ঢাবি’র ইংরেজি বিভাগের গ্রাজুয়েট ইলিয়াস ফার্মগেটের মুখে মনোহারী দোকান দিয়েছে। রাস্তার উপর একটা চার তলা বাড়ির উপরে ওঠার সিঁড়ির তলাটা ভাড়া নিয়েছে। ইলিয়াসের ধারণা জীবনের মোক্ষম সুযোগটি তার কাছে ধরা দিয়েছে। তাল গাছের সমান লম্বা ইলিয়াস, আমরা ওর সাথে কথা বলার সময় মুখ উঁচিয়ে কথা বলি। দোকান একাই চালায় সে, নগদ টাকার লেনদেনে বাইরের কাউকে বসানো যায় না। অসুবিধা একটা, তাল গাছ যখন সব গাছ ছাড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় কাস্টমারকে এটা-ওটা জিনিস এনে দেবার জন্য তখন সিঁড়ির তলার ঢালটায় ঠুকঠাক মাথায় বাড়ি খায়। এই গল্প মেলা সময় আগের, তখন মোটরসাইকেল চালক এবং তার সাথীর মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক হয় নি। তাহলে দোকানের ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে কেনা হেলমেট ইলিয়াস দ্বৈত কাজে ব্যবহার করতে পারত। দোকান মালিক ও সে-সঙ্গে ভেসপা চালক। দোকানে যাতায়াতের সুবিধার্থে সে একটা থার্ড হ্যান্ড ভেসপা কিনে নিয়েছিল আর জোগাড় করে নিয়েছিল ইন্দিরা রোডের গলির ভিতরে একটা সাবলেট ঘর।
ঢাকায় টিকতে না পেরে পালিয়ে আমি শিকলবাহা যাই। আবার শিকলবাহায় যখন শিকলে নিজেকে বেঁধেছেদে রাখতে পারি না চিটাগাংয়ের লাভ লেন থেকে ঢাকায় আসার বাস ধরি। আগে আমার ঢাকার ঠিকানা ছিল ইলিয়াসের ঢাবি’র মহসিন হলের রুম। এখন আমার স্ট্যাটাসের উন্নতি হয়েছে। আগের সন্ধ্যায় নেমেছি সায়েদাবাদ বাস স্টেশন, সেখান থেকে ফার্মগেট-ইলিয়াসকে খুঁজে বের করে ও রাতে একটা রেস্টুরেন্টে খেয়েদেয়ে ইলিয়াসের খাটে চাপাচাপি করে পূর্ণ শয়ন। ভালো ঘুম হয় আমার।
বিকেলবেলা ইলিয়াস ঠিক করে আজকের জন্য ‘বিচিত্রা স্টোরস্’ বন্ধ। বন্ধু এসেছে তার সাথে সময় কাটাবে। সকাল থেকে ইলিয়াস দোকানদারি করছিল, আমি দোকানের সামনে ছোট একটা টুলে বসেছিলাম। দু’জনে গল্প করছিলাম আর ক¤িপটিশন দিয়ে ক্যাপস্ট্যান সিগারেট খাচ্ছিলাম। মাঝে দুয়েকজন বিস্কুট, চানাচুরের প্যাকেট, কোলড্রিংকস, মসুরের ডাল, সরিষার তেল ও ডিম নিতে আসে। আমাদের গল্পের ছন্দে ব্রেকের চাপ পড়ছিল, তবে কবিতার ছন্দ তো না গদ্য কবিতা- অসুবিধা হয় না, একটা গল্পের সাথে বা একটা শব্দের সাথে আরেকটা গল্প বা শব্দ জুড়ে দিলেই হয়।
ইলিয়াস তার মোটরসাইকেল রাখে বিল্ডিংয়ের মালিকের বাড়ির গেটের ভিতরে নিরাপদ জায়গায়। লাথি দিয়ে দিয়ে ইলিয়াস ভেসপা স্টার্ট দেয়, তার ভঙ্গিতে মনে হয় যে সে নিজেও জানে না কয় লাথিতে এই বাহন স্টার্ট নেবে বা আদৌ এখন কোথাও যেতে নারাজি জানাবে কিনা? ভটাস করে স্টার্ট হয় ভেসপা, আমি পেছনে উঠে বসি। আমি জোর গতিতে চলার লোক না, নড়েও নড়ি না। কেমন ¯িপডে চালাবে ইলিয়াস ভেসপা, আমি তাল সামলাতে পারব কিনা, লজ্জার মাথা খেয়ে পুরুষ মানুষ হয়েও ইলিয়াসের পেট-পিঠ আমার চেপে ধরে থাকতে হবে। যে মুখটা ইলিয়াসের পিঠে চেপে রাখা সেটা একটা মেয়ের মুখ হলে এই স্পর্শ ইলিয়াসের জন্য আনন্দের হতো। বাস্তবে একশ আশি ডিগ্রি উল্টা -ভোতা পীড়াদায়ক আমার গালের স্পর্শ।
ভেসপা স্থিরতা থেকে গতিতে যাবে, তখন ইলিয়াস আমাকে বলে যে, আজ মনিকার বিয়ের এনগেজমেন্ট।
মনিকা নামটা আমার চেনা। এনগেজমেন্ট শব্দটাও। মনিকাকে আমি চিনব না? এই পুঁচকে একটা মেয়ের জন্য আমার পুরো জীবন ত্যানা ত্যানা । আমার যে শিকলবাহায় পরবাস তা এই মনিকার জন্যই। আমি ও মনিকা একই শহর ঢাকায় বাস করি, দু’জনের শ্বাস-প্রশ্বাসই ঢাকার একই বাতাসে মিলেমিশে আছে। কিন্তু আমাদের দু’জনের মেশামেশি নেই। তার সঙ্গে আমার দেখা হয় না, কথা হয় না। ঢাকার এই জীবন লইয়া আমি কী করিব! ঢাকার বাতাসে সীসার বিষ মেশানো আছে মনে হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাই আমি ঢাকা ছেড়ে চিটাগাং যাই। চাক্তাই ঘাটে গিয়ে সাম্পানে চড়ে কর্ণফুলী নদীর ওপারে শিকলবাহা; সেখানে যে যাই, এত সিকিউরিটির প্রহরা ভেদ করে আমাকে যেতে দেবে কেন? বিদেশী সংস্থা টাকা দিয়েছে সেই টাকা খরচের জন্য দেশের প্রত্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে নতুন পাস করা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে। ফিক্সড অ্যালাউন্স। স্থায়ী কোনো চাকরি না। ট্রেনিং শেষে উপযুক্ততা প্রমাণ করতে পারলে পাকা চাকরি পেতে পারে। আমি নতুন পাস করা ইঞ্জিনিয়ার না। পাশ করেছি তিন বছর আগে। বিদ্যুতের এই কোম্পানিতে স্থায়ী চাকরির জন্য দুই বছর আগে আমি ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলাম। মনিকার সাথে আমার স¤পর্কের কার্ভটা সমুদ্রের পানির উঁচু ঢেউয়ের মতো- এই উঁচুতে উঠে আকাশ ছুঁলো আবার কিছু সময় পরে নামতে নামতে সাগরের বুক খালি করে ঢেউ যে কোথায় তলালো! ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে দেখলাম চাকরি-বাকরির বাজার ভালো না। তখন তখনই লোক নিচ্ছে না। আমারও দেরি করার উপায় নেই। মনিকা ছাড়া বেশিদিন আমি বেঁচে থাকতে পারব না। মনিকার ভাবভঙ্গি দেখে যা মনে হয় তাকে পেতে হলে আমার অনেক টাকাপয়সা রোজগার করতে হবে। বাঁধাধরা চাকরিতে তা হবে না। কন্ট্রাকটারি ব্যবসা শুরু করি। আমার এলাকার আরেক বন্ধু এই কাজটা অনেক ভালো করছিল। আমিও লেগে যাই। ভালোই করি। মিউনিসিপালিটির ড্রেন বানাই, ম্যানহোল, রাস্তা মেরামত। খেলাটি হলো যত নিুমানের কাজ বুঝিয়ে দিতে পারব তত পয়সা। আমি খেলার নিয়ম-কানুন শেখার চেষ্টা করি। নতুন প্লেয়ার। ইঞ্জিনিয়ার ঠিকাদার হয়েছে ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার ও অন্য কর্মচারীরা বাড়তি খাতির করে। টাকা ভালো আসে। বুকপকেটে ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট। ওই সিগারেটের প্যাকেট বুক পকেটে আর তখনকার ফ্যাশন মাথায় এক বোঝা চুল নিয়ে বিদ্যুৎ কোম্পানির চাকরির ইন্টারভিউতে যাই। টেবিলের এক পাশ ভর্তি বাঘা বাঘা লোক, চাকরি পেলে তাদের অধীনেই আমার কাজ করতে হবে, কিন্তু একটা কাউকে আমার পছন্দ হয় না। যেন তারা না আমিই তাদেরকে নির্বাচন করব।
বসতে বললে আমি চেয়ার টেনে বসি। আমার চোখের ফোকাস সবার মুখে ফেলি। ঠিক করে ফেলে ওদের খেলাটা আমি খেলব না। টেকনিক্যাল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ইন্টারভিউ বোর্ড, আমি দুয়েকটা পারি আবার পারি না। অত গরজ করে উত্তর দেই না । বলি যে আমার ঢাকায় পোস্টিং লাগবে, আমার পক্ষে সম্ভব না ঢাকার বাইরে থাকা । মেয়ে না হয়েও আমার বুকটা এগিয়ে দেই, আমার বুক পকেটে ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট ফুটে ওঠে। ঢাকায় না হলে মনিকা আমাকে বিয়ে করবে না ।
– মনিকা কে?
আমি লাজুকহাসি হাসি।
-আচ্ছা ঠিক আছে, থ্যাঙ্ক ইউ।
দুই পক্ষই ডগফাইট থেকে বাঁচি।
কিন্তু আমার এই বাঁচা খুব বেশি সময়ের না। কন্ট্রাক্টারি কাজে ধরা খাই। সবুজবাগ, মালিবাগ গলির ভেতর বৈদ্যুতিক লাইটপোস্ট বসানোর বড় একটা কন্ট্রাক্ট পেয়েছিলাম। বাজার থেকে খুঁজে খুঁজে সব পুরনো পাইপ কিনে ঘষামাজা করে, পুটিং মেরে, এন্টিকরোশন রেডঅক্সাইড, এনামেল পেইন্ট লাগিয়ে দ্রুত লাইট পোস্টগুলো বসাতে থাকি। আধাআধি লাভ। বিশাল অঙ্কের টাকা। মনিকা আর আমার হাত থেকে বেরোতে পারছে না।
তক্কে তক্কে ছিল আমার অ্যান্টি-কনট্রাক্টরের একজন, স¤পর্কে আমার মামা, আমি বিল সাবমিট করতে সে গিয়ে মেয়রকে লিখিত কমপ্লেইন করে। আমার যাদের সাথে ভাগ বাটোয়ারার লাইন তাদের বাদ দিয়ে অন্য লোক পাঠায় আমার কাজ পরীক্ষা করতে। ওদেরকে আমার কিছু খাওয়ানোর সুযোগ হয় না। আমার অ্যান্টি পার্টি ওদের আগে থেকেই খাইয়ে পেট ভরিয়ে রেখেছে।
আমার পুরা কাজ রিজেক্ট। আমি পড়লাম গাথায়। বাজার থেকে টুকিয়ে টাকিয়ে আনা এত এত আমার পুরনো পাইপ কিনবে কে? ওগুলো কেটেকুটে আবার লাইটপোস্ট বানানো,এগুলো আর কোনো কাজে লাগবে না। কোথাও ফেলে দিয়ে আসতে হবে না হলে সের ধরে বেঁচে কটকটি খাওয়া।
নতুন পাইপ কিনে কাজ শেষ করব সে কোমরের জোর নেই আমার। কাজ আর করলাম না, আমার আর্নেস্টমানির মোটা টাকা ফরফিট। সে-সঙ্গে আমার ঠিকাদারি কাজের ইতি। কপালের ফের, বিদ্যুৎ কোম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং হয়ে শিকলবাহা। বিদ্যুৎ কোম্পানিকে আমি ছাড়ি না মনিকাকেও না।
ভাগ্যিস আমি এই সময়টায় ঢাকায় এসেছিলাম, ইলিয়াসের কাছে উঠলাম, ইলিয়াস খবরটা আগেই পেয়েছিল, হয়ত মনিকার এনগেজমেন্টে তারও খাওয়ার দাওয়াত, তার ও তার বোনের। বোন আবার মনিকার ঢাবি’র বান্ধবী।
যার কেরামতিতেই হোক আজ বিয়ের এনগেজমেন্ট, সে- খবর ঠিক আমার কানে এসে পৌঁছালো।
আমি ইলিয়াসকে বললাম, চলো যাই।
-এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান তো এই বিকেল বেলা না রাতে।
-আমি খেতে যাব নাকি, যাব এনজমেন্টের অনুষ্ঠান ভাঙতে।
যা করতে বলি ইলিয়াস করে।
আমরা দুইজন মনিকার বাসায় যাই। এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা বাড়িতেই। সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার। লাইন ধরে বাড়ি। বাড়ির পেছন দিকে মনে হয় বাবুর্চি রান্নাবান্না করছে। কত লোক হবে এনগেজমেন্টে? বাসার ভিতরে কত লোককে ঠিকমতো সমাদর করতে পারবে? বাইরে খোলা জায়গা ছিল বা ছাদে প্যান্ডেল লাগিয়ে ব্যবস্থা করতে পারত। আমি যেন মনিকার মামা মনিকার বাবাকে বুদ্ধি দিচ্ছি কী ভাবে কী করলে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান সুন্দর হবে!
ড্রইং রুম ফাঁকা করে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা করেছে। ইলিয়াস ভেসপা রেখে আমার পেছন পেছন আসে। আমি আগে যাই। মনিকাকে জোরে ডাকি। মনিকা আসে। আমার বুকপকেটে এখন ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট নেই, প্যান্টের পকেটে চ্যাপ্টা ক্যাপস্টানের সাদা প্যাকেট। গলায় যতদূর জোর আনা যায় মনিকাকে বললাম, তোমার বাবা মাকে ডাকো।
এরকম মাঝে মধ্যে হয়েছে। প্রায় সাত-আট বছরের আমার স¤পর্কে মনিকার সাথে। তাকে দুয়েকবার ধমকাধমকি করেছি, একবার হালকা একটা চড় মেরেছিলাম, অভিমানে তার চোখ কান্নায় ভরে উঠেছিল।
মনিকার বাবাকে বললাম, খালু আশা করছি সামনের ছয় মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ কোম্পানিতে আমার চাকরিটা পাকা হবে। লাইফলং চাকরি। সরকারি চাকরি। আপনি আর খালা দু’জনেই সরকারি চাকুরে, এর মর্মটা বোঝেন। তখন মনিকাকে বিয়ে করে নিয়ে যাব, ডাইরেক্ট বিয়ে। এত খরচ করার দরকার কী! বিয়েতেও এত লোক ডেকে খাওয়াতে হবে না। বাসায় কাজী ডেকে মনিকার হাত আমার হাতে তুলে দেবেন। আমাদের কাঠের খাট স্টিল আলমারি যৌতুকও লাগবে না। শিকলবাহায় ফুল ফার্নিসড তিন রুমের ইউনিট। অনেক ইউনিট খালি। খালাখালু থেকে আপনারা তখন বাবা-মা, আপনারা আসবেন, মাঝে মাঝে থাকবেন। রুমের জানলা দিয়ে দেখবেন কর্ণফুলী নদী। দৃষ্টিতে মাঝখানে কোনো বাধা পড়বে না। সেমি কক্সবাজার, সেমি পতেঙ্গা।
খালু মনিকাকে বলে, তুমি কি বলো?
মনিকা মুখ বুজে থাকে। নতুন বউ হতে যাচ্ছে, সে আর কী কথা বলবে, বিয়েতে কবুল তো নিঃশব্দেই বলে। খালা বলে যে, মেয়ের বিয়ের এনগেজমেন্ট ভেঙে গেলে মান সম্মান থাকবে না। আমি বেয়াই বাড়িকে কী বলব? খালাকে দুয়েকবার দেখেছি । কোনো কালেই তাকে আমার পছন্দ না। আরে ঠিকঠাক বিয়ে হলেই না বিয়াই।
-আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমাকে ওই বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার দেন। আগরম বাগরম মিথ্যে কথায় যাব না, বলব মনিকার যার সাথে সাত বছর ধরে প্রেম, তারা তারাই বিয়ে করছে। প্রেম করা মেয়ে বিয়ে করা ভালো না। আপনার বেঁচে গেছেন।
মনিকা একবার চড় খেয়েছিল। আমার ধারণা সে মাঝে মাঝে চড়ের জায়গাটা ছোঁয় বুঝবার জন্য আমার ভালোবাসাটা কতদূর খাঁটি। মেয়েদের ভালোবাসার ধরনে হাজারটা পাগলামি। এই একটা জিনিস পুঁজি করে বোম্বের সিনেমা একশ’ বছর টিকে আছে। আমাদের সিনেমা করল কী মন ছেড়ে নারী শরীর দোলানিতে চলে গেল।
অন্যের সিনেমা নিয়ে মাথা ঘামাই কেন? হচ্ছে নিজের সিনেমার গল্প। স্বাধীনতার পর পর শিক্ষিত মানুষজনের কলকাতা সিনেমা দেখার প্রতি ঝোঁক হয়। তখনো সব ফ্রেন্ডলি, বাণিজ্য ঢোকে নি। ভারতীয় দূতাবাস থেকে এনে অভিজাত সিনেমা হলে সিনেমা দেখায়। মৃণাল সেন, সৌমিত্র-অপর্ণার ‘আকাশকুসুম’, একটা শো দেখাবে গুলিস্তানে। তখন আমি বুয়েটের হলে, মনিকা ইডেন কলেজের হোস্টেল। সিনেমার দুইটা টিকেট জোগাড় করতে পেরে মনে হয়েছে রাজ্য জয় করে ফেলেছি। আমি আর মনিকা পাশাপাশি বসে ‘আকাশকুসুম’ দেখব। মনিকা আমাকে নিয়ে দ্বিধায় থাকে, আমি কতটা নির্ভরযোগ্য সে বুঝে উঠতে পারে না। কখনো মনে হয় ঠিক আছে, আবার কখনও মনে হয় ঠিক না। এগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার তার এখনো সময় হয় নি। ‘আকাশকুসুমে’র টিকেট নিয়ে আমি যখন মনিকার কাছে যাই- তখন আমি ‘না’ ভোট পাওয়া। আমি একা ‘আকাশকুসুম’ দেখি। সৌমিত্র দরিদ্র ছেলে, অপর্ণা ধনী কন্যা। অপর্ণার প্রেম ধরে রাখার জন্য সৌমিত্র মিথ্যামিথ্যি হাস্যকর ভাবে ধনী সেজে থাকতে চায়। পুরো আমার আর মনিকার সেটআপ। এই সিনেমা মনিকাকে পাশে বসে দেখাতে পারলে আমার পক্ষে মনিকাকে কিছুটা নরম করতে পারতাম। তখন তখনই আমার জয় হয়ে যেত। যা হোক এখন তো জয় হতে যাচ্ছে, আমি আর ইলিয়াস যাচ্ছি মনিকার বিয়ের এনগেজমেন্ট ভাঙতে।
কিন্তু তা না, এটা আমার আকাশকুসুম ভাবনা।
ইলিয়াস আমাকে মনিকার এনগেজমেন্টের সংবাদটা জানাল, সেটা যেন আমি কানেই নিলাম না। ইলিয়াসকে বললাম, পুরানা পল্টন চলো আফজালের বিজ্ঞাপনের অফিসে, মিলন আর অন্য সব বন্ধুদেরও পাওয়া যাবে একসাথে আড্ডায়।
মনিকার বিয়ের এনগেজমেন্টের সংবাদ যে আমি শুনলাম না, ভাব দেখালাম- এতে আমার কিছু আসে যায় না, এর বড় কারণ আমি মনিকার ক্লাসের না। আমি হচ্ছি শ্রমিক শ্রেণীর- আমার বাবা, দাদা, তার বাবা। আমি লেগে আছি নানাভাবে চেষ্টা করছি কিন্তু আমার শ্রেণী উত্তরণ হচ্ছে না। বিয়ে ব্যাপারটা ঠিক একটা নর ও নারীর ব্যাপার না। এদের পেছনকার অভিভাবক, বংশ মর্যাদা এগুলোর ভূমিকা মুখ্য। বোম্বের সিনেমা তার দর্শকদের এই কথাটি বারবার মনে করিয়ে দিতে চায়। একটু এগিয়ে দুই- চারজন অ্যাডভেঞ্চারাস পরিচালক সিনেমার চিত্রনাট্যে পরীক্ষা করে দেখে, নায়ক-নায়িকা পালিয়ে গিয়ে নিজেরা নিজেরা ঘর-সংসার করলে ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এসব হিন্দি সিনেমা মনিকা নিজে নিজে দেখে থাকলেও, আমার সাথে বসে কখনো দেখে নি। আমিও ‘আকাশকুসুম’ সিনেমার সৌমিত্রের মতো কিছু লুকোছাপা তো করেছিই, ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা দুনিয়ার তাবৎ জিনিস নিয়ে গল্প করেছি, কিন্তু আমার বাবা মা ভাই বোনের কথা ভুল করে আলোচনায় তুলি নি।
আমার পরিস্থিতি বদলায় নি। আমার মনিকার কাছে যেতে সাহস হয় না। আমার শ্রেণী বিপ্লবে যোগ দেয়া হয় না।
তারপর মনিকার কী কী হয়, বিয়েটা কেমন হয়, তার স্বামী কেমন, মনিকা তার বিয়ে ও স্বামী কিভাবে গ্রহণ করল এসব আমার মাথায় আসে না। মনিকা আমার কাছে আমারই মনিকা। এদিকে বিদ্যুৎ কোম্পানিতে আমার স্থায়ী চাকরি হয়। শিকলবাহাতেই পোস্টিং। ঢাকা গেলে মনিকা ও আমার আরেক কমন বন্ধুর কাছে খবর পাই কলাবাগানে তার কাছাকাছি বাড়িতেই মনিকার শ্বশুরবাড়ি। কমন বন্ধুটি মর্নিংওয়াকে যায়, মনিকা ও তার স্বামীও। একজনের সাক্ষীতে আমার খেয়াল হলো মনিকা আর আমার নেই। আমি তখন আমার এক কলিগের বোনকে দেখি, বেড়াতে এসেছে। একে অপরের দিকে তাকাই, মিষ্টি হাসি। দুয়েকটা কথা হয়, আমার একটা বলবার মতো পরিচয় হয়েছে। ওর প্রতি আমার আগ্রহের কথা জানাই, সে রহস্যময় হাসি আসে। বেড়ানো শেষ। শিকলবাহা ছেড়ে চলে গেছে। দেখাদেখির একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বুকটা চিনচিন করে। এটা আগে কেবল মনিকার জন্য করত। কলিগকে গিয়ে বলি, আপনার বোনের ব্যাপারে আমি আগ্রহী। তিনি শোনেন ও একটা পত্রযোগে আমাকে ঢাকা পাঠান। বাসাবোতে কলিগের বাসায় যাই। মনে হলো দরজা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে আমাকে কেউ কেউ দেখছে। কলিগের বাবা ও মা কাছে এলে সালাম দেই। এক সাথে চা খাই। বোন বাড়িতে ছিল না- তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন বাদে ঈদ পড়ে আমার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে বাসাবোতে সেই বাড়ি যাই, বোনকে তার হবু ভাবী দেখাব। বসে থাকি কেউ আসে না। বসেই থাকি।
ঈদের দিন। ছোটবোনের অনেক বান্ধবী, ওদের সাথে বেড়াবে, আমি অচেনা এক বাড়িতে এনে তাকে আটকে রেখেছি।
কিছুক্ষণ পর কলিগের স্ত্রী সেমাই নিয়ে আসে। আমি তাকে তার স্বামীর বোনের কথা জিজ্ঞেস করি। তিনি অবাক হন। আমাকে জানান, অনেক আগেই আমাদের ঘরবাড়ি ভিজিট করে আমার শ্রেণী চরিত্র দেখে, আমার পাত্রত্ব বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আমি ছোট বোনের কাছে খুব লজ্জায় পড়ে যাই। তাকে বলি যে, ঈদে মুক্তি পাওয়া তিনটা সিনেমাই আমি তাকে দেখাবো, বড় সালামিও সে আমার কাছ থেকে পাচ্ছে। বাসাবোর বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচি।
বিয়ের জুড়ি আসলে স্বর্গেই তৈরি হয়। আমার আরেক জুনিয়র কলিগের বিয়েতে উত্তরবঙ্গে যাই, বিয়ে বাড়িতে পাত্রীর এক বান্ধবীকে দেখি। বিয়ে দুই তিন দিন ধরে চলে। আমি আমার নতুন নায়িকা থেকে চোখ ফেরাই না। ফিরে এসে দুই মাস পরে ওই মেয়েকে চিঠি লিখি, তুমি আমাকে বিয়ে করো। সে তার বান্ধবীর স্বামীর মাধ্যমে জানায়,তাহলে আমি যেন তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করি।
আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের অংকটা কিভাবে মিলল ধারণা করতে পারি না। তাই সেটা স্বর্গের বরাতেই থাকুক।
তারপর একদিন বইমেলায় বাংলা একাডেমিতে মনিকার সাথে আমার দেখা হয়। বইমেলায় আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম।
মনিকার সাথে আমার কতদিন পরে দেখা। মনিকা আমাকে বলে, আমাকে বিয়ে করতে আসে নি কেন?
-আমি তো জানতাম না তুমি বিয়ে করবে।
-আমি তোমাকে খবর পাঠিয়েছিলাম।
-তোমার সাথে কতদিন দেখা হয় নি। তুমি নিজ থেকে চিঠিও লেখ না। কিভাবে খবর পাঠালে?
-বাতাসে বাতাসে। তুমি আমার বিয়ের এনগেজমেন্টের খবর জানতে!
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
মনিকা আমাকে বলে, যা যা হয়েছে হোক। এখন থেকে তুমি আর আমি এক হয়ে যাই।
আমার বুক চিনচিন করে ওঠে। আমি তাকিয়ে দেখি আমার বউ দূরে একটা স্টলে বই দেখছে। আমি আর মনিকা হাত ধরাধরি করে বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে যাই।
কিন্তু এই গল্প যারা পড়ছেন তাঁরা আন্দাজ পড়তে পারছেন যে, এই গল্পের পুরুষ চরিত্র এই কাজ করতে পারবে না। মনিকার কথায় মনিকার হাত ধরে উড়ে চলে যেতে পারবে না। সে ভাববে তার স্ত্রী আছে, স্ত্রীর পেটে বাচ্চা। মনিকারও স্বামী ও আরও কেউ কেউ আছে। মনিকা একলা কিছু না সে নিজেও না।
মনিকার প্রস্তাব হালকা হেসে আমি উড়িয়ে দেই।
কত কত কাল চলে যায়। মনিকার মেয়ে হয়, আমারও। আট বছর পর মনিকার ছেলে হয়, আমারও।
মনিকার প্রথমবার ক্যান্সার হয়, তখন সে আর এ-দেশে থাকে না। আমাকে বলে, আমার জন্য দোয়া করো। আর মাদ্রাসা- এতিমখানার বাচ্চাদের আমার জন্য দোয়া করতে বলো।
মনিকা কাতর কন্ঠে বলে, আমার খুব কষ্ট হয়। ক্যান্সার ছড়িয়ে যাচ্ছে তার ব্যথা। ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য কেমোথেরাপি, তার ব্যথা। আমার মাথার চুল পড়ে গেছে, হাতের নখ নীল হয়ে গেছে। আমাকে দেখলে চিনবে না। তুমি আমাকে পছন্দ করবে না, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে না।
একটা মাদ্রাসা-এতিমখানা খুঁজে পাই কোনাবাড়িতে। টাকা দিয়ে আসি, দুই বেলা বাজার রান্না করে ওদের খাওয়াব, মিলাদ পড়াবে। আমি মসজিদের হুজুরকে মনিকার নাম লিখে দিয়ে আসি- মনিকার ক্যান্সার মুক্তির জন্য দুই হাত তুলে দোয়া করবে।
মনিকার ক্যান্সার সেরে যায়। মেয়েকে বিয়ে দিতে ওরা ঢাকা আসে। মনিকা সুযোগ করে আমার সাথে দেখা করে। মনিকার মুখ থেকে আমি চোখ সরাই না।
মনিকা তার দেশে ফিরে যায়।
ফোনে কথা বলি। আমাদের এখানে রাত- মনিকার দিন। সময় মিলিয়ে আমিই ফোন করি। কী কথা তাহার সাথে? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? কথা হয়, কান্না-হাসি হয়।
এই প্রথম একদিন অসময়ে মনিকা আমাকে ফোন করে। বলে, আমি ফোন না করলে তুমি আমাকে ফোন করো না।
-কেন?
-অসুবিধা আছে। অন্য কেউ ফোন ধরবে।
মনিকা বলেছিল সে বাতাসে বাতাসে আমার কাছে তার খবর পাঠায়। আমার ভোঁতা চেতনায় ওর পাঠানো খবর, ভাষা আমি বুঝতে পারি না।
তিন চার মাস কেটে যায়, আমি মনিকার ফোন পাই না। নিজের পরিণত জীবনে এখন কত কাজ, অফিসে, বাসায়, বড় ছেলেমেয়ে। কে কবে আমাকে ফোন করবে সে কথা চাপা পড়ে যায়। তবে কোনো কোনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় মনিকা আমার কাছে কোনো খবর পাঠাতে চাইছে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই। সকালে উঠে ব্যস্ততা, দেরি হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, মাঝ রাতে ঘুমের ভেতর মনিকার কী কথা ভেবেছিলাম ভুলে যাই।
এক বিকেলে অফিস থেকে শান্তিকে ফোন করি। শান্তি মনিকার ইডেন কলেজ জীবন থেকে বান্ধবী। আমার আর মনিকার পুরো গল্পটা সে জানে।
আমি শান্তিকে বলি মনিকা কোথায়, সে ফোন দেয় না কেন?
-তাকে পাবেন কোথায়? ক্যান্সার রিলাপ্স করেছিল। শেষদিকে খুব বলত আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে রে শান্তি।
-সে-খবর আমি জানলাম না কেন?
-আমাকেও বলেছিল আপনাকে না জানাতে। অত কষ্টের ভিতরেও রসিকতা করে বলেছে, বোকা লোকটা সারা জীবন আমার আশায় বসে থাকুক।