমিকাটি কৃষকই পালন করে। কৃষকের উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে সম্ভব হয় শিল্পায়ন। কর্মসংস্থানের শতকরা ৬০ ভাগ আসে কৃষিখাত থেকে। জাতীয় অর্থনীতিতেও কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেলে দেখা দেয় খাদ্য ঘাটতি। একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। আভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যেও সৃষ্টি হয় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। মোদ্দা কথা হলো, জাতীয় আয় সৃষ্টিতে কৃষির বিশেষ অবদান কেবল নয়, কৃষকই আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি।
পৃথিবী জুড়ে এখন মহামারি চলছে। মরেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। মরছে এখনো। আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। এই মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। কর্মজীবী মানুষদের বিশাল একটি অংশ বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে দারুণভাবে ব্যহত হয়েছে উৎপাদন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি আর বেকার সমস্যার সঙ্গে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। সেকারণে তাঁরা দেশে দেশে টেকসই খাদ্যনীতি গ্রহণ করা জরুরি বলে মতামত দিয়েছেন। আমরাও বুঝতে পারি এধরনের পরিস্থিতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনের সময় আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পারার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রাখা আবশ্যক।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফও) এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের ২৭ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশে এক সময় খাদ্য ব্যাপক ঘাটতিতে ছিল। এখন খাদ্য উৎপাদনে অনেকদিন ধরেই একটি দৃঢ় অবস্থানে আছে। এই করোনা ভাইরাস অতিমারির সময়ও বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সর্বোচ্চ ধান উৎপাদনকারী তৃতীয় দেশ। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেই সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদন ও মজুত নিয়ে খাদ্য সংকট উত্তরণের নিশ্চয়তায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ধান উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও করোনাকালে ফলন ভালো হওয়ায় তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। গেল বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিভাগ ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে সকল শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে তুলনা করলে কৃষকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায় কৃষকের মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন এভাবে, ১. বাংলাদেশে কৃষি শ্রমিকের আইনগত কোনো স্বীকৃতি নেই। ফলে শ্রমিক হিসেবে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার নেই। শ্রমিক হিসেবে সংঘবদ্ধ হওয়া ও ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার নেই। ২. বছরের প্রায় অর্ধেক সময় কৃষি শ্রমিকের কোনো কাজ থাকে না। অভাবের সময় কম দামে আগাম শ্রম বিক্রি করতে হয়। সরকারি ঋণ সুবিধা তাদের ভাগ্যে জোটে না, মহাজনী ও বেসরকারি ঋণে শোষণের শিকার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুস্থতায় কোনো নিরাপত্তা নেই কৃষি শ্রমিকের। ৩. অনেক সময় কাজের ন্যায্য মজুরি পায় না। কৃষকের কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময় সীমা নেই। নারী-পুরুষ মজুরিবৈষম্য বিদ্যমান। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশের সব এলাকায় নারীদের মাঠে কাজ করার সুযোগ নেই।
আমরা যতই প্রযুক্তির কথা বলি, কৌশলের কথা বলি, উন্নত পদ্ধতির কথা বলি যদি কৃষক মাঠে তা প্রয়োগ করবার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে না পারে তাহলে সেসব প্রযুক্তি, কৌশল অথবা উন্নত পদ্ধতি অন্তঃসারশূন্য হয়েই থাকবে। কৃষকের কাছে সেসব পৌঁছে দেয়া সরকারের কাজ। সেকারণে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে কৃষি ও কৃষক ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের কৃষক অবহেলিত। দিনরাত রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দারুণ পরিশ্রমে উৎপাদন করা ফসল চলে গেছে জমিদারের গোলায়। আবার ফসলের দাম নেই বলে মাঠের ফসল শুকিয়েছে মাঠেই।
এই যে ধারা, এইটি এখনো অব্যাহত আছে। ফসল বিক্রি করতে গেলে উৎপাদন খরচই ওঠে না কৃষকের। ন্যায্যমূল্যের জন্যে কৃষককে দাঁড়াতে হয় রাস্তায়। কৃষক ফসলের দাম পায় না। আর অন্যদিকে আড়তদার, মজুদদার, দালালরা ফুলেফেঁপে ওঠে। উৎপাদন খরচই যদি না ওঠে তাহলে বাঁচবে কি করে কৃষক? এই বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণিটির নাম কৃষক শ্রেণি। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার বানাতে চাই, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই, অধ্যাপক, ব্যাংকার, উকিল, ব্যারিস্টার আরো আরো গালভরা নামের পেশাজীবী বানাতে চাই, কিন্তু কেউই সন্তানকে কৃষক বানাতে চাই না। তারাও চায় না কৃষক হতে। কৃষিতে উচ্চ ডিগ্রি নিয়েও ছেলেমেয়েরা কৃষিবিমুখ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিলে ‘কৃষক’ শব্দটাকে গালাগাল বানিয়ে ফেলেছি। কাউকে ছোট করে দেখাতে গলার রোগ ফুলিয়ে ডেকে উঠছি ‘চাষাভুষা’। অথচ এই কৃষকের কাঁধে ভর করেই আমরা বেঁচে আছি।
খাদ্য নিরাপত্তা সকল দেশের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই হলো খাদ্য। এরপর বাকি সব চাহিদা পূরণের প্রসঙ্গটি আসে। যে মানুষটি অর্ধাহারে-অনাহারে থাকে সে-ই বোঝে খাদ্যের অভাব। মানুষের বেঁচে থাকবার প্রথম শর্তটিই খাদ্য। সেকারণে প্রথম মৌলিক অধিকারটিও খাদ্য।
সবার আগে সবার জন্য খাদ্য। আর এই খাদ্যের যিনি জোগান দেন তিনি হলেন কৃষক। আমার বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আমার কৃষকের হাতে সোনার ফসল ফলা বাংলাদেশ। আজকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে তার সবটুকু অবদান গায়ে-মাথায় কাদামাটি মাখা কৃষকের। যারা তিন বেলা আমার আপনার ডাইনিং টেবিলে খাবার পৌঁছে দেয়। অথচ নিজেরা সকাল-দুপুরের খাবার খায় মাঠে বসে। যাদেরকে আমরা ভীষণ অবজ্ঞায় চাষাভুষা ডাকি। আর দেখুন, এই চাষাভুষারাই আমার দেশকে খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য এনে দিয়েছে। বিনিময়ে আমরা তাদের তাঁদের পেশাটিকে নির্মম কৌতুকে গালাগাল বানিয়ে ফেলেছি। তাঁদের জীবনমান উন্নয়ন তো দূর ভীষণ অবজ্ঞায় চাষাভুষা ডাকছি। কৃষিকে একটি পেশা হিসেবে আজও ভাবতে কষ্ট হয় আমাদের। আমরা ভুলে যাই… না না, আসলে আমরা শিখিই নি যে এই কৃষি এবং কৃষকরাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
আর কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়ন হলেই এদেশ সত্যিকারের সোনার দেশে পরিণত হবে।
সাংবাদিক ও লেখক শাহ্ জে. চৌধুরী আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। নিউ ইয়র্কের রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রধান ব্যক্তি। এছাড়া তিনি অধীনে রয়েছে নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলার সম্পাদক এবং নিউ ইয়র্কের অন্যতম বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা চ্যানেল’-এর চেয়ারম্যান।