ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা হলো, আমাদের বাংলাদেশটি কৃষি নির্ভরশীল একটি দেশ হিসেবেই পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিত। এটি আজকে থেকে নয়। প্রাচীনকাল পেরিয়ে মধ্যযুগ পেরুলো, এরপর বৃটিশ শাসনামল পেরিয়ে এই এখনো পর্যন্ত ওই পরিচয়ে কেবল পরিচিতই নয়, সমাদৃতও বটে। ধান, গম, পাট, যব, আলু, ভুট্টা ইত্যাদি নানানরকম ফসল সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার ভূমিতে চাষবাস হয়ে আসছে। তবে সব ফসলের আবির্ভাব কিন্তু একসাথে হয় নি। কোনোটার বাপ দাদারা এদেশেরই, আবার কোনোটা এসেছে শাসকদের হাত ধরে। তেমনি এক শস্য আলু। এই আলু আমাদের নয়- ভাবতেই অবাক লাগে না!
আলুর পূর্বপুরুষ ভিন দেশের । আলু আরেক দেশ থেকে আমাদের দেশে বেড়াতে এসে মুগ্ধ করে ফেলেছে আমাদের মনটিকে, জায়গা করে নিয়েছে আমাদের খাদ্যাভাসে। নিত্যদিনের মূল খাদ্যতালিকায় আলুর ব্যবহার নেই এমন বাঙালি পরিবার খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। যারা আলুকে বাছাই করছেন না তারা হয়ত ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে গেছেন। মজা হলো, সেক্ষেত্রে ঘরে বাজার না থাকলে রাঁধুনি নিজেও তখন দ্বিধায় পড়ে যান কি দিয়ে কি রাঁধবেন!
চলুন আলুর সঙ্গে একটু ভালো করে পরিচিত হওয়া যাক। আলু বহুল প্রচলিত উদ্ভিজ্জ খাদ্য। এটি এক প্রকারের কন্দজাতীয় সবজি। কন্দজাতীয় সবজি বলা হয় যেসব সবজি মাটির নিচে জন্মে, তাদেরকে। এটি উইকিপিডিয়ার স্বীকৃত কথা। কিন্তু সংকট তৈরি হয়েছে এখানেই যখন আলুকে সবজি বলা হচ্ছে। আমার এক স্যারের কাছে গল্প শুনেছিলাম, তাঁর অফিস সহকারীর হার্টের রক্তনালী বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কিছু আছে বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায়, বাইপাস করতে হবে। করেও এসেছে। স্যার নিজেও কিছুদিন আগে বাইপাস করে এসেছেন। তাই তিনি তার অভিজ্ঞতা যেখানে প্রয়োজন মনে করছেন সেখানেই বিলাতে শুরু করেছেন। যদি কাজে লেগে যায়! স্যার তাঁর সহকারীকে ডেকে বললেন, কি অবস্থা তোমার? এরপর আদ্যপ্রান্ত শুনে সিদ্ধান্ত জানালেন, তোমাকে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত হাঁটবে এবং বেশি করে সবজি খাবে। তোমার জন্য এটাই আমার প্রাথমিক নির্দেশনা।
তো মাস দুয়েক পর স্যারের সাথে ছেলেটির দেখা। ছেলেটি তখন শরীরে আগের তুলনায় প্রায় পাঁচ সাত কেজি ওজন যুক্ত করেছে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার! তোমাকে বলেছি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে তুমি তো দেখি আরো মোটা হয়ে গেছ। বল তো দেখি কি কি খাও? কি কি খাচ্ছ ?
ছেলেটি খুব স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিল আপনে তো সবজি খাইতে বলছেন তো, আলু খাই সব বেলায়ই।
স্যার আঁতকে উঠলেন, সর্বনাশ করেছ!
বিষয়টা হলো আলুকে যেহেতু স্বীকৃতভাবে সবজি তালিকায় ফেলা হয়েছে তো ওই ছেলে কি করবে, সর্বনাশ তো এখানেই ঘটে গেছে।
পৃথিবীর প্রায় চল্লিশটি দেশে প্রধান খাদ্য হিসেবে আলুর স্বীকৃতি রয়েছে। তথ্যগুলো আরো বলছে আলু বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রচলিত সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য। এর আগে রয়েছে যথাক্রমে ভুট্টা, গম এবং চাল। বাংলা শস্য পঞ্জিকাতেও খাদ্যশস্য আর সবজির মাঝে এরকম এক দোটানা অবস্থানে আলুকে বসানো হয়েছে। তো চাইলে একে খাদ্য শস্যের তালিকার নিম্নস্তরে ফেলা যাবে আবার চাইলে সবজিতেও উর্দ্ধস্থান দেয়া যাবে।
দুপুরে একসাথে সবাই খেতে বসেছি। এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম কি দিয়ে লাঞ্চ করবেন, কি এনেছেন বাসা থেকে?
সহকর্মীর সহজতর উত্তর, ভাত দিয়ে ভাত খাই। তিনি আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন।
২০০৭ সালে উৎপাদনের আধিক্যতা বলে দিয়েছে ‘বেশি করে আলু খান/ ভাতের উপর চাপ কমান’। মানে বেশি বেশি আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে মাছে ভাতে বাঙালিকে মাছ আর আলু মিলে বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে মাছালু বাঙালি। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ২৩ কেজি করে আলু খায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা কেন্দ্রের এক যৌথ গবেষণা বলছে, গত পাঁচ যুগে বাংলাদেশে নীরব আলুবিপ্লব ঘটে গেছে। তবে দেশে দেশে প্রধান খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতা পাক কিংবা অভ্যন্তরে আলুবিপ্লব ঘটুক, কিন্তু এখনো বাঙালির মনে উচ্চ শ্বেতসারবিশিষ্ট আলু ভাতের জায়গা নিতে পারে নি।
কৃষকদের অন্তঃকরণে আলু চাষাবাদের ইতিহাসটা আরেকটু পুরনো। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পেরু থেকে স্পেনিয়দের মাধ্যমে আলু প্রথমে উত্তর ও পূর্ব ইউরোপে পরবর্তীতে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৬শ’ শতকে এই আলু সারা বিশ্বে খাদ্যফলন হিসেবে জায়গা করে নিতে থাকে। ধারণা করা হয়, সতের শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগিজ নাবিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আলু নিয়ে এসেছিল। ভিন্নমতও আছে। সে মতামত জানাচ্ছে, আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বৃটিশ শাসন শোষণের হাত ধরে তামাক, ভূট্টা, কাজুবাদাম, আনারস, পেঁপের সাথে সাথে আলুর বসবাস শুরু হয় এই উপমহাদেশে। ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা থেকে বোম্বেসহ অন্যান্য প্রদেশগুলোতে আলু চাষের বিস্তারে ভূমিকা রাখেন। সে সময়ে এটি মুন্সিগঞ্জ জেলা হয়ে আমাদের বাংলার শস্য ফলনে জায়গা করে নেয়। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুটিকয়েক এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট ও রংপুর জেলা আলু চাষে এগিয়ে রয়েছে।
তবে কৃষকদের মাথায় কিন্তু আলুর পুষ্টিগুণের ভাবনাটা আসে নি। এসেছে সহজ ফলন ও সংরক্ষণ সুবিধার ফলে একটু লাভের মুখ দেখা যায় বলে। সেকারণেই কৃষকরা চাষাবাদে আলুকে আপন শস্যের স্থান দিয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০২ সালে বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ টন। আর ২০১৩ সালে হয়েছিল ৮৩ লাখ ২৬ হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন। এদিকে সরকারি হিসেবে আলুর উৎপাদন বাড়তে বাড়তে ২০২০-২১ উৎপাদন বর্ষে প্রায় ৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১ কোটি মেট্রিক টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়। বাংলাদেশে বাৎসরিক চাহিদা রয়েছে ৬০-৭০ লক্ষ টনের মতো। তাই বলে মনে করার কারণ নেই যে বাড়তি সবটুকু আমরা রপ্তানি করে ফেলি। তবে এখানে আবার একটি পানি সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের আলুর মধ্যে পানির পরিমাণ বেশি। ভিনদেশিরা বেশিরভাগই পানি মিশ্রিত আলু পছন্দ করেন না। আমাদের দেশে উৎপাদিত আলুতে পানির পরিমাণ বেশি থাকার কারণে এটি সহজে পচনশীলও হয়। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলছিলেন, বাংলাদেশে আলুতে পানি থাকে ৮০-৮২ শতাংশ। ইউরোপের দেশগুলোতে উৎপাদিত আলুতে পানির পরিমাণ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। রোগবালাই মিশ্রিত নিুমানের আলু উৎপাদন হওয়ায় খুব অল্প পরিমাণ আলু আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছিল। সেটি এখন কমতে কমতে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৫৬ হাজার টনে নেমেছে। একটু পরে হলেও কৃষি বিপ্লবের ছোঁয়ায় ১৯৮০ এর দশকের পর থেকে এদেশে আলুর উন্নত বীজ আমদানি শুরু হয়। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে আরো বেশি পরিমাণ জমিতে চাষের জন্য উন্নত বীজ আমদানির মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও বিএডিসি জৈবপ্রযুক্তি তথা টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগমুক্ত চারা ও বীজ আলুর উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ঠাণ্ডা ও আর্দ্র জলবায়ু আলু চাষের জন্য উপযুক্ত। কৃষকরা তাদের পর্যবেক্ষণে এটিকে দোঁয়াশ ও বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে শীতকালীন শস্য ভূমিতে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। নভেম্বরের প্রথম পনের দিনের মধ্যেই মাঠের পর মাঠ ফসলের ভূমিতে আলুর চাষ দেখা যায়। শীত শেষ হতে হতে ফেব্রুয়ারি-মার্চে কৃষকরা ঘরে তোলেন এই শস্য। যেখানে ইউরোপের দেশগুলোতে আলু পরিণত হতে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগে, সেখানে বাংলাদেশে লাগে মাত্র তিন মাস। বাংলার মাটি, পানি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাওয়ায় আলুর উৎপাদন সময়কাল কমেছে, ফলনও বেড়েছে। মেঘমুক্ত আকাশ ও তাপমাত্রা সঠিক থাকলে আলুর গড় ফলন বছরে ১০-১৫% বেড়ে যায়।
ফলন বেড়ে যাক বা কমে যাক তাতে কৃষকের অর্থনীতি খুব একটা হেরফের হয় না। ২০২১ সালের হিসাবে প্রতি কেজি আলুতে উৎপাদন খরচ ৯ টাকা ৩৭ পয়সাসহ বস্তা কেনা, পরিবহন ও হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ভাড়া সব মিলিয়ে খরচটা দাঁড়ায় ১৬ টাকার ওপরে। পাইকারিতে আলু বিক্রি হয়েছে ১০-১২ টাকা এবং খুচরায় ১৪-১৬ টাকা। মাঠ পর্যায়ে কৃষক দাম পেয়েছেন প্রতি কেজি ৮-৯ টাকা। কৃষকের তখন মরণদশা হয়েছিল। আবার কখনও কখনও আমরা ভোক্তারা কিন্তু ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরেও আলু খেয়েছি। তখনও কৃষকগণ ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিএডিসির এক প্রকল্প পরিচালক দেশের স্বনামখ্যাত এক দৈনিকে বলেছিলেন, রপ্তানি এবং শিল্পে ব্যবহার উপযোগী গুণাবলি না থাকায় আলুর বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কিছু সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, আলু ক্ষেত থেকে তোলার পর পরিস্কারের জন্য বাংলাদেশের কোথাও ওয়াশিং মেশিন নেই। বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আলু নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। রোগমুক্ত আলু উৎপাদনের জন্য পদ্ধতি জানা নেই কৃষকের। কিন্তু এখানে কৃষকের দায় কোথায়! কৃষক তার সোনা ফলানো হাতে মাটি ফুঁড়ে বের করে আনছে ফসল। এর বহুমুখি ব্যবহার, পুষ্টিগুণ, রপ্তানি তো তার হাতে না। তাহলে কে নিশ্চিত করবে তার উৎপাদন খরচ রেখে লাভের হিসেব! কে নিশ্চিত করবে তার পেশার নিরাপত্তা!
মাটি, আবহাওয়া, তাপমাত্রা ও আলোক দিবসের ওপর ভিত্তি করে আলুর আকৃতির ভিন্নতা হয়। তাই একে গোল আলু বলা হলেও সব সময় এটি আসলে গোল থাকছে না। আকার-আকৃতিতে ভিন্নতা থাকলেও যুগ যুগ ধরে খাদ্যতালিকায় বাধ্যতামূলক খাদ্য হিসেবে আলু বাঙালির মনে স্থান করে নিয়েছে।
পথে বন্ধুর সাথে দেখা হতে, বললাম তোকে অনেক সুন্দর ও আত্মবিশ্বাসী লাগছে। কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছিস?
সাথে সাথে প্রত্যুত্তর, এত আলু দিস না, যেখানে যাচ্ছি সেখানে তো খাবারে আলু থাকবেই পথে আবার তুই দিয়ে দিচ্ছিস!
জানা গেল, তাদের অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘আলু দিয়ে আলোকময় ভূবন’। এটা আবার কি রকম অনুষ্ঠান রে?
বুঝলি না! মানুষজনকে আমরা তেল দিচ্ছি মানে তার যেসব বিষয় খারাপ সেগুলোকেও রঙ মাখিয়ে ভালো বানানোর চেষ্টা করছি অথবা তিনি যা বলছেন করছেন সব কিছুতেই ব্যাপক আকারে সায় দিয়ে যাচ্ছি। আর আমরা আমাদের অনুষ্ঠানে দিব আলু। ব্যক্তির ভিতরে থাকা সুপ্ত সুন্দর বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা। বাইরের বিষয়াদি নিয়েও প্রশংসা হতে পারে।
আমি বললাম আরে যেই তেল সেই তো আলু। ও ব্যাখ্যা দিল তেল মর্দনে অবান্তর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। যিনি তেল দিচ্ছেন তিনি তার অবস্থান, বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছেন নিজেকে। আলু দেয়ার ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। এখানে একেকজনকে নিয়ে ভালো ভালো বাক্য বলতে হবে, মানে আলুময় কথা। যেসব কথা হবে সত্য মেশানো। বলতে হবে উদ্দীপনা দিয়ে যাতে সে নিজেকে আবিস্কার করতে পারে। এই যেমন তুই আমাকে বলছিস সুন্দর ও আত্মবিশ্বাসী লাগছি, এই আত্মবিশ্বাসী কথাটা আমার আজকের সারা দিনের পাথেয় হয়ে থাকবে। এরকম আরো শব্দমালা খুঁজে বের করতে হবে। উদ্দীপনাময় শব্দ প্রয়োগের অনুশীলন বাড়াতে হবে। যাতে মানুষজন নিজেকে খুঁজে পায়। কাজে লাগাতে পারে সুপ্ত প্রতিভা। আর গুণ খুঁজে অন্যেকে প্রশংসা করলে দূরীভূত হয় নিজের মনের কালিমা, প্রশস্ত হয় হৃদয় কাঠামো।
তো কি শুধু আলু দেয়া নেয়া হবে নাকি আরো কিছু আছে?
অবশ্যই আছে, খাবার থাকবে সব আলুর তৈরি যেমন, সিদ্ধ আলু, ভাজা আলু, চটকানো আলু, আলুর রুটি, আলুর চপ, আলুর সবজি, আলুর সিঙারা, আলুর চিপস, আলু ফ্রাই, আলুপুরি, আলুর দম, ডিম আলু, আলু দিয়ে মাংসের ঝোল, মাছের ঝোল আরো আরো আরো অনেক কিছু।
আমার মাথায় তখন অন্য কথা, এত এত আলুর মেন্যুতে কি একই আলু ব্যবহার হয়? না। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে স্থানীয় আলুর সাতাশ ধরনের জাত আর উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ছত্রিশ ধরনের আলু চাষাবাদ করা হয়। বাবুর্চির ঠিকই জানা কোন্ খাবারে নতুন আলু নিবে, কোন্ খাবারে পুরান আলু নিবে।
কোনটায় লম্বাটা ব্যবহার করবে, কোনটায় কোণা ছড়ানোটা ব্যবহার করবে। নিত্যদিনের খাবারে যাবে রাসেল আলু; সালাদে, পিঠে, পায়েসে দিবে রাঙা আলু; হলদে আর বেগুনি আলু দিয়ে করবে রোস্ট ও গ্রিল। আবার ভাজাভাজিতে বেছে নিবে ফিঙ্গারলিং আলু, দমের জন্য বিশেষভাবে বেছে নিবে ছোট ছোট গোল আলু।
মোটা ডার্ক সার্কেলওয়ালা বন্ধুকে দেখেছি আলু খেতে। ওর স্থূলতা কমাতে সাহায্য করছে আলু। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফাইবারের দুর্দান্ত উৎস এটি। তাই হজমে সহায়ক এবং রক্তে শর্করার হার ঠিক রাখে। ত্বকের জন্যও ভালো। তাই দাগ কমাতে পাতলা করে কেটে ওর চোখের ওপর দিয়ে রাখতে দেখেছি। আলুতে ফাইবার, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ভিটামিন সি ও ভিটামিন বি৬ থাকায় কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করে করা সম্ভব হয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ কমায়, হার্টও সুস্থ রাখে। আলুতে থাকা ফোলেট ডিএন তৈরি ও মেরামত করায় ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। এছাড়া আলুতে থাকা ফাইবার কোলন ক্যান্সার মুক্ত করতে সাহায্য করে। আলুতে বিদ্যমান আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিঙ্ক হাড়ের স্বাস্থ্য গঠনে ভূমিকা রাখে। এছাড়া দাঁত, পেট, কিডনিসহ মস্তিষ্কটাই সুস্থ রাখতে আলুর ভূমিকা রয়েছে।
উপকারি আলু শস্য বাংলাদেশে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভামনাময় খাদ্য ফসল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে যে একক ফসল ও আয়তনের দিক দিয়ে ধান ও গমকে পেছনে ফেলে প্রায় চারগুণ বেশি আলুর ফলন হয় প্রতি বছর। কিভাবে এর ব্যবহার বাড়বে, কেমন করে এটি বৈদেশিক মুদ্রা আনবে এত কিছু না ভেবেও একটু জীবিকার আশায়, সামান্য একটু ন্যায্যমূল্যের লাভের আশায় কৃষক আপন জায়গা থেকে সরাতে চায় না আলুকে। প্রয়োজনে মৌসুমের আগেই আগাম শস্য হিসেবে পৌঁছে দিচ্ছে ভোক্তার দোরগোড়ায়।
কিন্তু পরদেশ থেকে আসা আলুকে কৃষকরা সহজে আপন করে নিলেও যুগ যুগ ধরে শরীর কিন্তু একে সহজ করে নিচ্ছে না। পেট ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, জ্বর, মাথাব্যথা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে এই আলু থেকেই। গবেষণার ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে এর কারণ। অতিরিক্ত সবুজ রং এবং গ্যাজ বের হয়ে যাওয়া আলু খেলে মানুষ এসব সমস্যার সম্মুখীন হয়। ক্যাকোনাইন ও সোলানাইন নামক নিউরোটক্সিক রয়েছে আলুতে। যা মানব শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। অতিরঞ্জিত কোনো কিছুই ভালো নয়। কথোপকথনে আলুর বাড়তি প্রয়োগও তেমনি সন্দেহের উদ্রেক করে। আলুর গুনাগুন, বাংলার আলুর পূর্বপুরুষকে যেভাবেই উদ্ধার করি না কেন অন্যান্য খাবারের মতোই অতিরিক্ত আলু খেলে অবশ্যই শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। তাই প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় আলু রাখলেও তা কিভাবে রাখছি এবং কতটুকু রাখছি তার হিসেবটা কিন্তু রাখা চাই।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা।