উপন্যাসের ইতিহাসটা পুরনো নয়। উপন্যাস এসেছে সামন্তবাদের বিপর্যয় ও পুঁজিবাদের উত্থানের অংশ হিসেবে। একই সঙ্গে। ১৬০৫এ প্রকাশিত স্প্যানিশ লেখক সার্ভেন্টিজের ‘ডন কুইকজোট’ ঠিক উপন্যাস নয়, তবে তাতে উপন্যাসের পদধ্বনি শোনা গেছে, বোঝা গেছে নতুন রূপকল্প আসছে সাহিত্যে, যাতে বীরকে আর রাজপুত্র হতে হবে না, সাধারণ ঘরের মানুষ হলেও চলবে, বরঞ্চ বীরের অভিযান যদি রাজপুত্রদের মতো হয় তবে তার পরিণতি হবে হাস্যকর ও করুণ, ডন কুইকজোটের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল। সামন্তবাদ ভেঙে পড়ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনাতেই, গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদ। পরে আরও প্রকাশ্য হলো ঘটনা, পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল নিজেকে, এবং সেই প্রতিষ্ঠায় যেসব নতুন উপাদানের জন্য পথ প্রশস্ত হলো তাদের একটি হচ্ছে উপন্যাস। এমনি এমনি ঘটে নি এই ঘটনা, উপন্যাসের এই উদ্ভব। উদ্ভবের কারণ ছিল পুঁজিবাদের ভেতরেই।
কিন্তু এই বিবেচনায় যাবার আগে তো আরেকটি প্রশ্নের মীমাংসা চাই। সেটা হলো এই যে, সাহিত্যের পাঠে এভাবে সমাজতত্ত্বকে যে টেনে আনা সেটা কতটা যুক্তিসঙ্গত। সাহিত্য নিশ্চয়ই সমাজতত্ত্ব নয়। সাহিত্যের মূল বিষয়টা হলো সৌন্দর্য; জীবনকে নতুন ও সুন্দরভাবে উপস্থিত করা। তার পাঠ তাই নান্দনিক, সমাজতাত্ত্বিক নয়। সেই নান্দনিকতার ভিতর অন্যসব স্থূল ও গোঁয়ার বিষয়কে খোঁজা কেন, শুধু শুধু।
তা তো বটেই। সাহিত্যের প্রধান পাঠ অবশ্যই নান্দনিক। একমাত্র পাঠ যদি বলেন কেউ তবুও কারণ নেই তর্ক করার। শুধু যোগ করার থাকে এই ব্যাপারটা যে, কোনো সুন্দরই এমনি এমনি সুন্দর নয়। তারও দৈৰ্ঘ্য-প্রস্থ আছে, আছে গভীরতা। সাহিত্যের সৌন্দর্যেও তাই সমাজতত্ত্ব ঢুকে যায়। সাহিত্যে যা ঘটেছে তা কেন ঘটছে, অন্যভাবে কেন ঘটল না তার ব্যাখ্যায় মনস্তত্ত্ব যেমন সাহায্য করে, সমাজতত্ত্বও তেমনি সহায়তা দিতে পারে। দিয়ে থাকে। সামাজিক কার্যকারণ বুঝলে সুন্দরের রূপ ও রস শুকিয়ে যায় না, বরঞ্চ বৃদ্ধি পায়, গাঢ় হয়।
তাছাড়া এ-ও তো সত্য যে, নন্দনতাত্ত্বিক যদিও, তবু সাহিত্য মানবিকই। মানুষই সাহিত্যের বিচার করে থাকে, নিজ নিজ অবস্থানে থেকে। আরও বড় সত্য এই যে, মানুষকে নিয়েই সাহিত্য; এবং মানুষ কোনো বিশুদ্ধ প্রাণী নয়, অতিপ্রাকৃতিকও নয়, বাস করে সে ইতিহাসে ও সমাজে। এর ফলে অবিশুদ্ধতার ছাপ সাহিত্যের সর্বত্র। স্থান থাকে, কাল আসে, বাদ থাকে না স্রোত, কিংবা স্রোতের অভাব। সাহিত্যের বিশেষ বিশেষ রূপকল্প কীভাবে কোন প্রয়োজনে উদ্ভূত হয়েছে, কোনদিকে তার প্রবণতা, কী তার লক্ষ্য। সেটা জানলে সাহিত্যের সৌন্দর্যপাঠ বৃদ্ধি পায়, খর্ব না হয়ে।
উপন্যাস এল পুঁজিবাদের সঙ্গে। সামন্তবাদের কালে উপন্যাস ছিল না, সম্ভব ছিল না থাকা। এমনকি গদ্যও তেমন ছিল না তখন। গদ্য আসে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের প্রয়োজন থেকে। যোগাযোগ গদ্য আসার আগেও ছিল, কিন্তু তার ক্ষেত্রটা ছিল সংকীর্ণ। পুঁজিবাদ মানুষকে নিয়ে এল বড় জগতে, গড়ে উঠল নগর, তৈরি হলো রাস্তাঘাট, প্রসারিত হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। আদান-প্রদানের জন্য ভাষার দরকার পড়ল, সাদামাটা ও চটপটে এক ভাষা— আগের তুলনায়। এই ভাষাই হচ্ছে গদ্য। কেবল বৈষয়িক যোগাযোগ নয়, চিন্তার যোগাযোগও বেগবান করল এই ভাষাকে। গদ্য আরও বিকশিত হলে এল উপন্যাস, গাছ পুষ্ট হলে যেমন ফুল আসে।
পুঁজিবাদ আরেকটি কাজ করেছিল। বাজার তৈরি করেছিল। বৈষয়িক পণ্যের তো বটেই, মানসিক পণ্যেরও। বাজার গড়ে উঠেছে সাংবাদিকতার ও উপন্যাসের। ওদিকে শিক্ষাদীক্ষা সামাজিকভাবে প্রসারিত হচ্ছিল, শিক্ষিতদের দিক থেকে চাহিদা বাড়ছিল বইপত্রের, এবং অবশ্যই উপন্যাসের। তাছাড়া যখন বাজারে এসেছে তখন উপন্যাস নিজেও পরিণত হয়েছে পণ্যে, কেনাবেচার সামগ্রীতে।
ব্যক্তিকে ব্যক্তি হিসেবে দেখা পুঁজিবাদের একটি অবদান। একক নয়, অনেক ক’টির একটি। সামন্তবাদ মানুষকে বিচার করত রক্তের ও অবস্থানের কালপঞ্জী ঘেটে। প্রজা যে, সে কেবলি প্রজা, অন্যকিছু নয়। ভৃত্য শুধু ভৃত্যই। ভৃত্যের ভেতরেও যে একজন মানুষ আছে, আছে তার অনুভব ও আকাঙ্ক্ষা সেখবর সামন্তবাদ নেয় নি কখনও, নেবার প্রয়োজন বোধ করে নি। পুঁজিবাদ এই মানুষটাকে তার বংশগত দাসত্ব থেকে মুক্তি দিল। প্রভু আর প্রভু রইল না, নিয়োগকর্তা হলো। ভৃত্য এখন মজুরির দাস বটে; তবে বংশের দাস নয়। প্রয়োজনে সে মালিক বদলে নেয়, কিংবা মালিককে ছেড়ে চলে যায়। আপেক্ষিক হলেও- এটা একটা মুক্তি, যার চাঞ্চল্য সমাজের সর্বত্র টের পাওয়া গেছে, দেখা গেছে উপন্যাসেও। উপন্যাস ব্যক্তি হিসেবে মানুষের অভ্যুদয়ের স্মারকলিপি।
ব্যক্তি কি ছিল না এর আগে? অবশ্যই ছিল। নইলে মহাকাব্য কাকে নিয়ে, কাকে নিয়ে নাটক? কিন্তু ব্যক্তিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের উঁচুতলায়। নিচের মানুষের যে ব্যক্তিত্ব- আছে, বা থাকতে পারে সেটা স্বীকার করা হতো না। মহাকাব্যের নায়ক, নাটকের নায়ক সবাই বড় বড় লোক। ওদিকে উপন্যাস তার নায়ক-নায়িকা খুঁজে পেল ডন কুইকজোটদের মধ্যে তো বটেই, তারও চেয়ে গরিব যেসব মানুষ তাদের মধ্যেও। তথাকথিত চাকরবাকরেরাও নায়ক হলো, নায়িকা হলো উপন্যাসের। পকেটমার, কি ছিঁচকে চোৰ্ব্বও অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়ে রইল না।
একই উপন্যাসে কত বিচিত্র রকমের মানুষ যে আসতে পারে দেখালেন তা টলস্টয় যাঁর ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসে পাঁচশ’র মতো চরিত্র রয়েছে। তাঁর প্রত্যেকেই আলাদা। কোনো একজন মানুষই অপর কারও মতো নয়; প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমরা ভুল করতে পারি কার কী নাম তা নিয়ে, টলস্টয় করেন না। টলস্টয় তাদের ব্যক্তিগত স্বভাবও ভোলেন না। প্রত্যেককে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দেখেন তিনি। এমনকী তাঁর কুকুরগুলোও একটি স্বতন্ত্র অপরটি থেকে।
এই হচ্ছে ঔপন্যাসিকের কাজ। তিনি মানুষের ব্যক্তিচরিত্রে বিশ্বাস করেন। উপর-নীচ চেনেন না। চেনেন, যতটা চেনা দরকার ততটাই, তার বেশি নয়। মানতেই হবে যে, এই বোধটা সামন্তবাদের কালে ছিল না। এটি সম্ভব হয়েছে পুঁজিবাদের সময়ে। পুঁজিবাদ মনে করে সমাজে প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে; সেটা বড় হোক কি ছোট হোক। কেউই ভূমিকাবিহীন নয়, ব্যক্তিত্ববিহীনও নয়। উপন্যাসকে তাই সামন্তবাদী রূপকল্প বলবার উপায় নেই, উপন্যাস হচ্ছে বুর্জোয়া রূপকল্প। কিন্তু এইখানেই মজার ব্যাপার আছে আরেকটা। সে হলো উপন্যাস আবার পুঁজিবাদবিরোধীও বটে। বিরোধী কি বলছি, উপন্যাস আসলে পুঁজিবাদের শত্রু, তার অন্তর্গত তৎপরতা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, মূলত নাশকতামূলক।
ব্যাপারটা ঘটে এইভাবে। উপন্যাস কেবল যে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কাজ করে তা নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়েও লেখে। দুটোই থাকে। যাকে ব্যক্তি, এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক। প্রেমের, আদরের, আবার ঘৃণারও, শত্রুতারও। ঘৃণাও এক রকমের সম্পর্ক বটে। এক অর্থে উপন্যাস হচ্ছে দুমুখো; সে ব্যক্তিকে চায়, কিন্তু ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাকে চায় না। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে আর যাই হোক উপন্যাস হবে না। হতে পারে উপন্যাসের নায়কটি একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, কিন্তু তার মধ্যে অপরের সঙ্গে মিলবার, মিশবার, মিলিত হবার যে অন্তহীন আর্তি ক্রন্দনবিধুর, ঔপন্যাসিক তাকে জানেন। এবং ওপরের মরুভূমির অভ্যন্তরে যে ফল্গুধারা তাকে তিনি উন্মোচিত করেন, তাঁর রচনায়। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মিলন ছাড়া উপন্যাস হয় না। ওদিকে পুঁজিবাদ হচ্ছে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার কারণ। তার কাজও দুমুখো বটে। এক হাতে সে ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিত্ব দিল, অন্য হাতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে দিল সে খর্ব ও বিচ্ছিন্ন করে। পরস্পরবিরোধী দুটো কাজই তার জন্য- স্বাভাবিক ও সঙ্গত। ব্যক্তিকে পুঁজিবাদ দেখে একটি একক হিসেবে। সেইখানে, এবং সেই অর্থে ব্যক্তিমাত্রেই স্বতন্ত্র, কিন্তু ব্যক্তিকে সে যে পরিপূর্ণ অর্থে মুক্তি দেয় তা তো কিন্তু নয়। একটা ছোট জায়গা থেকে বড় জায়গায় নিয়ে আসে; স্বীকৃতি দেয়, ছাড় দেয়, মুক্তি দেয় না। ব্যক্তি আটক থাকে নিজ নিজ আয়ের বন্ধনে। অদৃশ্য একটা খাঁচা বহন করে চলে সে; চলতে ফিরতে পারে ঠিকই, কিন্তু খাঁচাটাকে ফেলে দিতে পারে না। ডিম ফুটে বের হয়ে এসেছে যে পাখি, বের হয়েই দেখে চারদিকে তার লৌহ পিঞ্জর। হায়, এ কী! বোঝে, বন্ধন রয়ে গেছে। এই বন্ধনকে নিয়েই চলতে হবে। পুঁজিবাদের ব্যক্তি স্বাধীন নয়। তাই স্বাধীনভাবে সে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করবে — ভালবাসার কিংবা ঘৃণার— সেটা আর সম্ভব হয় না। ব্যক্তি ব্যক্তিত্ব পেল, কিন্তু মুক্তি পেল না।
ব্যক্তি যে আটক হয়েছে তার আয়ের খাঁচায় সেটাই একমাত্র সত্য নয়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্কের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মুনাফা, আসে টাকা। মুনাফা ও মুদ্রা উভয়েই বাধা দেয় সংযোগে। মুনাফাই যেখানে প্রধান নিরিখ সেখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আন্তরিক ও গভীর সম্পর্ক হবে কী করে? আমি হিসাব করে দেখছি আপনার সাথে সংযোগ থাকলে আমার কী লাভ, আপনি দেখছেন আমার কাছাকাছি এলে আপনার লাভ নাকি লোকসান, এটাই যখন সত্য হয় তখন দোকানদারি চলে, মানবিক সম্পর্ক গড়া চলে না। কিংবা চলে মতলবাজি, অন্য সবকিছু ছাপিয়ে। অবস্থাটা দাঁড়ায় আপনি ও আমি’র নয়, আপনি অথবা আমি’র। মুনাফার লোভ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, টাকাও তাই করে। টাকার মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে বৈষয়িক দেওয়া-নেওয়া হতে পারে, কিন্তু ভালবাসার প্রতিষ্ঠা ঘটে না। টাকা বিচ্ছিন্নকারী, যদিও সে ভান করে সে সংযোগকারীর। মুনাফার মাপ হয় মুদ্রার বিচারে, অনুভূতির বিচারে না হয়ে। পুঁজিবাদ সমস্ত কিছুকে পণ্যে পরিণত করে, প্রেম ভালবাসাকেও, শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীতকেও। পুঁজিবাদের প্রথমদিকে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই মতবাদ একটি প্রগতিশীল মতবাদই ছিল, কেননা এর মধ্যে একটা বিদ্রোহ ছিল, শিল্পকে পণ্যে পরিণত করার যে মারাত্মক প্রবণতা তার বিরুদ্ধে বেজে উঠেছিল আর্তের কণ্ঠস্বর।
ফল দাঁড়ায় এই যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি খর্ব ও একাকী হয়ে পড়ে, সে তার খাঁচা বহন করে চলে; অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সে ভয় পায়, বিচ্ছিন্নতা তার মজ্জাগত হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটি ঘটেছে জে আলফ্রেড প্রুফকের ক্ষেত্রে। টি এস এলিয়টের কবিতার ওই নায়কের বয়স হয়েছে, মাথায় চুল কমে আসছে, পরনের ট্রাউজার্স ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে এখনও বিয়ে করতে পারে নি; বিয়ে পরের কথা, প্রেম নিবেদন যে করবে কারও কাছে সেই সাহসটুকু পর্যন্ত তার নেই। অথচ একাকীত্ব তার কাছে এক দুর্বিষহ যন্ত্রণা। এর বোঝা সে বইতে পারে না। একাকী ঘুরে বেড়ায়। বন্ধু পায় না। সহমর্মী পায় না। ক্লান্তি জড়িয়ে আসে পায়ে।
পুঁজিবাদ এই পরিণতিতেই নিয়ে যায় ব্যক্তিকে। আর উপন্যাস বলে, সে এটা মেনে নেবে না। উপন্যাস যাদেরকে চরিত্র করেছে, তাদের ভেতরে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হবার গভীর আকাঙ্ক্ষার কথা জানে সে, জানে সে তাদের বিচ্ছিন্নতার মর্মজ্বালা, তাই সে চায় ব্যক্তিকে নিয়ে যাবে ব্যক্তির কাছে, হৃদয়কে পৌঁছে দেবে হৃদয়ের অভ্যন্তরে। উপন্যাস বিচ্ছিন্নতার পাঠ নয়, মিলনের দলিল। পঙ্গু মানুষ নিয়ে উপন্যাস সন্তুষ্ট নয়, সে চায় মানুষের পূর্ণতা, যে-পূর্ণতা অন্যের সঙ্গে মিলন ভিন্ন সম্ভব নয়। উপন্যাসের সঙ্গে পুঁজিবাদের বিরোধটা ঠিক এইখানেই। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে ব্যক্তিত্ব দিয়ে আবার তাকে খর্ব ও বিচ্ছিন্ন করেছে, উপন্যাস চায় পুঁজিবাদের ব্যক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, ব্যক্তিকে পূর্ণ করবে, যুক্ত করবে। যুক্ত না হলে পূর্ণ হয় না, সে জানে সেটা। উপন্যাস যে-অর্থে পুঁজিবাদের অবদান, ঠিক সেই অর্থেই পুঁজিবাদবিরোধী। মানুষে মানুষে মিলন মহাকাব্যেও ঘটে। সেটা দেখেছি আমরা ‘ইলিয়াডে’ ‘অডেসি’তে ‘রামায়ণে’ ‘মহাভারতে’– মানুষ মিলেছে মানুষের সঙ্গে। যুদ্ধক্ষেত্রে, পারিবারিক জীবনেও। কিন্তু সেসব ছিল বীরের কাহিনী। পুঁজিবাদে এই সাধারণ মানুষ মুক্তি পেয়েও মুক্তি পায় না। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের কথাটা স্মরণ করা যাক, দৃষ্টান্ত হিসাবে। এর নায়ক লেপল্ড ব্লুম সামান্য লোক, একটা বিজ্ঞাপন ফার্মের ইহুদী প্রতিনিধি। ইহুদীরা সর্বত্রই বিচ্ছিন্ন, ১৯০৪ সালের ডাবলিন শহরে বিচ্ছিন্ন সে পুঁজিবাদের কারণে। তার জীবনে মহাকাব্য কী করে আসবে? কিন্তু জেমস জয়েস একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখেছেন ওই লোকটিকে নিয়ে। উপন্যাসের নামটি এসেছে গ্রিক মহাকাব্য অডিসি’র নায়কের নাম থেকে। ইউলিসিস ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ করে দশ বছর সময় নিয়েছিলেন দেশে ফিরতে; নানা বন্দরে, দ্বীপে, দেশে থেমে থেমে এগুতে হয়েছিল তাঁকে। ইচ্ছে করে নয়। বাধ্য হয়ে, বিপাকে পড়ে। সেই রকমেরই একটা ভ্রমণ এই লেপল্ড ব্লুমের, তবে দশ বছরের নয়; মাত্র একদিনের। ওই একদিনে সে কোনো নতুন বন্দরে, দ্বীপে, বা দেশে যায় নি; গেছে গণস্নানাগারে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, খবরের কাগজের অফিসে, পাঠাগারে, পানশালায় ও পতিতালয়ে। মহাকাব্যের সেই বীর আর নেই, কিন্তু ভ্রমণটা আছে। এবং আর্তি আছে মিলিত হবার। সঙ্গী পাবার, যেমনটি ইউলিসিসের ছিল। ইউলিসিসের দশ বছর কেটেছে যুদ্ধে, অস্থির ছিলেন ফিরবেন গৃহে, কিন্তু পারছেন না। লেপল্ড ব্লুমও তেমনি, তার সময় যাচ্ছে চলে, সে মিলতে চায়, চায় সংলগ্ন হতে; কিন্তু পারে না। জেমস জয়েস বিচ্ছিন্নতার একটি কবিতা লেখেন নি, প্রুফ্রককে নিয়ে এলিয়ট যেমনটি লিখেছিলেন; তিনি মিলনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন। বিচ্ছিন্নতা যখন মিলনের আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয় তখনই’ সে রূপ নেয় উপন্যাসের, তার আগে নয়।
মানুষ মিলতে চায়— উপন্যাস এই ঘোষণার জয় পতাকা উড়িয়ে রেখেছে, সদম্ভে। নেমে এসেছে সে ঝর্ণার মতো, পুঁজিবাদ যেমনভাবে নেমে এসেছিল একদা। পাহাড় বিদীর্ণ করে, সামন্তবাদের পাহাড়। কিন্তু পুঁজিবাদের ঝর্ণাধারা হারিয়ে গেছে পোড়ো জমিতে। উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। সে এগিয়ে চলেছে নদীর মতো। জনপদকে স্পর্শ করে এবং জনপদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।
উপন্যাস একটি বুর্জোয়া রূপকল্প, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষাটা সমাজতান্ত্রিক। সে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করে ঠিকই, কিন্তু সেখানে থেমে থাকে না, ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে চায় সে ব্যক্তির কাছে, মুনাফা ও মুদ্রার বাধা ভেঙে ফেলে। তার ডাক মিলনের ডাক। ডাক সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির। সে-জন্যই সে জরুরি।
২
ডন কুইকজোট থেকেই শুরু আসলে। সেই যে গরিব ভদ্রলোক রোমাঞ্চকর ঘটনা খুঁজত, সামান্যকে অসামান্য মনে করে আক্রমণ করত যখন-তখন সে-ই আদি নায়ক উপন্যাসের। সে চায় মিলিত হবে। প্রশংসা পাবে মানুষের। বীর হবে লোকদৃষ্টিতে। তার প্রধান গুণ চলমানতা; আর দ্বিতীয় গুণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকতা। চলমান থাকতে গিয়ে সে হাস্যকর করে তুলেছে কেবল নিজেকে নয়, বিগত যুগের, বলা যায় সামন্তযুগের ধ্যান-ধারণাগুলোকে। জ্ঞাতে নয় অবশ্য, সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে। উপন্যাসের নায়ককে চলমান হতে হয়, এবং নাগরিক হতে হয় বুর্জোয়া ব্যবস্থার। তার আছে ব্যক্তিত্ব, আর আছে নিঃসঙ্গ হবার ভয়।
শেক্সপীয়রের মালভোলিও হাস্যকর বটে, তবে কখনও সে নায়ক হবে না উপন্যাসের। সে বেচারা চাকরি করে যে-সুন্দরীর বাগিতে তারই প্রেমে পড়েছে। তার ধারণা সবাই তার প্রেমে পড়বার জন্য পাগল। তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবার জন্য বাড়ির অন্য ঝি-চাকরেরা ষড়যন্ত্র করে কর্ত্রীর হাতের লেখা নকল করে চিঠি লিখে ফেলে দিল তার সামনে। মালভোলিও দেখে তাতে লেখা আছে প্রেমের কথা। শুনে যেই প্রেম-প্রেম ভাব করতে যাওয়া তার, অমনি বিপদে পড়া। সুন্দরী অলিভিয়া তাকে শাস্তি দিল, আটকে রাখল অন্ধকার কুঠুরিতে। ডন কুইকজোটের সঙ্গে তার সাদৃশ্য যত না, বৈসাদৃশ্য সে-তুলনায় অনেক বেশি। মালভোলিও কখনও নায়ক হবে না, পার্শ্বচরিত্রই রয়ে যাবে চিরকাল। প্রেমে পড়ে সে অন্যের প্ররোচনায় এবং শাস্তি পায়, শাস্তি পেয়ে সংশোধিত হয়ে যায়। ওদিকে ডন কুইকজোট হলো স্বাধীন, তাকে শাস্তি দেবার কেউ নেই, যা করে সেটা করে স্বেচ্ছায়, তার আছে সাঙ্কো পাঞ্জা, আছে তার চলার ঘোড়া। প্রতিনিয়ত সে নতুন নতুন মানুষের মুখোমুখি হচ্ছে। সর্বোপরি যতই হাস্যকর হোক না কেন, নায়ক সে, ভাঁড় নয়। তাকে দিয়েই লেখা ওই আদি উপন্যাস, সার্ভেন্টিজের।
শেক্সপীয়র ও সার্ভেন্টিজ সমসাময়িক, কিন্তু শেক্সপীয়র যে উপন্যাস লিখবেন না তা সার্ভেন্টিজের সঙ্গে তাঁর তুলনা করলেই বোঝা যায়। মালভোলিওকে তিনি অবাধে চলবার স্বাধীনতা দেবেন না। শাস্তি দেবেন বরঞ্চ, লোকটি তার নিজের অবস্থান থেকে বাইরে যেতে চেয়েছিল বলে। তাকে নায়ক করার কথা তিনি ভাববেনই না। কিন্তু সার্ভোন্টিজ তাকে নায়ক করবেন, স্বাধীনতা দেবেন চলবার, এবং পুরনো সামন্তযুগের হাব-ভাব, চিন্তা-চেতনা যে কেমন বেখাপ্পা তাঁর নিজের যুগে অর্থাৎ রেনেসান্সের পরবর্তী জগতে তা তুলে ধরবেন, হাসতে হাসতে। সার্ভেন্টিজ যে গদ্যে লেখেন, শেকসপীয়রের মতো কবিতায় না লিখে সেটা অবশ্য গোটা ব্যাপারটারই অংশবিশেষ।
দুশ’ বছরেরও পরে আরেক নায়ক, ডিকেন্সের পিপ, তার বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। পিপের বাবা নেই, মা নেই, গরিবেরও গরিব সে, তস্য গরিব। সেই কিশোর গ্রাম ছেড়ে লন্ডনে এসেছে, এসে ভদ্রলোক হয়েছে। নাম-না-জানা এক উপকারীর কাছ থেকে টাকা আসে তার জন্য সেটা জানত। সে জানত না যে, টাকা আসলে এসেছে কোনো রোমান্টিক মহিলার হাত থেকে নয়, একজন ভয়াবহ অপরাধীর কাছ থেকে। পিপকে বাঁচালো কে, শেষ পর্যন্ত? বাঁচালো তার ভগ্নিপতি, কামার যে পেশায়। না-জানে লেখাপড়া, না-জানে ভদ্রতা, লন্ডন শহরে একেবারেই বেমানান যে-লোক। সমস্ত ব্যাপারটাই হাস্যকর হতে পারত। কিন্তু হাস্যকর নয়। ডিকেন্স হাসছেন না, করুণা করছেন, দেখাচ্ছেন যে, পিপ বেচারার দোষ নেই, সেও বন্দি একজন— গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। টাকা এখন শাসন করছে সবকিছুকে। ভদ্রলোক হতে হয় টাকার জোরে। ডিকেন্স অবশ্য মনে করেন যে, পিপের ভগ্নিপতি কামার হয়েও যথার্থ ভদ্রলোক এবং সমাজে যারা ভদ্রলোক সেজে ঘোরাফেরা করছে তারা অন্যকিছু নয়— পরগাছা ভিন্ন। মনে করুন গে, তবু তিনি শেকস্পীয়র নন। তিনি নাটক লিখবেন না। নতুন যুগের ডন কুইকজোট ও সাঙ্কো পাঞ্জা পিপ এবং তার ভগ্নিপতির মধ্যে মিলবার, সংলগ্ন হবার যে-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তা নিয়ে ডিকেন্স উপন্যাসই লিখবেন। চলমানতা ও গণতান্ত্রিকতা উপন্যাসের গুণ। উপন্যাস বুর্জোয়া যুগের রূপকল্প, যার পদধ্বনি আমরা সার্ভেন্টিজের লেখায় শুনতে পেয়েছি। তার আবরণ গণতান্ত্রিক, আকাঙ্ক্ষা সমাজতান্ত্রিক।
ওই ভিক্টোরীয় যুগেরই আরেক ইংরেজ ঔপন্যাসিক হলেন এমিলি ব্রন্টি, যাঁর উপন্যাস ‘উদারিঙ হাইটস’এ কী দেখি আমরা? দেখি নায়ক হয়েছে হীথক্লিফ। কে সে? না, কেউ তার পরিচয় জানে না। কুড়িয়ে পাওয়া গেছে তাকে লিভারপুল শহরের এক রাস্তায়। বস্তির শিশু, নোংরা, ময়লা; কথা বলে বস্তির ভাষাতেই, প্রায় ক্যালিবানের মতো, শেক্সপীয়রের ক্যালিবান। ক্যালিবানেরও চমৎকার কাব্যবোধ আছে, দেখেছি আমরা, ‘দি টেমপেস্ট’ নাটকে; কিন্তু যাই থাক না কেন ক্যালিবানের, সেই দুর্বৃত্ত যে নায়ক হবে এ তো সম্ভব ছিল না। ক্যালিবানেরও চোখ ছিল মিরান্ডার ওপর, যেমন হীথক্লিফের আছে ক্যাথারিনের ওপর। কিন্তু কত তফাৎ। ক্যালিবান জন্তু, হীথক্লিফ নায়ক। নায়ক হবার জন্য কেবল প্রেম প্রকাশ করে নি হীথক্লিফ; যে-যোগ্যতার অভাবের দরুন সে খারিজ হয়ে গিয়েছিল ক্যাথারিনের স্বামী হবার দাবি থেকে সেই যোগ্যতা সে সংগ্রহ করে নিয়েছে। একদিন উধাও হয়ে গেছে গ্রাম থেকে, তারপর কয়েক বছর পরে কালো স্যুট গায়ে চাপিয়ে, ভদ্রলোকের ভাষা শিখে নিয়ে এসে হাজির হয়েছে ক্যাথারিনের স্বামীগৃহে। বিত্ত-বেসাত প্রচুর করেছে। ক্যাথারিনের বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি— সব হাতিয়ে নিয়েছে, নিজের কূটবুদ্ধিতে। এ কেবল উপন্যাসেই সম্ভব, সাহিত্যের অন্য কোনো রূপকল্পে নয়। কেননা, আবারও স্মরণ করা যাক, উপন্যাস হচ্ছে বুর্জোয়া বিকাশের মুখপত্র। অর্থাৎ সেই যুগের যে-যুগ বলে জন্ম হোক যথাতথা, মুদ্রা থাকলেই হলো। মুদ্রা যে সংগ্রহ করতে পারবে সে-ই যোগ্য। আর্থিক পুঁজি প্রধান যোগ্যতা নয় হীথক্লিফের, কিন্তু হীথক্লিফ জানত যে অন্যসব গুণ মিথ্যে হয়ে যাবে পুঁজি যদি না থাকে। দৌড়ে গেছে তাই টাকার খোঁজে।
আরেক মহিলা, জেন অস্টেন, অনেকটা ভিন্নধর্মী এমিলি ব্রন্টি থেকে। অনেকটা কেন বলছি, অনেকে বলেন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। সময়ের দিক থেকে কিছুটা পূর্ববর্তী তিনি, দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও প্রাচীন। জেন অস্টেন ব্যবসা ও বাণিজ্য, কিংবা পেশাদারিত্ব এসবে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন শুধু জমিভিত্তিক মজবুত আভিজাত্যে। তাঁর ডার্সি মস্ত জমিদার। কিন্তু ডার্সিকে নায়ক হবার জন্য বাড়িতে ভালো একটা গ্রন্থাগার রাখতে হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, এলিজাবেথ বেনেটকে বিয়ে না-করতে পারলে তার নায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পেত না। এলিজাবেথ বেনেট কে? না, মধ্যবিত্ত ঘরের একটি মেয়ে। তার বাবার আয় সামান্য, সেই ভদ্রলোক বেশির ভাগ সময় কাটান বই পড়ে। বাড়িতে তাঁর পাঁচ-পাঁচটা বিবাহযোগ্য কন্যা। জমিদার ডার্সিকে কিছুটা নেমে আসতে হলো, যোগ্য পাত্রী পেল না সে আপন শ্রেণীতে। বিস্তর ছোটাছুটি করতে হলো তাকে, ঘোড়ায় চড়ে। এলিজাবেথের পালিয়ে-যাওয়া বোনটিকে উদ্ধার করে আনতে হলো প্রায় ছুটে গিয়ে। অহঙ্কারে কুলোবে না, সহনশীল হতে হবে। সেই যে বিখ্যাত উক্তি এলিজাবেথের ডার্সির অহঙ্কারী খালাম্মা লেডি ক্যাথারিনের মুখের ওপর— ‘ডার্সি ভদ্রলোক, আমিও ভদ্রলোকের মেয়ে বটে’— সে-উক্তির তাৎপর্যই বা ভুলি কী করে। এলিজাবেথের রয়েছে গণতান্ত্রিক যুগের আত্মপ্রত্যয়। এলিজাবেথ বিত্তবান নয়, কিন্তু ব্যক্তিত্ববান।
এই ব্যক্তিত্ব শেক্সপীয়রের রোজালিন্ড ও পোর্সিয়াদের ছিল, কিন্তু তার সবাই অভিজাত, এলিজাবেথ যা নয়। এলিজাবেথ অবশ্য উইকহাম কিংবা মিস্টার কলিন্স – কাউকেই বিয়ে করবে না, না-করার আসল কারণ এরা গরিব; কিন্তু তবু ধনবান ডার্সিকে কিন্তু সে বিয়ে করছে না, বিয়ে করছে ভদ্রলোক ডার্সিকে। ডার্সি কেবল ঘোড়া দাবড়ায় নি, বা প্রেয়সীর বোনকে উদ্ধার করে এনে দেয় নি, প্রেমপত্রও লিখেছে বটে। নিবেদনের সে-পত্র প্রত্যাখ্যাতও হয়েছিল প্রথমে। ডার্সির আছে চলমানতা। চলমান এলিজাবেথও ৷ ডার্সির প্রকাণ্ড বাড়িটাতেই উঠে আসবে এলিজাবেথ — শেষপর্যন্ত। যেন এ বাড়ি তারই, আগের কালে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে ধাক্কা খেতো। জব্দ হতো। আরেক জন মহিলা মালভোলিওকে পেতাম আমরা, এলিজাবেথ বেনেটকে না-পেয়ে।
নায়িকার প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন তাদেরকে এই সুযোগে লক্ষ্য করা যেতে পারে। ট্র্যাজেডিতে সাধারণত পুরুষরাই নায়ক হয়। সেই জগৎটা ভয়ঙ্কর রকমের পুরুষালি বলেই বোধ হয়। কমেডিতে মেয়েরা প্রাধান্য পেয়েছে, কিন্তু তবু তারা প্রধান চরিত্র হতে চায় নি। উপন্যাসেই প্রথম দেখি নায়িকারা প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষ। দায়িত্ব নিচ্ছে। সর্বোপরি তাদের প্রাধান্য বংশ-গৌরবের ওপর নির্ভর করছে না সব সময়ে, কখনও কখনও তারা প্রধান হচ্ছে যাকে চরিত্র বলে তার গুণে। ড্যানিয়েল ডিফোর মল ফ্ল্যান্ডার্সের কথা স্মরণ করা যায়। সে-মেয়ের পরিচয়ের ঠিক নেই। বারবার বিয়ে করে, ঘটনাচক্রে আপন ভাইকেই বিয়ে করে ফেলে একবার। প্রেমিক তার একাধিক। মল ফ্ল্যান্ডার্স চুরি করে, পকেট মারে। রাস্তাঘাটের এই রকম একটি মেয়ে নায়িকা হবে ভাবাটা কঠিন হতো এমনকি শেক্সপীয়রের মতো অসাধারণ কল্পনাসম্পন্ন মনীষীর পক্ষেও। অথচ কী অনায়াসে নায়িকা হয়ে যায় মল ফ্ল্যান্ডার্স। নিজের কাহিনী নিজেই বলে সে। যেন সেই অধিকার তার নিজস্ব। তারপরে করছে কী? যাচ্ছে চলে দূরদেশে, আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে। সেখানে গিয়ে চাষাবাদ করবে। সঙ্গে তার স্বামীদের একজন, চুরি-ডাকাতি করে যে লোক পয়সা করেছে প্রচুর। নতুন দেশে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী একত্রে খামার করে। দেখা যায় তার মা’ও কম যায় না। মা’ও সম্পত্তি রেখে গেছে কন্যার জন্য। তিন তিনটি স্রোত থেকে অর্থ চলে আসে— এসে নতুন জীবনের ভিত গড়ে দেয় মল ফ্ল্যান্ডার্সের জন্য।
এই মেয়ে যেন রবিনসন ক্রুসোর আপন বোন। রবিনসন যেমন দ্বীপে নিক্ষিপ্ত হবার পর নতুন জীবন শুরু করেছিল, হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ না, করে; মল ফ্ল্যান্ডার্সও তাই করছে। নতুন যুগের মানুষ তারা— উভয়েই। রবিনসন বন্দি থাকতে চায় নি তার গৃহে। যে জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা এসেছে তার জীবনে। রবিনসনও নায়ক হতো উপন্যাসের— যদি নির্জন দ্বীপের না হয়ে সমাজের বাসিন্দা হতে পারত। অথবা রিচার্ডসনের প্যামেলার কথা ধরা যাক না কেন। প্যামেলার কাহিনী নিয়েই প্রথম যথার্থ উপন্যাস লেখা হয়, ইংরেজি ভাষায়। তার পরিচয়টাই বা কী? না, সে গৃহভৃত্য। গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর বাড়ির ছেলে লাগল তার পেছনে। লাগবেই তো, লাগাটাই স্বাভাবিক। পিছু ছাড়ে না, ধাওয়া করে। শেষ পর্যন্ত লোকটি বলল, প্যামেলাকে সে বিয়ে করবে। বিয়ে করলও। দেখা গেল গুণের পুরষ্কার আছে। স্বামীই এখন নির্ভর করছে স্ত্রীর ওপর। চাকরানী নায়িকা হয়ে গেছে উপন্যাসের। কেবল তাই নয়, নিজের কাহিনী নিজেই বলছে প্যামেলা, চিঠির মাধ্যমে। ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতাব্দী ভদ্রলোকদের কাল, সেকালে এই যে সামান্য রাস্তা-ঘাটের মেয়েরা (এবং ছেলেরা) নায়ক-নায়িকা হয়ে যাচ্ছে উপন্যাসের, এর কারণ এক ধরনের গণতান্ত্রিক চেতনা বিকশিত হয়েছিল সেই সমাজে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করল তার নিজের আত্মবিকাশের পথে পথে।
দরকার চলমানতার। উপন্যাস চলমান জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে ঔপন্যাসিক ফিলডিঙ ভিন্ন প্রকৃতির। মানবিক গুণ বলতে তিনি নীতিশাস্ত্রের অনুসরণ যত না বুঝেছেন তার চেয়ে বেশি বুঝেছেন হৃদয়ের উষ্ণতা। কিন্তু নায়ককে চলমান রাখার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ রিচার্ডসনের তুলনায় মোটেই কম নয়। যাতে অবাধে মিশতে পারে সকলের সঙ্গে, চলে যেতে পারে ভৃত্য পাড়ায়, ছুটে যেতে পারে লন্ডনে— সেজন্য ফিলডিঙ তাঁর নায়ক টম জোনসকে পড়ে-পাওয়া শিশু হিসেবে খাড়া করলেন। বৈধ সন্তান হলে আটকে যেত নায়ক, যেমন তার ‘ভাই’ বৈধ রিফিল আটকে গেছে এবং বদ্ধ দশায় অতি নিকৃষ্টমানের প্রাণী হয়ে উঠেছে। স্মরণীয় যে, রবীন্দ্রনাথও তাঁর ‘গোরা’কে কুড়িয়ে-পাওয়া বালক হিসেবেই উপস্থিত করেছেন। গোরা জানত না, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে, তার রক্ত আইরিশ বলেই সে অমন অস্থির, অমনভাবে ভারবর্ষকে খুঁজে ফেরে সে ভারতবর্ষে। খোঁজে বলেই বড় সে। রবীন্দ্রনাথের কুমু মুক্তি চেয়েছিল, সে জন্য সে বিয়ে করল মধুসূদনকে। তার ভাই তাকে মুক্তি দিতে পারে নি, স্বামী তো পারবেই না।
টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ মস্কোতে এসেছিল রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে। সেই আসাটাই কাল হলো তার। রেল স্টেশনে দেখা ভ্রনস্কির সঙ্গে। আন্নার মন বলছিল দেখাটা শুভ হবে না, হলোও না। তারপর আন্নাকে দেখি আর স্থির নেই। ভ্রনস্কি তাকে অনুসরণ করছে ছায়ার মতো, আর আন্না নিজেও অতৃপ্ত বটে। ঘর ছাড়ল আন্না, ঘর আর পেল না ফিরে, তারপর থেকে কাল যাপন হোটেলে-হোটেলে। একসময় যখন ঘর বেঁধেছে গ্রামে গিয়ে তখনও হোটেলেরই বাসিন্দা সে। টলস্টয়ের আন্নার তুলনায় অতিসামান্য মেয়ে ফ্লবেয়রের মাদাম বোভারি। মফস্বলের অসফল এক ডাক্তারের স্ত্রী। কেবলই রোমান্স চায়। নিজেকে কল্পনা করে নায়িকা হিসেবে। সেই তাড়নায় ছুটে-ছুটে বেড়ায়। তারপর যখন দেখে সকলেই ঠকিয়েছে তাকে, আটকা পড়ে গেছে সে জালে, তার জন্য তখন আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথই রইল না খোলা। টলস্টয়ের নায়কেরা অনেকেই তীর্থযাত্রী। ‘যুদ্ধ ও শান্তি’র সেই চশমাপরা থপ-থপে যুবক পীয়রকে দেখি জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে, চিন্তায় নয় কেবল, ঘটনাতেও। ডন কুইকজোটই যেন সে, নতুন প্রজন্মের। ‘আন্না কারেনিনা’র লেভিনও তাই। ‘পুনরুত্থানে’র নায়ক প্রিন্স নেখলুদয়েভ তো শ্রেণীই ত্যাগ করল নিজের, অনুশোচনায় ও গ্লানিতে। দেখি, যে- মেয়েকে ‘পতিতা’ করেছে সে, তার পিছু পিছুই ঘুরছে, চলে গেছে, সূদূর সাইবেরিয়াতে।
এও নায়কেরই ঘোরা। ঘুরতে হয়, চলতে হয়, মুখোমুখি হতে হয় নতুন নতুন অভিজ্ঞতার, তাতে তারা পরিবর্তিত হয়, যেমন ঘটনাগুলোও নতুন তাৎপর্য পেয়ে যায় তাদের জীবনে ঘটে গিয়ে। এসবই সম্ভব হয় তারা নতুন বুর্জোয়া ব্যবস্থার মানুষ বলে। পেছনে থাকে একটা জরুরি প্রয়োজন; মিলবার, মিলিত হবার তাড়া। উপন্যাস বুর্জোয়া সমাজের সাহিত্যিক মুখপত্র বটে, সামন্তবাদী সমাজের নয়। সাহিত্যের সৃষ্টি সহানুভূতি থেকে, ঔপন্যাসিক সহানুভূতির ক্ষেত্রটি বড়, নাটকের ক্ষেত্রটির তুলনায়। উপন্যাস হচ্ছে আধুনিক যুগের মহাকাব্য। তার নায়ক-নায়িকা রাজা বাদশাহ নয়, সাধারণ মানুষ। আর ওই যে তার আকাঙ্ক্ষা মিলিত হবার সেখানে সে সমাজতান্ত্রিক।