ঈদ শব্দের অর্থ উৎসব। মাস গণনাতে রমাদান বা রমজান পরবর্তীতে শওয়াল মাসের প্রথম চাঁদ দেখার পর এ উৎসবের দিনটি শুরু হয়। উৎসব শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে সমারোহ, আমোদ, আড়ম্বর, অনুষ্ঠান, সমাবেশ ইত্যাদি সব জাঁকজমক শব্দ। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য প্রকাশ করতে যে আনন্দ অনুষ্ঠান বা উদযাপন আমরা করি, তাই হলো উৎসব। ইংরেজি প্রতিশব্দ ফেস্টিভ্যাল, ওকেজেন, ইত্যাদি।
কিন্তু কোনো উৎসবই একলা উদযাপন হয় না। উদযাপনের জন্যে মানুষ চাই। পৃথিবীর প্রাচীনতম উৎসবগুলোর বেশিরভাগই শুরু হয়েছিল ধর্মকে কেন্দ্র করেই। তবে শুরুটা ধর্মকে মাধ্যমে হলেও এর একটা বেশ বড়সড় অংশের সঙ্গে ধর্মের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সম্পর্ক আছে একেকটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভূগোল ইত্যাদির সাথে। একেক সমাজে একেক রীতি একেক নীতি, তবে উৎসবের মূল ভাবটা সমান। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন রকমের ঈদ বা উৎসব পালন করা হয়। ঈদ শব্দটি প্রাচীন হিব্রু থেকে আরামিক হয়ে বিদেশী শব্দ হিসাবে সিরিয়া থেকে আরবের আরবিতে প্রবেশ করেছে। এর আভিধানিক অর্থ উৎসব। বাংলা ভাষায় শব্দটি আরবি থেকে এসে বর্তমানে বাংলা শব্দ হিসাবেই তার স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। যদিও মুসলিম ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদের আগমন , তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এটির একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে।
সুপ্রাচীন ধর্মীয় উৎসব হিসাবে আকিতু বা আকিতুম হলো একটি বসন্ত উৎসব। যা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় নিসান মাসের প্রথমে বার্লি বপন উদযাপনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাবিলনের সকল প্রধান মন্দিরেই দশ দিন ব্যাপী বার্ষিক এই ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। এসব অনুষ্ঠানে সৃষ্টিকাহিনী গানে গানে বর্ণনা করা হতো। বিশেষ করে সূর্যদেব মারদুকের মহিমাকীর্তনের জন্য আয়োজিত উৎসব আকিতুতে।
ব্যাবিলনীয় এই উৎসব ঐতিহ্যগতভাবে আউইলু (উচ্চ শ্রেণী), মুসকেনা (মধ্যবিত্ত), ওয়ারডু (নিম্ন শ্রেণি), মহাযাজক এবং রাজাসহ শহরের সমস্ত লোক উদযাপন করত। যদিও এগুলোতে অশ্লীলতা ও নিষ্ঠুরতা পূর্ণ বিভিন্ন রীতিনীতির প্রচলন ছিল। হিব্রু ক্যালেন্ডার ব্যবিলনীয় সভ্যতার কাছে ভীষণ ভাবে ঋণী। বিভিন্ন ব্যাবিলনীয় এবং হিব্রু ক্যালেন্ডারে নিসান হল বার্লি পাকার মাস এবং বসন্তের প্রথম মাস। মাসের নামটি একটি সুমেরীয় আক্কাদিয়ান ভাষার নিসাগ বা প্রথম ফল থেকে এসেছে। হিব্রু ক্যালেন্ডারে এটি ধর্মীয় বছরের প্রথম মাস, যাকে নিসান বা বছরের প্রথম মাস বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আরবে শুরু হয়েছিল ওকাজ উৎসব। মূলত কবিতা আবৃত্তি ও বাগ্মিতাকে কেন্দ্র করেই মক্কার অদূরে ওকাজ নামক স্থানে এ মেলার সূচনা হয়েছিল। সে সময় ওকাজ মেলায় কবিতা ও সাহিত্যের আসর বসত। বিজয়ীদের কবিতা ও সাহিত্যগুলো দেয়ালিকার মতো কাবা ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। ওকাজ মেলাটি ধীরে ধীরে প্রাক ইসলামি যুগে অনৈতিকতা ও সামাজিক কুসংস্কার আর নোংরামির চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।
প্রাক ইসলামি যুগে মক্কায় যেমন ছিল ওকাজ উৎসব, তেমনিভাবে ইয়াসরিবে ছিল দু’টি বাৎসরিক উৎসব। শরতের পূর্ণিমায় পালিত নওরোজ উৎসব। আর বসন্তের পূর্ণিমায় পালিত মিহিরজান উৎসব। এই দু’টি দিবসে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়েই পালিত হয়ে আসছিল। যতক্ষণ না রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়াসরিবে আগমন করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আসার পর তাকে যখন সবাই এক বাক্যে নেতা বলে ঘোষণা দিল, তখন ইয়াসরিববাসী শহরটার নাম দিল মদীনাতুন্নাবী বা নবীর শহর, সংক্ষেপে মদীনা বা শহর। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন মদিনাবাসী বছরে দু’টি দিবসে আনন্দ উল্লাস করে থাকে। রাসুল মুহাম্মাদ (সা.) জানতে চাইলেন, দিবস দুটি কী? তারা জানাল, নওরোজ ও মিহিরজান। নওরোজ বা নববর্ষ অর্থাৎ সৌরবর্ষের প্রথম দিন এবং মিহিরজান বছরে যখন রাত্রি-দিন সমান হয়। তিনি দেখতে পেলেন নওরোজ ও মিহিরজান এই উৎসব দু’টির রীতি-নীতি, আচার অনুষ্ঠান ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলামের আদর্শ পরিপন্থী।
নওরোজ বা নববর্ষ পালনের উৎস আর মেহেরজান পারস্যের অগ্নি উপাসক তথা মজুসিদের থেকে গ্রহণ করা সুর্য ও অগ্নি কেন্দ্রিক ধর্মীয় উৎসব। পারস্যের অগ্নিপুজক জরথুস্ত্রবাদীদের কাছ থেকে এটি গ্রহণ করার ফলে এতে অগ্নিক পুজাসহ আরবের প্রচলিত বিভিন্ন অমানবিকতা ও অশ্লীলতা যুক্ত ছিল। ছয় দিনব্যাপী এই উৎসবের মধ্যে মাত্র একদিন ছিল সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট। বাকি পাঁচ দিন ছিল সম্ভ্রান্ত বা ধনী শ্রেণির মানুষের জন্য নির্ধারিত। এজন্য গরিব শ্রেণির মানুষ পাঁচ দিন আনন্দ অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। ঠিক একইভাবে ছয় দিনব্যাপী মিহিরজান উৎসবেও শুধুমাত্র একদিন সাধারণ দরিদ্র মানুষেরা উপভোগ করতে পারত। শ্রেণী বৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য এবং অমানবিকতা ও অশালীনতায় ভরা ছিল ওই উৎসব দু’টি। এই উৎসবগুলোতে দাস কেনাবেচা, কন্যা সন্তান বলীর মাধ্যমে উৎসর্গ করা বা জীবন্ত কন্যা সন্তানকে মাটিতে পুঁতে ফেলার মতো অমানবিক রীতি প্রচলিত ছিল। এমনকি নারীদের যৌনপণ্য হিসাবে ব্যবহার করা হতো। সুস্থ সুন্দর মানবিক উৎসব পালনের অভাব ছিল এই উৎসবগুলোতে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই অমানবিকতা ও অশ্লীলতা বন্ধের নির্দেশ দিলেন। ঘোষণা দিলেন ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের এর পরিবর্তে আরও উৎকৃষ্ট দু’টি দিন দান করেছেন- একটি ঈদুল ফিতরের দিন, অপরটি ঈদুল আজহার দিন।’ (আবু দাউদ ১১৩৪।) এরই প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কথা মতো মদীনাবাসীরা নওরোজ ও মিহিরজান উৎসব বাদ দিয়ে বছরে দু’টি ঈদ উৎসব পালন শুরু করে। হিজরির দ্বিতীয় সাল থেকেই রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর উৎসব উদযাপনের সূচনা হয়। তারপর শুরু হয় ঈদ-উল-আজহা উদযাপন। এভাবেই শুরু হলো বছরে দু’টি ঈদ উদযাপন। এর ফলে জন্ম নেয় শ্রেণী বৈষম্য বিবর্জিত মদীনাতে মুসলিম, প্রতিমা পুজক, অগ্নী পুজক ও ইহুদী সবার মধ্যে এক সর্বজনীন আনন্দ উৎসব উদযাপনের সংস্কৃতি। এর ফলে জন্ম নেয় শ্রেণী বৈষম্যহীন, সাম্য, মৈত্রী ও অশালীনতামুক্ত একটি মুসলিম সমাজ।
মুসলিমদের ধর্ম গ্রন্থ আল কুরআনে ঈদ শব্দটি এসেছে আল্লাহর নিদর্শন হিসাবে। ইহুদীদের জন্য প্রেরিত নবী ও রাসুল মরিয়ম তনয় ঈসা বলল, ‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যপূর্ণ পাত্র প্রেরণ করুন, এটা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্য হবে ঈদ আনন্দোৎসব এবং আপনার পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন।’ (সুরা মায়িদা ১১৪) ঈসা (আ.) এর পরবর্তী নবী ও রাসুলুল্লাহ মুহাম্মদ (সা.) শিখিয়ে গেছেন ঈদ কি ও কেন। তাঁর দেখানো ইসলামি দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যদি আমরা ঈদ উদযাপন করি তবে একদিকে যেমন ঈদের অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে আমাদের পার্থিব জীবন অন্যদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত হবে আমাদের পরকালীন জীবন।
হিজরি বর্ষপঞ্জী অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। ঈদ-উল-ফিতর বা সওম ভাঙার উৎসব ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দু’টো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর একজন সিয়াম পালনকারী মুসলিম পুরুস্কার প্রাপ্তির জন্য অনন্দিত হয়ে উৎসব পালন করেন। ঈদ-উল-ফিতরের দিন এই উৎসব পালনের জন্য প্রথমেই ঈদের দিন গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করে, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করার জন্য নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করে, সুগন্ধি মেখে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সামান্য কিছু পানাহার করা সুন্নাহ। এরপর সমাজের সকলের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে আল্লাহর বড়ত্ব বা তাকবির দিতে দিতে রওনা হতে হয় ঈদ জামাতে সালাত আদায়ের উদ্দশ্যে।
ঈদ-উল-ফিতরের আর একটি মহান বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের প্রতিটি হতদরিদ্র মানুষও যেন ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সে লক্ষ্যে ঈদের সালাতের পূর্বেই আবশ্যিক দান হিসাবে সদাকাতুল ফিতর আদায় করা। ফিতরা বা সদকাতুল ফিতর হলো নির্ধারিত সদকা, একে যাকাত-উল-ফিতরও বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সওম বা রোজা পালনকারীর জন্য সদকাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন, যা সওম পালনকারীর অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ পরিশুদ্ধকারী এবং অভাবী মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা (আবু দাউদ: ১৬০৯)। আর এই দানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি। সেটাই দান করতে হবে (বুখারি ১৯৭৪)।
দান করতে করতে যেতে হয় বৈষম্যহীন একটি সমাজে, যেখানে ধনী-দরিদ্র একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্যাম্যের এক অপরূপ নিদর্শন সৃষ্টি করে। যার সাথে পায়ে পা আর কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ আগেই হয়ত একেই ফিতরা দান করেছে। ঈদের প্রকৃত অর্থ শুধু দামি, রঙিন জামা, হরেক রকম মুখরোচক খাবার আর নানা ধরণের খেলাধুলা এবং আনন্দ-উৎসব নয়। ধনী গরীবের এক কাতারে সালাতে দাড়ানো শুধু ঈদ নয় বরং তাদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনাও ঈদের উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দেখানো নিয়মে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি করতে একে অপরকে শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানানোয় একপথ দিয়ে যাওয়া ও অন্যপথ দিয়ে আসা। ধর্ম-বর্ণ শ্রেণীভেদ না রেখে সবার জন্য দুআ ও আভিবাদন, ‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। যেন উভয় পথে বেশি সংখ্যক লোকেদের সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। আল্লাহ কুরআনে কারিমে বলেছেন, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতিম, মিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ [সূরা নিসা : ৩৬]।
ঈদ মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। মুসলিম হিসাবে আমাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি রয়েছে। ঈদ পালনে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব বিনোদন বা সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত না হয়ে বর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। ঈদ উৎসবের মধ্য দিয়ে যেখানে মুসলিমরা ধর্মীয় ও সমাজ জীবনের সাম্য মৈত্রীর সন্ধান লাভ করবে, সেখানে উল্টো ঈদ উদযাপনের নামে বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। বিভিন্ন নিয়ম আর বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা কোনোভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই’ (সূরা বনি ইসরাঈল ২৬-২৭)। জুয়া খেলা ও মাদক গ্রহণ করা এগুলো ইসলামবিরোধী কাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফল হও’ (সূরা মায়িদা: ৯০)। ঈদের পবিত্রতা ম্লান হয়ে যায় যখন দেখা যায় ঈদ উৎসব ও ঈদ মেলার নামে অশ্লীলতা-বেহায়াপনার মেলা বসে। তরুণ-তরুণীরা নানারকম আপত্তিকর পোষাকে চলাফেরা করে। ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আটকে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। ঈদের সময়ে একশ্রেণীর অতি আধুনিক তরুণ বাড়িতে, রাস্তার ধারে ও বিভিন্ন ক্লাবে বড় বড় রাস্তার মোড়ে কান ফাটানো শব্দযন্ত্র বসিয়ে বিদেশি গানের আয়োজন করে থাকেন, বিষয়টি যে শুধু ইসলামবিরুদ্ধ তা নয় বরং এতে অন্য অনেক মানুষের ক্ষতিও হয়ে থাকে। তাদের খেয়ালই থাকে না অসুস্থ ও শিশুদের দিকে। অথচ হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুসলিম সেই ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্যরা নিরাপদ’ (বুখারি ৬৪৮৪)। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ অশ্লীল নাটক-সিনেমা সম্প্রচার করে। সিনেমা হলগুলোতে নতুন নতুন ছবি জাঁকজমকে প্রদর্শিত হয়। মনে হয় এরা যেন অশ্লীলতার জন্য ঈদের মতো একটি সময়েরই প্রতীক্ষায় ছিল এতদিন! অনেক সময় চলে সালামের নামে সালামীর বাড়াবাড়ি, যা কখনো কখনো স্ট্যাটাসের নামে চূড়ান্ত অপমানের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ঈদের দিন উপলক্ষ্য করে গান-বাজনা, অবাধে নারী-পুরুষ বিচরণ ইত্যাদির আয়োজন থাকে এমন মেলা আয়োজন করা, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা দেওয়া স¤পূর্ণ হারাম। ঈদের যাবতীয় আনন্দের সবটুকু যেন হয় আল্লাহর দেওয়া সীমারেখার ভেতরে, নয়ত উল্টো তা পরম করুণাময়ের আভিশাপের কারণই হবে। একটি মাস আল্লাহর বিধান মেনে চলে পুরস্কার প্রদান দিবসে তাঁর অবাধ্যতা করার চেয়ে নিকৃষ্ট কাজ আর কী হতে পারে? কাজেই এ নিয়ামতের দিন তাঁর কোনো অবাধ্যতা যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এসব অপসংস্কৃতিকে পরিত্যাগ করে আমরা যদি সত্যিকার সুস্থ সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ধারণ করতে পারি তাহলে আমাদের সার্বিক জীবন সুন্দর ও পবিত্র হয়ে উঠবে।
ইসলামের সর্বজনীন উৎসব ঈদ। সব ধরনের কৃত্রিমতা ও লৌকিকতার মুখোশ ঝেড়ে ফেলে অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠার আহ্বান জানায় ঈদ। রামাদান যেভাবে আত্মশুদ্ধি ও সাম্যের বার্তা নিয়ে হাজির হয় একইভাবে ঈদ বয়ে আনুক সম্প্রতির সুমহান বার্তা। ঈদ হোক আমাদের জীবনের নিত্যসাথী। ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যাক সকল ভেদাভেদ, পাপ ও পঙ্কিলতা। আমাদের এ ব্যস্ত জীবনে ঈদের দিন নিজেদের আপনজনদের সঙ্গে মেলামেশার অপূর্ব সুযোগ। অসুস্থ কিংবা বয়স্কদের কাছে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নেয়াই আমাদের দায়িত্ব। ঈদের এটুকু সামাজিক ভালোবাসাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে অনেকদিন। ইসলামের সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ঈদ মানুষের মধ্যে ধনী-দরিদ্র, বর্ণ-গোত্র, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য ও উঁচু-নিচুর ভেদাভেদের ভুলিয়ে দিয়ে এক কাতারে শামিল করুক।
লেখক: গবেষক