‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ অনেক পুরানো একটা বাংলা প্রবচন; কালের ধুলায় সে মোটেই মলিন হয় নি, উল্টো অতিব্যবহারে ক্রমাগত উজ্জ্বল ও ধারালো হয়ে উঠেছে। এটি বাজারের কথা। বাজারে যিনি দোকান খুলেছেন তিনি একজন ব্যবসায়ী, পণ্য বিক্রি করছেন মুনাফার জন্য, তাঁর চেষ্টা ক্রেতাকে যতটা পারা যায় ঠকাবেন, পারলে তেলে ভেজাল মেশাবেন। তাঁর কাজ ও নীতি দু’টোই পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ যতো শক্তিশালী হয়েছে ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ নীতি ততোই বিস্তৃত ও বলশালী হয়েছে, এখন তো বিশ্বময় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। কোথায় সে নেই? যেমন স্বাধীনতার পর শোনা সেই আপাত মর্মস্পর্শী ও জনপ্রিয় গানটি : ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলবো না।’ সেখানেও ওই কেনা-বেচার কথা, আসলে যেটা কোনো ভাবেই সত্য নয়। শহীদরা স্বাধীনতা এনেছেন হানাদারদের পরাভূত করে; রক্তের ‘বিনিময়ে’ তাঁরা স্বাধীনতা কিনে এনে আমাদেরকে উপহার দেন নি। যুদ্ধটা ছিল জনগণের, তাতে আমরা সবাই ছিলাম, শহীদরা ছিলেন আমাদেরই অগ্রবর্তী অংশ। ব্যাপারটা এমন নয় যে এক সাগর রক্তে রাজি না হলে হানাদারদেরকে দুই বা তিন সাগর রক্ত দিতে হতো। যুদ্ধক্ষেত্র দরকষাকষির বাজার নয়, জয়পরাজয়ের রণক্ষেত্র বটে।
পুঁজিবাদের এই বাজারী কারবার এখন বিশ্বের সর্বত্র। আর সে-কারণেই বিশ্বের এখন ত্রাহি ত্রাহি দশা। ওই নীতির বিপরীতে পাল্টা আওয়াজও আছে। আমাদের এই বাংলাদেশেই উঠেছে সে আওয়াজ। তুলেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়াজটা হলো, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না’। এটা পুঁজিবাদের দ্বারা নিপীড়িত বিশ্ববাসী সকলেরই মনের কথা, বিশ্বজনীন প্রবচনে পরিণত হতে পারতো। হয় নি। কারণ বাংলাদেশ একটি প্রান্তিক দেশ; এবং অবশ্যই হতদরিদ্র। এখানকার আওয়াজ বিশ্বময় পৌঁছায় না। পুঁজিবাদ তার বিরোধী আওয়াজগুলো শুনতেও চায় না, কণ্ঠরোধ করে। তবে বাংলাদেশ দরিদ্র বটে, কিন্তু পুঁজিবাদী সে ঠিকই।
বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের অতিসাম্প্রতিক অবদানটা হচ্ছে করোনা ভাইরাস। পুঁজিবাদের সে প্রতিনিধি, এবং নিজেও সে পুঁজিবাদী চরিত্রসম্পন্ন। পুঁজিবাদীদের একটি গণমুখপাত্র হচ্ছে আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন। করোনা মহামারীর তা–ব দেখে সে পত্রিকা মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে যে এই আক্রমণ ইতিমধ্যেই, “is challenging our & assumptions about humanity, about society, about greed and selfishness, about the need to cooperate[…]” খুবই খাঁটি কথা। বিপদে পড়লে অনেক সময় খাঁটি কথা বের হয়ে আসে বৈকি। প্রাণের টানে। মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যসমাজ সম্বন্ধে আমরা অতিউচ্চ ধারণা পোষণ করতাম। আমরা অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্বের সুবিধাভোগীরা, এবং তাদের প্রভাবে পড়ে সুবিধাবঞ্চিতরাও। করোনার আক্রমণে সেসব ধারণার ভূলুণ্ঠিত হবার দশা। সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিকতা ও লোলুপতা। ওগুলো অবশ্য ছিল, যতোই সভ্য হবার চেষ্টা করুক, মানুষ তো প্রাণীই বটে, প্রাণী জগতেরই এক সদস্য; আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিকতা ও ভোগলিপ্সা তো তার থাকবেই, আর ওগুলো জয় করেই তো সভ্যতার অগ্রগতি। কিন্তু জয় করা যে মোটেই সম্ভব হয় নি, করোনা এসে এক নিমেষে সেই খাঁটি সত্যটাই উন্মোচিত করে দিল। বললো বাঁচতে হলে পালাও, গুহার ভেতর ঢোকো। অন্যের সঙ্গে মিলবে না। দূরে দূরে থাকবে। মনে করবে সবাই তোমার শত্রু। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলো। শারীরিক দূরত্বকে যে সামাজিক দূরত্ব বলা হচ্ছে এটা নিতান্ত আপতিক নয়, ঘটনা আসলে সামাজিক দূরত্বই। মানুষ যদি মানুষকে দেখে ভয় পায়; পরস্পরের হাত ধরবে কি, বরঞ্চ হাত যাতে না ধরতে হয় তার বন্দোবস্ততে যদি সে সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকে, তাহলে তো বুঝতেই হবে যে মানুষ তার সামাজিকতার সবটাই খুইয়েছে। আর সামাজিকতা না থাকলে তো মানুষ আর মানুষই থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। সেটাই ঘটছে। রোগী দেখলে প্রতিবেশী সাহায্য করবে কি দৌড়ে পালাচ্ছে। রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ পিতামাতা মারা গেলে কাফনদাফন করতে হবে ভয়ে পরিচয়ই দিতে চাচ্ছে না সন্তানেরা; এমনও হয়েছে লাশ ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছে। অবিশ্বাস্য? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যতাই ঘটছে।
টাইম ম্যাগাজিন cooperation-এর আবশ্যকতার কথা বলেছে। কার বিরুদ্ধে? টাইমওয়ালারা অবশ্যই বলবে করোনার বিরুদ্ধে। বলে ক্ষান্ত দেবে। করোনা একটা ভয়াবহ রোগ, তার হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হবে, সে জন্য সমবায়ী উদ্যোগে টিকা আবিষ্কার চাই। কিন্তু আসল ব্যাধি তো করোনা নয়, সেটির নাম তো পুঁজিবাদ। সেই ব্যাধিই তো এই রোগকে পাঠিয়েছে। আর পুঁজিবাদের যেটা আসল স্বভাব—উন্নত করার নাম করে মানুষকে মারবার ব্যবস্থা করা, পুঁজিবাদ সেটাই করছে। সে-জন্যই বলা দরকার যে ঐক্য চাই কেবল করোনাকে নয়, পুঁজিবাদকে পরাভূত করার লক্ষ্যেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লুএইচও) এখন বেশ একটু কাহিল অবস্থাতেই আছে, তবু তার মধ্যেও সে আওয়াজ দিয়েছে যে বিশ্বের জন্য করোনার চাইতেও বড় বিপদ হচ্ছে করোনাকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব ও ঐক্যের অভাব। তাদেরও ওই একই কথা, ঐক্য চাই টিকা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করার জন্য। বলবে না, বলতে পারবে না যে, নেতৃত্ব ও ঐক্য চাই কেবল করোনাকে রুখবার জন্য নয়, ঐক্য চাই করোনার যে আস্তানা তাকে ভেঙে ফেলার জন্যই। বললে তার মুখ পুড়ে যাবে।
এই দুনিয়াতে এখন কোটিকোটিপতিদের সংখ্যা এক শ’ দুশ’ নয়, তিন হাজারের কাছাকাছি। তাদের মধ্যে সেরাদের একজন হচ্ছেন বিল গেটস্। দাতব্যের জন্যও তিনি বিখ্যাত। করোনা মোকাবিলার ব্যাপারে তিনিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতোই উদ্বিগ্ন। প্রবন্ধ লিখে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর লেখা দু’টি প্রবন্ধ দেখলাম। তিনি মহাজন তাঁর বক্তব্য তাই বিশ্বজুড়ে প্রচার পেয়েছে। প্রথম বক্তব্য ছিল, করোনার মুখোমুখি বিশ্বের এখন এক নম্বর কর্তব্য হচ্ছে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া, শাট ডাউন করা, অন্যরা যাকে বলছে লক ডাউন সেটা করা। ভালো কথা, এই লকডাউন জিনিসটা ঠিক লক আপ নয়। পার্থক্য আছে, লক আপ করে কারা কর্তৃপক্ষ, কারাবন্দীদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুপড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। আর লকডাউন হচ্ছে স্বেচ্ছায় বন্দী হওয়া, আত্মরক্ষার জন্য। পরিণাম অবশ্য একই। আটক থাকা। বিল গেটস্ সাহেবের দ্বিতীয় পরামর্শ টেস্ট করো; রোগের সংক্রমণ ঘটেছে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখো। টেস্ট, আরও টেস্ট। তার তিন নম্বর কথা টিকা আবিষ্কার চাই। তাঁর উদ্বেগ মর্মস্পর্শী। বিল গেটস্ সাহেব সুপ্রসিদ্ধ জ্ঞানী, তিনি সবই জানেন, শুধু এটুকু জানেন না যে আসল ব্যাধিটি হচ্ছে পুঁজিবাদ, যার ওপরে তাঁর ও তাঁদের ধনবৃদ্ধির পূর্ণ নির্ভরতা। তবে এই মহাসঙ্কটের সময়ে তিনি কেবল পরামর্শই দেন নি, চিকিৎসা ও ত্রাণের জন্য দানও করেছেন, যদিও দানের পরিমাণ খুবই সামান্য। তাঁর মোট সম্পদের এক শ’ ভাগের এক ভাগও নয়, শূন্য দশমিক দুই আট (০.২৮) শতাংশ মাত্র। আমরা নিশ্চিত নই যে কোনটি অধিক মূল্যবান, তাঁর দান নাকি তাঁর উপদেশ। অবশ্য উপদেশও এক প্রকারের দান বটে। তবু তিনি যা হোক হাত উপুড় করেছেন, অন্যধনীরা সেটাও করেন নি। করোনা মোকাবিলায় সেরা ধনীদের মধ্যে দাতার সংখ্যা শতকরা এগারো জনও নয়, তারও কম। এঁরা শুধু নিতেই জানেন, দিতে শেখেন নি। কারোনাক্রান্ত বিশ্বে মন্দা দেখা দিয়েছে, যেটা স্বাভাবিক; এই মহামন্দার মধ্যেও কিন্তু কোটিকোটিপতিদের ধনস্ফীতি বসে থাকে নি; সেটা বরঞ্চ বাড়ছেই। এটাও স্বাভাবিক। কারণ শ্রম আরও সস্তা হচ্ছে, বিপন্ন মানুষ তাদের সম্পদ বলতে যা আছে তা বিক্রি করে দিচ্ছে, দরকষাকষি যে করবে সেই সক্ষমতাটুকু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলছে। সব কিছুই চলে যাচ্ছে এবং যাবে ধনীদের হাতে। এমনকি ওষুধ এবং চিকিৎসাও তাদেরই করতলগত। তারাই শাসক। তাদেরকে থামায় এমন কেউ নেই। আর তারা নিজেরা যদি থামতেই শিখতো তাহলে তো অত বড় ধনকুবেরই হতো না। তাদের স্ফীতি রোখে কে!
মানুষ কিন্তু দিচ্ছে, মেহনতীরা মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যে বস্তু সেই প্রাণটিই দিয়ে দিচ্ছে। দিতে বাধ্য হচ্ছে। হ্যাঁ, ধনীরাও আক্রান্ত হচ্ছে বৈকি। ব্রিটেনের যুবরাজ, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী , প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী—এঁরাও আক্রান্ত হয়েছেন। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, যিনি সদাসর্বদা গর্জন করেন ফিলিস্তিনিদের গিলে খাবেন বলে, তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন, সস্ত্রীক। ব্রাজিলের ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট করোনা কিছু না, ইনফ্লুয়েঞ্জা মাত্র, তাই ভয় করবার কিছু নাই, বলে তুড়ি বাজিয়েছেন এবং দম্ভভরে বলেছেন তাঁর নিজের জন্য কোনো পরোয়াই নেই কারণ বয়স যদিও পঁয়ষট্টি তবু তিনি একজন ক্রীড়াবিদ; শেষ পর্যন্ত তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন। বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শ মতো ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক ওষুধের ওপর তিনি ভরসা করেছিলেন, কাজ হয় নি। আর প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে ইতিমধ্যেই তাঁর দেশের লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ ত্যাগ করেছে। প্রেসিডেন্টে সাহেবের স্বাস্থ্যনীতি সমর্থন করতে না পেরে তাঁর স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু মুখ খুলতে সাহস পান নি। ব্রাজিলে আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কণ্ঠরোধক কোনো কিছু চালু আছে কিনা জানি না; না-থাকলেও স্বৈরশাসন যে রয়েছে সে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। করোনায় মৃত ব্রাজিলের মানুষেরাও সাক্ষী দেবে, যদি তাদের ডাক পড়ে, যে তাদের মৃত্যুর জন্য দেশের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট সাহেবই দায়ী। জার্মানরা মনের শক্তিতে বিলক্ষণ বলীয়ান বলে পরিচিত, কিন্তু জানা গেছে যে তাদের অর্থমন্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। যা দেখেছেন ও দেখবেন বলে ভয় পেয়েছেন তা সহ্য করতে পারেন নি।
সকল মৃত্যুই দুঃখজনক ও শোকাবহ। কিন্তু আমরা বিশিষ্টজনদের মৃত্যুর খবরই শুধু জানতে পারি। মেহনতীদের প্রাণত্যাগের খবর কে রাখে? তারা মারা যাচ্ছে হাজারে হাজারে। যারা বাঁচছে তারাও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে। কিন্তু তারা তো পরিসংখ্যানের অকিঞ্চিতকর সংখ্যা মাত্র; সম্পদ বলতে আছে শুধু একটা প্রাণ, আক্রান্ত হয়ে ওটি ত্যাগ করেই কোনোমতে যন্ত্রণামুক্ত হচ্ছে।
বলা হচ্ছে করোনা ভাইরাস প্রকৃতির সৃষ্টি, মানুষের নয়। এক অর্থে দাবীটি মিথ্যা নয়, যদিও পুঁজিবাদী বিশ্বেরই একাংশ বলে বেড়াচ্ছে যে চীনের মনুষ্যবিনাশী জীবাণু তৈরীর এক গবেষণাগার থেকেই ফাঁকফোঁকরে কোনো একটি জীবাণু বেরিয়ে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়ে আবার তদন্তও হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তা হোক। আমরা মেনে নিলাম যে রোগটি এসেছে প্রকৃতি থেকেই। কিন্তু প্রকৃতির কেন হঠাৎ এমন দুর্বুদ্ধি হলো যে সে বেরিয়ে পড়ল মানুষ মারবার মিশন নিয়ে? প্রকৃতির তো এটা স্বাভাবিক কাজ নয়। তার জন্য স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে নিজে বেঁচে থাকা। তাহলে? আসলে প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক কাজের জন্য প্রকৃতি নিজে দায়ী নয়, দায়ী মানুষই। সকল মানুষ নয়, পুঁজিবাদী মানুষ, প্রকৃতিকে যারা পণ্যে পরিণত করেছে এবং উত্ত্যক্ত করেছে সর্বক্ষণ। প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জানানোটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতিরও তো প্রাণ আছে; প্রাণ বাঁচাবার দায় আছে। প্রাণের ওপর আঘাত করলে প্রত্যাঘাত তো সে করবেই।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক